জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক by নার্গিস হোসনে আরা

বি, কথাশিল্পী, অনুবাদক, নাট্যকার_কী তাঁর পরিচয়, সমকালীন বাংলা সাহিত্যের কোন শাখাটিকে ঋদ্ধ করেননি তিনি? নিজে যেমন আলাদা ব্যক্তিত্বের মানুষ, তেমনি নিজের জন্য একটি আলাদা ভাষাশৈলীও তৈরি করে নিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হককে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি একাধারে কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, অনুবাদক। সাহিত্যের যে শাখাতে হাত দিয়েছেন, সেখানেই এসেছে সাফল্য।


সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা অন্যদের চেয়ে আলাদা। এমনকি সমসাময়িক কবিদের চেয়েও আলাদা কাব্যভাষা নিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরেন সৈয়দ শামসুল হক। আবার নিজের জন্য নিজের মতো একটি গদ্যভাষা নির্মাণেও সক্ষম হয়েছেন তিনি। সেই গদ্য তাঁর মতোই অভিজাত। ধীর চালের এই গদ্যরীতি আমাদের সাহিত্যে এক অমূল্য সংযোজন। নিজস্ব এই গদ্যশৈলী সৃষ্টির পাশাপাশি নিরন্তর নিরীক্ষা করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি আমাদের দেশের সেই বিরল লেখকদের একজন, যিনি সময়ের গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে এসে সব সময় আধুনিক, সমসাময়িক। কখনো কখনো অগ্রসর।
কবিতার ক্ষেত্রেও সৈয়দ শামসুল হক তৈরি করে নিয়েছেন আলাদা এক জগৎ। যেমন _আলাদা তিনি নাটকের ক্ষেত্রেও। কী মঞ্চে, কী টেলিভিশনে_সর্বত্রই সমান দাপট তাঁর। এমনকি সিনেমা_সেখানেও সফল সৈয়দ শামসুল হক। সৈয়দ হকের 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' নাটকটি ছিল 'থিয়েটার' স্কুলের বর্ষশেষ প্রযোজনা। তাঁর একটি বলিষ্ঠ রচনা 'গণনায়ক'। তাঁর আরেকটি নাটক 'এখানে এখন'। যে নাটকটির কথা না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে 'নূরলদীনের সারাজীবন'। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ব্যানারে প্রযোজিত নাটকটি দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মৌলিক নাটক রচনার পাশাপাশি উইলিয়াম শেকসপিয়ারের নাটক অনুবাদের ক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হক অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হকের 'ম্যাকবেথ' নাটকও সফলভাবে থিয়েটার স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা মঞ্চায়ন করেছে। সেই প্রযোজনার সঙ্গে ক্রিস্টোফার স্যান্ডফোর্ডের প্রথম 'ম্যাকবেথ' প্রযোজনার তেমন একটা মিল ছিল না। হেনরিক ইবসেনের দুই নাটকের দুই প্রধান চরিত্র ডা. স্টকম্যান, নোরা এবং সৈয়দ হকের ঈর্ষা নাটকের 'প্রৌঢ়' চরিত্রের সমন্বয়ে সৈয়দ হক লিখে ফেলেন এক নিরীক্ষামূলক নাটক, 'অপেক্ষমাণ'। নাটকটি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক ইবসেন উৎসবে মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি কায়রো আন্তর্জাতিক নিরীক্ষামূলক উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে ২০১০ সালে মিসরের কায়রোতে প্রতিযোগিতা পর্যায়ে অভিনীত হয়। পরবর্তীকালে কলকাতায় 'অন্য থিয়েটার'-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মঞ্চায়িত হয়ে প্রশংসিত হয়। সৈয়দ শামসুল হকের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছিন্নপত্র' অবলম্বনে রচিত 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকটি 'পালাকার' নাটকের দল মঞ্চায়ন করে। এই নাটকের মুখ্য চরিত্র তরুণ রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, যখন তিনি ছয় বছর একটানা আমাদের দেশে অতিবাহিত করেছিলেন পৈতৃক জমিদারি তদারকি করার জন্য। শিলাইদহ, পতিসর এবং শাহজাদপুর এ নাটকের ঘটনাস্থল। নাটকটি দেশে এবং ভারতের কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অভিনীত হয়ে দর্শক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
নিজের লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সৈয়দ শামসুল হক সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যখন সৃষ্টিশীলতার ভেতর থাকে, তখন তার একধরনের বদল ঘটে। কিন্তু সেই মুহূর্তের পর আবার সে সাধারণ হয়ে যায়।'
সৈয়দ শামসুল হক বিশ্বাস করেন, মানুষের মৌলিক অনুভূতির জায়গাগুলো পথে পাওয়া যায়। সেই অনুভূতিগুলোই তাঁর লেখায় মূর্ত করতে চেয়েছেন তিনি। নিজেকে সব সময় অতিক্রম করার চেষ্টা করেন সৈয়দ শামসুল হক_এমন কথাও উচ্চারণ করেছেন তিনি।
আজ জন্মদিনে প্রণতি জানাই এই সৃষ্টিশীল মানুষটিকে।

No comments

Powered by Blogger.