স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৬৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবুল খায়ের, বীর বিক্রম মৃত্যুর মুখেও যুদ্ধ থামাননি তিনি সারা দিন টহল আর খণ্ডযুদ্ধ শেষে ১০-১২ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধা রাত আনুমানিক ১২টার দিকে পালা করে বিশ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় তাঁদের দলনেতা মো. আবুল খায়েরের কাছে খবর এল, পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দলনেতা আবুল খায়ের সবাইকে


নিয়ে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন তাদের প্রতিরোধ করতে। তিনি ধারণা করেছিলেন, পাকিস্তানি সেনারা অন্তত ৫০০ গজ দূরে আছে। কিন্তু সামান্য অগ্রসর হয়েই বুঝতে পারলেন, পাকিস্তানি অনেক সেনা ৫০ থেকে ৬০ গজের মধ্যে একটি আম-কাঁঠালের বাগানে অবস্থান করছে। আবুল খায়েরের সঙ্গে একজন গুলির বাক্স বহনকারী থাকলেও বাকি সহযোদ্ধারা তখন বেশ দূরে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। একটি গাছের আড়ালে অবস্থান নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন দিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করল পাকিস্তানি সেনারা। তাঁর চোখের সামনে গুলির বাক্স বহনকারী যুবকটির দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। শহীদ হলেন ওই অজ্ঞাত মুক্তিযোদ্ধা। পেছনের সহযোদ্ধারা আর সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারলেন না। তাঁরা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হলেন। অন্ধকার রাতে আবুল খায়ের সম্পূর্ণ একা। সামনে অনেক পাকিস্তানি সেনা। তিনি কালেমা পড়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিলেন। জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে দুটি প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘অন্তত ১০-১২ জন পাকিস্তানি শত্রুসেনাকে না মেরে মরব না’ এবং ‘শত্রুর গুলি যদি লাগে, বুকে লাগবে, কিন্তু পিঠে লাগতে দেব না’। তিনি বিসমিল্লাহ বলে অসীম সাহস নিয়ে একাই গুলিবর্ষণ শুরু করলেন। অল্প সময়ের মধ্যে সামনের দিক থেকে গুলিবর্ষণ কমতে লাগল। অনুমান করলেন, পাকিস্তানি একাধিক সেনা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। একপর্যায়ে তাঁর দুই হাতে একসঙ্গে গুলি লাগে। বাঁ হাতে দুটি আর ডান হাতে সাত-আটটি। দুই হাতই অবশ হয়ে গেল তাঁর। আর গুলি ছুড়তে পারছিলেন না। শত্রুসেনাদের বুঝতে না দিয়ে আহত আবুল খায়ের নিঃশব্দে পেছনের দিকে যেতে লাগলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আবু বকর সিদ্দিক নামের এক সহযোদ্ধার (আনসার সদস্য) সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁর সহায়তায় দুই হাত পাট দিয়ে বেঁধে একটি খাল পার হয়ে ভোর পাঁচটায় ভারতে গিয়ে পৌঁছান। বেঁচে গেলেন তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা। ওই রাতে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ক্যাম্প দখল করে নেয়। পরে জানতে পারেন, তাঁর গুলিতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়েছে। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ২২ আগস্টের। বুড়িপোতা এলাকায়।
বুড়িপোতা মেহেরপুর জেলার অন্তর্গত, জেলা সদর থেকে পশ্চিমে। পরে আহত আবুল খায়েরকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের ব্যারাকপুর হাসপাতালে। ২৩ আগস্ট রাতে তাঁর দুই হাতে অপারেশন হয়। ২৪ আগস্ট রাতে জ্ঞান ফিরলে তিনি বুঝতে পারেন যে তাঁর কোনো হাত কাটা পড়েনি।
আবুল খায়ের চাকরি করতেন ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)। কর্মরত ছিলেন যশোরে ২৫ মার্চের পর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আহত হওয়ার আগে যশোর ও মেহেরপুরে বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসমসাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. আবুল খায়েরকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১১৬।
আবুল খায়েরের পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার কাশারা গ্রামে। বর্তমানে (১৯৮৬ সাল থেকে) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামে বসবাস করেন। এখানে বসতভিটা ছাড়া তাঁর আর কোনো বিষয়সম্পত্তি নেই। সামান্য যেটুকু জমি গ্রামের বাড়িতে ছিল, তা মেয়েদের বিয়ের জন্য বিক্রি করতে হয়েছে। তাঁর বাবার নাম মো. ননী মিয়া, মা মকছুদা খাতুন। স্ত্রী মাহমুদা খাতুন। তাঁদের দুই ছেলে ও ছয় মেয়ে।
আবুল খায়ের বলেন, ‘বর্তমান সরকার মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করেছে, এতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমরা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, তারা যদি বিজয়ী হতো, তাহলে আমাদের অনেক আগেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাত। বিলম্বে হলেও বিচারকাজটি দেখে যেতে পারলে শান্তি পাব।’
সূত্র: আবুল খায়ের বীর বিক্রমের সাক্ষাৎকার; নিয়েছেন প্রথম আলোর সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি বদরউদ্দিন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.