কৃষিপণ্যের বাজার-কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থহানি

বাজারে চাল এবং শাকসবজির দাম কম থাকলে ভোক্তারা খুশি হয়, কিন্তু উৎপাদকদের জন্য তা সন্তুষ্টির কারণ নাও হতে পারে। এই দুই পক্ষের মধ্যে আরেকটি পক্ষ ব্যবসায়ী। তাদের কাজ উৎপাদকের পণ্য ভোক্তার কাছে পেঁৗছে দেওয়া। এই তিন পক্ষ খুশি থাকলে সেটা অর্থনীতির জন্য আদর্শ পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষিপণ্যের মূল্য যথেষ্ট ভালো ছিল এবং তা উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের জন্য খুশির কারণ হয়ে ওঠে।


কিন্তু এই দুই পক্ষের বাইরে যে বৃৃহত্তর ক্রেতা গোষ্ঠী তারা নাখোশ হয়। শুধু নাখোশ বললে ভুল হবে, ক্রেতাদের মধ্যে দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের যথেষ্ট কষ্ট হয়। এমনকি মধ্যবিত্ত ক্রেতারাও সংসার চালাতে হিমশিম খায়। এবারের শীত মৌসুমে বাজারের চিত্র ভিন্ন। বোরো ও আমন মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হওয়ায় চালের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে_ গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দামেই মিলছে বাঙালির প্রধান খাদ্যদ্রব্য। এতে উৎপাদক কৃষক নাখোশ। তারা বলছেন, লাভ তেমন থাকছে না। এমনকি কোথাও কোথাও উৎপাদন ব্যয়ও উঠছে না। তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি শীতকালীন সবজি উৎপাদকদের। সোমবার সমকালে 'মুনাফা লুটে নিচ্ছে ফড়িয়ারা_ সবজির দাম পাচ্ছে না কৃষক' শিরোনামে সরেজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়, নরসিংদীর গ্রামাঞ্চলে ২ টাকায় দুই কেজি ওজনের যে ফুলকপি কৃষক বিক্রি করছেন, তা মাত্র ৫০ কিলোমিটার ট্রাকে অতিক্রম করে ঢাকায় আনার পর বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। বাঁধাকপি, শিম, আলুু_ সব কৃষিপণ্যের উৎপাদকরাই এভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেক এলাকায় মুলা কার্যত মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। শুধু নরসিংদী নয়, দেশের সর্বত্রই কৃষকের ক্ষেতে সবজির দাম বেজায় সস্তা। খুচরা বাজারের চিত্রও অভিন্ন হলে অন্তত বৃহত্তর ভোক্তা গোষ্ঠী খুশি থাকত। কিন্তু সমকালের প্রতিবেদনে স্পষ্ট দেখানো হয়েছে, উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্যই দুর্ভোগ সৃষ্টি করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। প্রকৃতপক্ষে এই অংশ সংখ্যায় অল্প এবং তাদের কারণে অনেক বেশি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা যুক্তি দেখায় পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির এবং তাতে কিছু যুক্তি রয়েছে। কিন্তু সমকালের প্রতিবেদনে যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, একটি বড় কপি বাজারে আনতে গড়ে ৫০ পয়সার বেশি ব্যয় পড়ে না। পুলিশ ও মাস্তানদের চাঁদাবাজির অভিযোগও তারা করেছেন এবং এতেও সত্যতা রয়েছে। এদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় সরকারের এবং এ কারণে উৎপাদক ও সাধারণ ক্রেতা উভয়েই তাদের সমালোচনা করে। সরকারের কাছে এ জবাবদিহিতা দাবি করা যেতেই পারে_ কেন তারা অল্প লোকের স্বার্থ দেখছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের উপেক্ষা করছে। পচনশীল কৃষিপণ্য সংরক্ষণের আয়োজনেও সরকার তেমন তৎপর নয়। এটা জানা যে, উৎপাদকরা ভালো লাভ না পেলে তাদের সংসার চালাতে সমস্যা হয়, বিনিয়োগ ক্ষমতাও কমে যায়। কঠোর শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত পণ্যের জন্য লাভের অঙ্ক সামান্য হলে কিংবা লোকসান গেলে পরবর্তী মৌসুমে চাষাবাদেও তার প্রভাব পড়তে পারে। এ অবস্থা অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতার সময়েও বাংলাদেশের কৃষি খাত প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখে দেশের জন্য খানিকটা স্বস্তিকর পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হতে থাকলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।

No comments

Powered by Blogger.