ছায়া থেকে স্বপ্নের দিগন্তে by অন্তরীপ রায়


গিফটেড। অথচ ছায়াঢাকা। প্রতিভাবান। কিন্তু মেসির মতো সহজাত নন। রোনালদোর মতো বাধাবন্ধহীন উদ্দামও বলা যায় না।গঞ্জালো হিগুয়াইন ও ন্যানিকে তাহলে কী বলবেন?_পার্শ্বনায়ক! যিনি আকর্ষণের কেন্দ্র থেকে দূরে, পরিধির কোলাহলে মুছে যান। গোল করেন; কিন্তু নায়ক হতে পারেন না। থাকেন আধুনিক ফুটবলের দুই দানব প্রতিভার অন্তরালে।


সাম্প্রতিক ফর্ম অবশ্য পরিস্থিতি বদলের ইঙ্গিতবাহী। মনে হচ্ছে, ন্যানি আর হিগুয়াইন ছায়া থেকে স্বপ্নের দিগন্তে বেরিয়ে আসছেন।
মাস দুয়েকের মধ্যে তিনটি হ্যাটট্রিক করেছেন হিগুয়াইন। দুটি রিয়াল মাদ্রিদের পক্ষে। পার্শ্বনায়কের ভূমিকায় ছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। অন্যটি আর্জেন্টিনার হয়ে চিলির বিপক্ষে। বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ধারণী ওই ম্যাচে চিরচেনা মেসি ছিলেন তার সঙ্গী।
ন্যানির প্রসঙ্গে ঢোকার আগে তার সাক্ষাৎকারের একটা চকিত অংশ তুলে ধরা যাক। 'লোকে মেসি এবং রোনালদোকে নিয়ে কী বলে আমি জানি; কিন্তু আমার স্বপ্ন বিশ্বসেরা হওয়ার।' ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পক্ষে দ্যুতি ছড়ানো এক ম্যাচের পর কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। স্রেফ বলার জন্যই বলা নয়, ইউরোর যোগ্যতা নির্ধারণী ম্যাচে পর্তুগালের হয়ে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে এর প্রমাণও রেখেছেন। ৫-৩ গোলের মহাগুরুত্বপূর্ণ জয়ের প্রথম দুটি গোল ন্যানির।
এ জায়গায় পেঁৗছতে আফ্রিকার বিপদসংকুল ঈধঢ়ব ঠবৎফব থেকে কত দূরে আসতে হয়েছে জানেন! মাইলের হিসাব তোলা থাক, আসলে একটা মহাদেশ পেরিয়েছেন তিনি। আফ্রিকা থেকে ইউরোপ।
ঈধঢ়ব ঠবৎফব-তে জন্ম নেওয়া শিশু ন্যানি মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিতৃপরিত্যক্ত। লিসবনে চাচা অ্যান্টনিয়ার কাছে বেড়ে ওঠা। স্বপ্ন ছিল রোনালদোর মতো উইঙ্গার হওয়ার। কাজেই নায়কের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্পোর্টিং লিসবন থেকে সোজা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে।
খেলেন দ্রুত এবং চাতুর্যময় ফুটবল। রোনালদোর চেয়ে ক্ষীণকায় কিন্তু মনোবলে ভরপুর। অ্যালেক্স ফার্গুসনের তত্ত্বাবধানে ম্যানচেস্টারে খেলার সময় প্রতিভার ওইসব অনুষঙ্গ প্রখর থেকে প্রখরতর হচ্ছে। রোনালদোকে ছুঁতে পারবেন কি-না পরের কথা। তবে ১৩২ মিলিয়ন ডলার রেকর্ড অর্থের বিনিময়ে রিয়ালের কাছে রোনালদো যেদিন বিকিয়ে যান, ন্যানি সেদিন নিজেকে বলেছিলেন_ 'স্বপ্নে বিশ্বাস রাখ... কাজ করে যাও... গোলের মাধ্যমে ক্ষমতা দেখাও।' হেড আর পায়ের কারুকার্যে রোনালদোর উপস্থিতিতে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে সে ক্ষমতাই দেখিয়েছেন ন্যানি।
হিগুয়াইনের পরিস্থিতি ভিন্ন। লাতিন আমেরিকায় নয়, তার জন্ম ফ্রান্সের ছোট্ট শহর ব্রেস্টে। বাবা জর্জ হিগুয়াইন খেলতেন সেই শহরের অখ্যাত কোনো ক্লাবে। ফ্রান্সকে পাশে সরিয়ে আর্জেন্টিনাকে বেছে নেওয়া তাই কঠিন ছিল। বিশেষ করে মেসি, আগুয়েরো, তেভেজ, মিলিতো এবং পাস্তরের মতো স্ট্রাইকারের ভিড়ে হিগুয়াইনের জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্ন দেখাটা ছিল রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার।
ক্লাব পর্যায়েও হিগুয়াইনের লড়াইটা সহজ ছিল না। কৈশোরে রিয়াল মাদ্রিদে এসেই দেখেছেন প্রখর ফর্মের রুড ফন নিস্টলরয়কে। তারপর থেকে ঝড়ের মতো উঠে এসেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, ফরাসি স্ট্রাইকার করিম বেঞ্জামা এবং ইমানুয়েল আদেবায়োর। তারা প্রত্যেকেই ক্লাব পর্যায়ে হিগুয়াইনের তুখোড় প্রতিদ্বন্দ্বী। কখনও কখনও ফুটবল গ্গ্ন্যামারে ছাপিয়ে যাওয়া সহযোদ্ধা।
এখন অবশ্য রিয়ালের সবচেয়ে দ্যুতিময় তারকা হিগুয়াইন। চলতি বছরের শুরুতে শিকাগোয় মেরুদণ্ডের হার্নিয়েটেড ডিস্কের জটিল অপারেশন শেষে মাঠে ফিরেই আলো ছড়াচ্ছেন। আগেও ছড়িয়েছেন; কিন্তু এমন উজ্জ্বলতা চোখে পড়েনি। আর পড়লেও রিয়াল সমর্থকরা বুঁদ ছিলেন অন্য তারকায়। অথচ রেকর্ড বলছে অন্য কথা। রিভারপ্লেট থেকে এসেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। দুই ক্লাবে খেলেছেন ২২৭ ম্যাচ। গোল করেছেন ১০৬। অবদান রেখেছেন ৪৩টিতে। এর পরও বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ ম্যারাডোনার কাছে কল্কে পাননি হিগুয়াইন। এখন অবশ্য পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। নবাগত আলেসান্দ্র সাবেলার আক্রমণ পরিকল্পনার কেন্দ্রভাগে আছেন তিনি।
দিয়েগো জমানায় গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তেভেজ ও আগুয়েরো। একজন ফর্ম এবং বিতর্কে ম্রিয়মাণ। অন্যজন ইনজুরিতে আক্রান্ত। নতুন চিন্তা আমদানির ক্ষেত্রে সাবেলা এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন। সামনের বিশ্বকাপ অভিযানে তাই ছয় ফুটের সুদর্শন স্ট্রাইকার হিগুয়াইন এখন নতুন কোচের ট্রাম্পকার্ড।
আক্রমণভাগের কৌশলই পাল্টে ফেলেছেন আর্জেন্টাইন কোচ। চিলির বিরুদ্ধে সর্বশেষ ম্যাচে একটু নিচের দিকে খেলিয়েছেন লিওনেল মেসি ও ডি মারিয়াকে। ওপরে ছিলেন গঞ্জালো হিগুয়াইন। গোলমুখে বলের জোগান ছিল নিরবচ্ছিন্ন। কাজে লেগেছিল রিয়াল সতীর্থের সঙ্গে তার বোঝাপড়াও। ফলে ডি মারিয়ার বাড়ানো পাসে দুটি গোল তুলে নিতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি হিগুয়াইনকে। চিলির বিরুদ্ধে ওই ম্যাচে নিজেই গোল করেননি, গোল করিয়ে অভিশাপমুক্ত করেছেন মেসিকেও। যিনি দীর্ঘ ৩০ মাস আকাশি-নীল জার্সি গায়ে গোলক্ষুধায় ফিরেছেন।
জোহানেসবার্গের সকার সিটির প্রসঙ্গ দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে এ মাঠেই গত বিশ্বকাপের একমাত্র হ্যাটট্রিক করেছিলেন হিগুয়াইন। বুয়েনেস আয়ার্সে উৎসব হয়েছিল। গোটা আর্জেন্টিনাতেও। একটু আনমনা কষ্ট নিয়ে দুলে উঠেছিল ফ্রান্সের ছোট্ট শহর ব্রেস্টও। আট বছরের দীর্ঘ বিরতির পর বিশ্বকাপে বিরল এ কীর্তি গড়েছিলেন তিনি। তৃতীয় আর্জেন্টাইন হিসেবে ইতিহাসের পাতায়ও নাম লেখান।
হ্যাটট্রিক করার পর সকার সিটি স্টেডিয়াম যখন ভুভুজেলার শব্দে কম্পমান, তখন কী ভাবছিলেন ইতিহাস নির্মাতা হিগুয়াইন? জানার উপায় ছিল না। তবে আন্দাজ করা যায়। হয়তো মেসি-ম্যারাডোনার তারকাদ্যুতির আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসার কথাই ভাবছিলেন তিনি। কোচের ভূমিকায় ম্যারাডোনা এখন অতীত। কিন্তু মনোযোগ আকর্ষণের অনন্য ক্ষমতা আর সহজাত ফুটবল প্রতিভা নিয়ে মেসি এখনও বর্তমান। তাই কি সবুজ আয়তক্ষেত্রে সুপ্ত ইচ্ছা বাস্তবায়নের সময় এলে একটু ভুলও করেন না। অবলীলায় হ্যাটট্রিক করেন, যা তাকে নিভৃতি ও আড়াল থেকে প্রচারের দশ দিগন্তে নিয়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.