দল চালাচ্ছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা by শাহজালাল রতন,

ল ক্ষমতায় থাকলেও ফেনী আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে স্বস্তি নেই। দলের একাধিক নেতার দাবি, দল চালাচ্ছে যুবলীগ-ছাত্রলীগের একশ্রেণীর ক্যাডার ও বহিরাগত বাহিনী। দলের নেতারা তাদের কাছে জিম্মি বলে অভিযোগ করেছেন জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতা। ক্যাডারদের হাতে বেশকিছু নেতা অপদস্থ ও হামলার ঘটনার পর এখন আর কারও পক্ষে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফেনী আওয়ামী লীগের খবর রাখেন এমন পর্যবেক্ষকরা জানান,


ফেনী আওয়ামী লীগে এ অবস্থা চলছে দু'বছর ধরে। গত ইউপি নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করেই ভিন্ন পরিস্থিতিতে দেওয়া হয়েছে দলের নামে চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন। চলেছে মনোনয়নবাণিজ্য। জেলা প্রশাসন চলছে

বাহিনীর পরামর্শে। তাদের নির্দেশে বিনা টেন্ডারে বিলি-বণ্টন হয় বিভিন্ন দফতরের ঠিকাদারি কাজ। বিনা ইজারায় নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। প্রশাসন সব দেখেও চুপচাপ থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
পেছন ফিরে দেখা
অভিজ্ঞ মহল জানায়, ফেনীর রাজনীতি দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির ও অনেকটা ক্যাডারনির্ভর। জেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ফেনী সদর থানার এমপি জয়নাল হাজারী হয়ে যান ফেনীর একচ্ছত্র নেতা। জয়নাল হাজারী প্রতিটি থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে গঠন করেন বিতর্কিত স্টিয়ারিং কমিটি। স্কুল-কলেজে গঠন করা হয় ক্লাস কমিটি। জেলার সর্বত্র ছিল এ বাহিনীর দাপট। হাজারীর আমলে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটি পরিণত হয় ঠুঁটোজগন্নাথে। জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠিত হলেও জয়নাল হাজারী যা বলতেন এবং হাজারীর স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্তই ছিল মূল সিদ্ধান্ত। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও জেলার বিভিন্ন স্থানের কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের অনেকে এ বাহিনীতে যোগদান করে। একমাত্র জয়নাল হাজারীকে তারা সমীহ করে চলত। জয়নাল হাজারী এ সময় বলতেন_ 'আমি করব আওয়ামী লীগ, অন্যরা করবে হাজারী লীগ।'
হাজারীর পর কারা
২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌথ অভিযানের পর জয়নাল হাজারী ফেনী ত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। তারপর বিএনপি সরকারের ৫ বছর হাজারী আর দেশে ফিরতে পারেননি। তার ক্যাডার বাহিনীর অনেকে পালিয়ে যান। অনেকে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত হয়ে জেলে যান। যারা ফেনীতে ছিলেন তাদের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় জয়নাল হাজারী টেলিফোনে নিয়ন্ত্রণ করতেন ফেনী আওয়ামী লীগ। তখন দলের ওপর হাজারীর চাপ থাকলেও ভেতরে ভেতরে জয়নাল হাজারীবিরোধী একটি গ্রুপ চাঙ্গা হতে থাকে। ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে দলের ওপর জেলা কমিটির প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। কমতে শুরু করে হাজারীর প্রভাব।
২০০৫-০৬ সালের দিকে ফেনীতে এসে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন হাজারীর এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর, তার জ্ঞাতি ভাই যুবলীগ নেতা নিজাম হাজারী। এর আগে নিজাম হাজারী চট্টগ্রামে যুবলীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিজাম নিজেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব লাভের আশায় হাজারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। শুরু করেন হাজারীবিরোধী কার্যক্রম। জেলা কমিটিসহ অনেকে তার সঙ্গে সুর মেলাতে শুরু করেন। তার সঙ্গে অঘোষিতভাবে যোগ দেন সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এপিএস আলাউদ্দিন নাসিম। গত সাধারণ নির্বাচনে কারাদণ্ডের কারণে ও ভারতে পলাতক থাকায় হাজারীর পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। তিনি ছিলেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী। এ নির্বাচনের কারণে হাজারী এক ধাপ পেছনে চলে আসেন।
দল ক্ষমতায় আসার পর জয়নাল হাজারী দেশে ফিরে আসেন। তখন তার বিরোধীরা অনেক শক্তিশালী অবস্থানে। হাজারীর ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনেকে তাকে ত্যাগ করে নিজাম হাজারীর সঙ্গে যোগ দেন। তাদের মধ্যে অন্যতম জয়নাল হাজারীর স্টিয়ারিং কমিটির সচিব ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম, পরশুরাম উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল মজুমদার, ছাত্রলীগ নেতা দাগনভূঞা উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন, ছাত্রলীগ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শুসেন শীল, সোনাগাজী ছাত্রলীগ নেতা জহির ও মিন্টু বাহিনীর মিন্টু, জেলা যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আদেল, জেলা কৃষক লীগ সাধারণ সম্পাদক পৌর কাউন্সিলর আশরাফুল আলম গিটার, চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ মিলন, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জুয়েল, সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, কাউন্সিলর শিপলু। এমনকি জয়নাল হাজারীর নিজ এলাকা ফেনীর মাস্টারপাড়া এলাকার হাজারী সমর্থক যুবকরা পক্ষ ত্যাগ করে নিজাম হাজারীর সঙ্গে ভিড়ে যায়। গ্রামাঞ্চলের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা দলে দলে যোগ দেয় নিজাম হাজারীর পক্ষে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কার হাতে
জেলায় হাজারীর প্রভাব কমে যাওয়ার পর চাঙ্গা হয়ে ওঠে হাজারী বিরোধীরা। তবে এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের ওপর ক্যাডার বাহিনীর চাপ ছিল সামান্য। ক্রমে জেলা আওয়ামী লীগের ওপর তাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। দলের অঘোষিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন পৌর চেয়াম্যান নিজাম হাজারী। তাকে ঘিরেই দলের ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা আবর্তিত হতে শুরু করে। জেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় বহিরাগত গ্রুপটি পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি আইনুল কবির শামিমের ওপর হামলা চালায়। সোনাগাজী থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সামছুল আরেফিনের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হলে তিনি মারাত্মক আহত হন।
আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে সর্বশেষ ফেনী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছর জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল হাসেম ইন্তেকাল করেন। ২০০৩ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল হাজারীকে বিশৃঙ্খলার কারণ দেখিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি দল থেকে বহিষ্কার করে। দল ক্ষমতায় এলে সবার সঙ্গে হাজারীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু হাজারীকে আর দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিনে দলের আরও ৫ জন সিনিয়র নেতার মৃত্যু হয়। কাউন্সিল না হওয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। দলের ঊধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিলেও নেতাদের মধ্যে অনৈক্যের কারণে কাউন্সিল করা সম্ভব হয়নি। মূলত জয়নাল হাজারী ও নতুন নেতা নিজাম হাজারীর মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে আগামীতে কাউন্সিল করা সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। জয়নাল হাজারীর একাধিক সমর্থক বলেছেন, হাজারীকে বাদ দিয়ে একটি মহল কেন্দ্রের নিকট আহ্বায়ক কমিটি করে তালিকা প্রদান করেছিল। তিন-তিনবারের এমপি জয়নাল হাজারীর নাম না থাকায় কেন্দ্র তা গ্রহণ করেনি। নিজাম হাজারীর সর্মথকরা জানান, ফেনী আওয়ামী লীগে নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন। সেভাবেই দল এগিয়ে চলেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, হাজারী এখনও ফেনী আওয়ামী লীগে ফ্যাক্টর কিন্তু শক্তি বিবেচনা করে এ মুহূর্তে নিজাম হাজারীকে ফেলা যাবে না।
নেতারা যা বলেন
এ ব্যাপারে জয়নাল হাজারীর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, দলের সভানেত্রী যখন বলবেন, তখন তিনি ফেনী আসবেন। তার আগে জেলা আওয়ামী লীগ নিয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, দলের মধ্যে রাজনীতি বলতে রয়েছে মনোনয়নবাণিজ্য, কমিশন, টেন্ডারবাজি ও বালুমহাল লুট। এ টাকার ভাগ ঢাকায় কারও কারও পকেটে যায় বলে তিনি অভিযোগ করেন। ফেনী পৌর মেয়র জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য নিজাম হাজারী বলেন, জয়নাল হাজারী যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়েছে। তিনি এখন তাদের সুপথে আনার চেষ্টা করছেন। ফেনী এখন শান্ত বলে তিনি দাবি করেন। জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আজিজ আহাম্মদ চৌধুরী স্বীকার করে বলেছেন, দলের মধ্যে বহিরাগতদের চাপ রয়েছে। তিনি আইনুল কবির শামিমের ওপর হামলাকে পরিকল্পিত বলে জানান। এভাবে জেলা কমিটির সভায় হামলা করা উচিত হয়নি বলে তিনি দাবি করেন। দলে বহিরাগতদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন।

No comments

Powered by Blogger.