কঠিন সময়ে অর্থনীতি

দেশের অর্থনীতিতে সংকট বাড়ছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে বেশ কিছু চাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অর্থনীতির স্বস্তির জায়গাগুলো ধীরে ধীরে কমে আসছে। বেশ কয়েক মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। সর্বশেষ অক্টোবরে ১১ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দামের চাপে জনগণ যখন অস্থির, তখন জ্বালানি তেলের দর আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে সম্ভাব্য মন্দার প্রভাবে রফতানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে রফতানি আয়ের বৃহৎ খাত তৈরি পোশাক শিল্প অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এর পাশাপাশি পাট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের
রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ইতিমধ্যে ওভেন ও নিট পোশাক পণ্যের রফতানি আদেশ কমে গেছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহে শ্লথগতি দেখা দিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখনই সতর্ক হয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়ে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সঠিক পদক্ষেপ না নিলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল শনিবার এক কর্মশালায় বলেছেন, সরকারের ব্যর্থতায় অর্থনীতি 'রসাতলে' যাচ্ছে। পরিস্থিতি অনিবার্য সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ কোনোটিই নেই। ব্যাংকাররা চিন্তিত আছেন, তাদের ব্যাংকগুলো আর কতদিন টিকবে।
অর্থনীতির এ অবস্থায় সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে আজ রোববার এ সংক্রান্ত জাতীয় কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সূত্র জানায়, বৈঠক উপলক্ষে অর্থনীতির হালনাগাদ সূচক নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনটি বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। সৃষ্ট সংকট উত্তরণে বৈঠকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পরিকল্পনা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সরকারের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ১৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৪ কোটি ডলার বেশি। সামগ্রিক লেনদেনে ভারসাম্যে ঘাটতি হয়েছে ৪০ কোটি ডলার । বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাম্প্রতিক সময়ে কমে ১ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিতে তেমন গতি নেই। অন্যদিকে গত এক বছরে টাকার দরপতন হয়েছে অন্তত ৭ শতাংশ। বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে সরকার বিদেশি সহায়তা কম পাচ্ছে। বৈদেশিক সহায়তা ছাড় অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কমেছে ৫৭ শতাংশ। প্রথম তিন মাসে প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমে গেছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। দাতাদের উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক পিছিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা এবং আইএমএফের কাছ থেকে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য সহায়তা প্রাপ্তির ব্যাপারে ইতিবাচক অগ্রগতি নেই।
অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে ব্যাপক হারে। এ কারণে বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে সরকার ব্যাংক ঋণের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে ৪ মাসে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা পুরো অর্থবছরের ব্যাংক ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি।
অর্থনীতিতে বিশ্বমন্দার সম্ভাব্য প্রভাব : ঋণ সংকটের কারণে ইউরোপ বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়ছে। প্রথমে গ্রিসে এ সংকট শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে স্পেন, ইতালিসহ গোটা ইউরোপে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সৃষ্ট সংকট বিশ্বমন্দায় রূপ নিতে পারে, যার আঘাত এসে পড়বে বাংলাদেশে। সম্ভাব্য বিশ্বমন্দা মোকাবেলায় এখনও তেমন প্রস্তুতি নেই সরকারের। ২০০৮ সালে মন্দা-উত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও কার্যত ওই কমিটি নিষ্ক্রিয়। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রণজিৎ কুমার চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, মন্দার কারণে অর্থনীতিতে যে সব অভিঘাত আসতে পারে সে সম্পর্কে সতর্ক আছে সরকার। টাস্কফোর্স বিলুপ্ত নয়_ এ মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারের কাজ হচ্ছে অর্থনীতির সামষ্টিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এর জন্য যে সব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা বাস্তবায়নে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লেনদেনের ভারসাম্য চাপের মুখে আছে। বিশ্বমন্দার অভিঘাতের কারণে চাপ আরও বাড়বে। ইউরোপ হচ্ছে বাংলাদেশের রফতানি আয়ের বড় উৎস। কাজেই ইউরোপে মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের রফতানি খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, পদক্ষেপ নিতে হবে বাস্তবতার আলোকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। এর জন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকে বেশি নজর দিতে হবে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত তৈরি পোশাক খাতে আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় ছিল ৩৮ শতাংশ। পোশাক শিল্পের মালিকরা বলেন, এই প্রবণতা চলতে থাকলে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মন্দার কারণে সেপ্টেম্বর মাসে পোশাক রফতানির আদেশ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭ শতাংশ কমে গেছে। ইতিমধ্যে আগাম অনেক আদেশ বাতিল হয়ে গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন. মন্দার কারণে গোটা ইউরোপে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমে গেছে। ইউরোপের বাজারে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে রফতানি কমে গেছে। ইতিমধ্যে আগাম আদেশ বাতিল হয়ে গেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে রফতানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে নীতি গ্রহণ করতে হবে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, মন্দার কারণে ইউরোপে বাংলাদেশি পোশাক পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। ডিসেম্বরের জন্য পাওয়া কিছু রফতানি অর্ডার ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তাতে আগামী এপ্রিলের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার লক্ষণ নেই।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর বলেন, এখনও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। তবে আগাম সতর্ক থাকা ভালো। তার মতে, আগের মন্দা ছিল জোরালো। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতির কোনো ক্ষতি হয়নি। তার কারণ, তখন আমাদের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি ছিল বেশি। যে কারণে মন্দার ধাক্কা কাবু করতে পারেনি। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। অর্থনীতির ভিত নড়বড়ে। এ অবস্থায় সরকারের প্রধান কাজ হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা তৈরি রাখা। নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, মন্দার কারণে অর্থনীতিতে কালো ছায়া পড়েছে। শুরুতে গ্রিস আক্রান্ত হলেও এখন ইতালিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে তা ছড়িয়ে পড়ছে। এখনও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি। তবে এটা অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের রফতানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য এখন থেকেই নতুন বাজারের সন্ধান করতে হবে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোই সমাধান নয় : ভর্তুকির প্রশ্নে সরকারের নীতিনির্ধারক, দাতা সংস্থা এবং অর্থনীতিবিদদের নানা ব্যাখ্যা ও মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ মনে করেন, কৃষি ও জ্বালানি খাতে সরকার যে ভর্তুকি দেয় তার বেশিরভাগ উপকারভোগী নিম্ন আয়ের লোক। ভর্তুকি কমিয়ে দিলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভর্তুকির চাপ অনেক বেশি বহন করতে গিয়ে সরকারকে বেশি বেশি ঋণ করতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি পণ্যের দাম কমিয়ে রাখার চেয়ে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি টেকসই রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, সরকার যা কর পাচ্ছে তার অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে ভর্তুকির পেছনে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত মনে করেন, ভর্তুকি কমানো বা তুলে দেওয়া গণমানুষের স্বার্থবিরোধী। মনে রাখতে হবে, যে অর্থনৈতিক নীতি সামাজিক প্রভাব বিবেচনা করে না, সেই নীতি ভালো নয়। ভর্তুকির চাপে অর্থনীতির যে সব সমস্যা হচ্ছে তা থেকে বেরোনোর উপায় কী জানতে চাইলে আবুল বারকাত বলেন, ভর্তুকি উঠিয়ে না দিয়ে সরকারের আয় বাড়াতে হবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভর্তুকি উঠিয়ে দিলে সরকারের ব্যয় কমবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। জনগণের জন্য এই ব্যয়টা বাদ না দিয়ে সরকার ইচ্ছা করলেই কয়েকটি পদক্ষেপের মাধ্যমে অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে। দেশে ১ কোটি টাকা কর দেন এমন ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা মাত্র ৪৬ জন। তার ধারণা, অন্তত ৫০ হাজার লোক আছেন যারা ১ কোটি টাকা কর দিতে পারেন। এভাবে সরকারের আয় বাড়তে পারে ৫০ হাজার কোটি টাকা। সরকার বিলাসী গাড়ি, টেলিভিশন, এসি, রেফ্রিজারেটরসহ বিলাস পণ্যে কর বাড়াতে পারে। অনেকের গাড়ি আছে, টিআইএন আছে কিন্তু কর দেন না। তাদের কর দিতে বাধ্য করতে হবে। যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের ওপর এয়ারপোর্ট কর আরোপ করা যেতে পারে। এভাবে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা আয় হতে পারে।
আইএমএফের দৃষ্টিতে অর্থনীতি : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সম্প্রতি বাংলাদেশের ওপর তাদের আর্টিকেল-ফোর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিশেষ এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। জ্বালানি তেল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়ে যাওয়ার চাহিদা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যকে বেশ চাপের মুখে ফেলেছে। ভর্তুকির চাপ বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বেকায়দায় পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছেছে। আইএমএফ বলেছে, রফতানিতে তেজি প্রবৃদ্ধি থাকলেও গত অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা যায়, যা গত এক দশকে ঘটেনি।

No comments

Powered by Blogger.