রঙ্গব্যঙ্গ-মেয়র লোকমানের আত্মার জবানবন্দি by মোস্তফা কামাল

শুরুতে একটি রূপকথার গল্প বলছি। গল্পটি এ রকম, আরবদেশে এক ক্ষমতাধর রাজা ছিলেন। তিনি মুখে যা বলতেন, সেটাই ছিল আইন। তাঁর কথার বাইরে কারো কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। কেউ রাজার কথার বিরুদ্ধাচরণ করলেই তার শাস্তি ছিল অনিবার্য। সেই শাস্তিও ছিল বড় কঠিন। শূলে চড়িয়ে তাকে হত্যা করা হতো। রাজার ছিল এক ছেলে। আর তিনি ছিলেন খুবই জনদরদি।


তিনি প্রায়ই রাজার অন্যায়-অমানবিক কাজের প্রতিবাদ করতেন। একবার রাজার এক সভায় এক দরিদ্র প্রজাকে মৃতুদণ্ড দেওয়া হলো। রাজকুমার মন্ত্রীদের সামনেই পিতার কঠোর সমালোচনা করলেন এবং তিনি বললেন, মৃত্যুদণ্ড রহিত করা না হলে তিনি নিজে আত্মহত্যা করবেন। এতে রাজা খুবই বিরক্ত হলেন। মন্ত্রীরা বললেন, জাহাঁপনা, রাজকুমারের এই কর্মকাণ্ড কিছুতেই মানা যায় না। এ রকম চলতে থাকলে প্রজাসাধারণ আপনাকে মানবে না। তারা সিংহাসন দখল করবে।
রাজাও অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখলেন, ছেলে যা করছে, সেটা রাজার জন্য হুমকিস্বরূপ। তিনি ছেলেকে ডেকে বললেন, 'দেখো বাবা, আমাদের দেশের আইন হচ্ছে রাজার ছেলে রাজা হবে। কাজেই তুমি হচ্ছ ভবিষ্যৎ রাজা। তোমাকে এখন থেকেই যোগ্য রাজা হয়ে ওঠার তালিম নিতে হবে। তুমি সাধারণ প্রজাদের সঙ্গে মিশতে পারবে না।' রানিও ছেলেকে এসব কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু রাজকুমার এ কথা শুনতে নারাজ। তিনি রাজা-রানিকে সাফ জানিয়ে দিলেন, 'আমার সিংহাসনের দরকার নেই। আমি সাধারণ প্রজাদের ভালোবাসা চাই। প্রজাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সাথি হতে চাই।' তারপর একদিন রাজকুমার রাজদরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি সাধারণ প্রজাদের সঙ্গে নিয়ে রাজার অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতে লাগলেন। আর এতে রাজকুমার ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। সাধারণ প্রজারা আর রাজার আদেশ-নিষেধ মানে না। প্রজাদের নয়নের মণি হচ্ছেন রাজকুমার।
দিনে দিনে পরিস্থিতি এমন রূপ নিল যে রাজার সিংহাসনচ্যুত হওয়ার উপক্রম হলো। রাজা মনে মনে ভাবলেন, ছেলের কাছে পরাজয় কিছুতেই মানা যায় না। তাই তিনি তাঁর লোকদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন রাজকুমারকে কতল করে। রাজার হুকুম, তামিল তো করতেই হয়। পরের রাতেই রাজকুমারকে হত্যা করা হলো। আর এতে খেপে গেল সাধারণ প্রজা। রাজকুমার হত্যার প্রতিবাদে তারা তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলল। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজা বললেন, খুনিকে খুঁজে বের করে অবশ্যই তার বিচার করা হবে। তিনি পুলিশবাহিনীকে বললেন, রাজকুমার যে বাড়িতে ছিল, সেই বাড়ির মালিককে খুঁজে বের করো। খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল এক সাধারণ প্রজাকে, যে রাজকুমারকে আশ্রয় দিয়েছিল মাত্র। আর সে জন্য রাজকুমার হত্যার দায় চাপল তার ওপর। তাকেই শূলে চড়ানো হলো।
এখানেই শেষ নয়, রাজকুমারের দেহখানি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তাঁর আত্মা তো রয়েই গেছে! সেই আত্মা সারা দেশে ঘুরে আসল খুনির নাম বলে বেড়াচ্ছে। খুনি হচ্ছেন দেশটির রাজা! তারপর যা হওয়ার তা-ই হলো। খুনের দায়ে রাজাকেই শেষ পর্যন্ত শূলে চড়তে হলো।
২.
নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেন অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের বন্ধু। দুষ্টু লোকরা তার কাছে পাত্তা পেত না। কোনো রকম চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি প্রশ্রয় দিতেন না তিনি। তা ছাড়া তিনি বেঁচে থাকলে দুষ্টু লোকদের জন্য রাজনীতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল, লোকমানকে বাঁচতে দেবে না। শুরু হলো লোকমানকে হত্যার পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুযায়ী টাকা দিয়ে খুনি ভাড়া করা হলো। তারপর এক সন্ধ্যায় পার্টি অফিসে গুলি করে হত্যা করা হলো লোকমানকে।
লোকমানের দেহখানি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তার আত্মা তো রয়েই গেছে! সেই আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে নরসিংদীর অলিগলিতে। প্রথমে লোকমানের আত্মা এক পাগলের ওপর ভর করে। সেই পাগল শহরে ঘুরে ঘুরে বলতে থাকে, 'ও আমার লোকমান ভাই, তোমার খুনের বদলা নেব, মন্ত্রীর এবার রক্ষা নাই।'
এ কথা যখন শহরময় ছড়িয়ে পড়ল, তখন মন্ত্রীর লোকরা দেখল, অবস্থা তো খারাপ! পাগলটাকে দ্রুত শহরছাড়া না করলে সবাই জানবে মন্ত্রীই খুনি। কাজেই মন্ত্রীর লোকরা পাগলটার মুখে কাপড় বেঁধে টেকনাফে পাঠিয়ে দিল। মন্ত্রীর লোকরা ভাবল, সমস্যা বুঝি শেষ হয়ে গেছে। আসলে তা হয়নি।
লোকমানের আত্মা এবার অদৃশ্য মানুষের রূপ ধরল। তারপর সে একটি হাত-মাইক নিয়ে শহরে ঘুরে ঘুরে ঘোষণা করতে থাকল, 'ভাইসব, আপনারা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আমার নাম লোকমান। আপনাদের প্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন। আমি সশরীরে পৃথিবীতে নেই। আমি আসলে তাঁর আত্মা। আমাকে যারা হত্যা করেছে, তাদের নাম আপনারা জানেন? আমি তাদের নাম বলছি। আমার আসল খুনি হচ্ছে সালাউদ্দিন বাচ্চু, মতিন সরকার, আশরাফ সরকার, মোবারক হোসেন, নূরুল ইসলাম, টিপ্পন কাজী প্রমুখ। ভাইসব, আপনারা এই খুনিদের ধরিয়ে দিন।'
বারবার এই ঘোষণা শুনে শহরের লোকজন তাজ্জব বনে গেল। উৎসুক অনেকেই রাস্তায় নেমে এল। কোথা থেকে ঘোষণাটা আসছে তা দেখার চেষ্টা করল। না, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু লোকমানের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে সেই কণ্ঠস্বর রেকর্ড করল। তারপর সবাই পাগলের মতো লোকমানকে খুঁজতে থাকল। কোথায় পাবে তাঁকে! আত্মা তো অদৃশ্য।
এই খবর নরসিংদীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর আস্তে আস্তে তা সারা দেশে ছড়িয়ে গেল। জেনে গেল দেশের সাধারণ মানুষ। লোকমানের নিজের মুখের কথা! কাজেই অবিশ্বাস করারও জো নেই। আর এতে সরকার পড়ে গেল ভীষণ বিপদে। তারা অন্যের ঘাড়ে যে দোষ চাপাবে, তারও কোনো সুযোগ নেই। উপায়ান্তর না পেয়ে সরকার পুলিশকে নির্দেশ দিল আসল খুনিকে খুঁজে বের করার। সেই নির্দেশের মধ্যে কোনো ইঙ্গিতও বুঝি ছিল। তাই পুলিশ আর আসল খুনিদের খুঁজে পায় না।
পুলিশের এই খোঁজাখুঁজির কাণ্ড দেখে জনৈক রসিক লোক বললেন, 'লোকমানের আত্মার কল্যাণে সবাই জানে খুনি কে! তারা কোথায় আছে, তাও পুলিশ জানে। কিন্তু ওপরের চাপে চোখ বন্ধ করে খোঁজাখুঁজি করছে। তাই আসল খুনিদের দেখতে পাচ্ছে না। একদিন সময় যখন আসবে, বিচার না পাওয়া এই আত্মাগুলো তখন সরকারকে ঠিকই শূলে চড়াবে!'

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.