উপেক্ষিত প্রতিবন্ধী শিশুর অধিকার by সায়মা চৌধুরী

জ ২০ নভেম্বর ২০১১, জাতিসংঘ ঘোষিত 'সর্বজনীন শিশু দিবস'। শিশুদের জন্য আরও নিরাপদ, ন্যায্য ও টেকসই একটি পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৮৯ সালের এই দিনে 'জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি)' গৃহীত হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর এ দিনটি 'সর্বজনীন শিশু দিবস' হিসেবে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়ে আসছে শিশুদের অধিকার সমুন্নত করার বার্তা নিয়ে। তবে এ দিবস পালন অর্থবহ হবে তখনই, যখন সব শিশুর অধিকার, বিশেষত মৌলিক


অধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ জন্য সবচেয়ে জরুরি প্রতিটি শিশুর স্বতন্ত্র চাহিদাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা।
প্রতিটি শিশুর স্বতন্ত্র চাহিদার বিষয়টি বিশেষভাবে বলার কারণ হলো 'শিশু' কোনো সমরূপ বর্গ নয়। জাতিগত বৈষম্য, ধর্মীয় পরিচয়, বর্ণবৈষম্য, দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধিতা প্রভৃতি সামাজিক অসমতার কারণে বিশ্বব্যাপী শিশুদের পরিস্থিতি ও বাস্তবতা ভিন্ন। 'জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদেও (সিআরসি)' এই সামাজিক অসমতা স্বীকৃতি পেয়েছে (অনুচ্ছেদ ২)। সংযোজিত হয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু অনুচ্ছেদ (অনুচ্ছেদ ১১ : শিশু পাচার প্রতিরোধ; অনুচ্ছেদ ২২ :শরণার্থী শিশুর অধিকার; অনুচ্ছেদ ২৩ :প্রতিবন্ধী শিশুর অধিকার; অনুচ্ছেদ ৩০ :সংখ্যালঘুদের অধিকার ইত্যাদি)। সিআরসি ছাড়াও শিশু অধিকার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে 'সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা'য় (এমডিজি)। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) মতামত অনুযায়ী, এমডিজির আটটি লক্ষ্যমাত্রার প্রথম ছয়টিই সরাসরি শিশুদের অধিকারসংশ্লিষ্ট এবং শেষ দুটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে শিশুদের জীবনে তা পরোক্ষভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের শরিক রাষ্ট্র হিসেবে সিআরসি অনুস্বাক্ষর করেছে ১৯৯০ সালে। 'সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)' অর্জনেও বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। সে অর্থে সব শিশুর অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দায়বদ্ধ। জাতীয় পর্যায়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের উন্নয়নে বিশেষ বিধান প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয় 'শিশু আইন-১৯৭৪' এবং 'জাতীয় শিশুনীতি- ১৯৯৪'। সম্প্রতি 'জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটি'র সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৪ সালের শিশুনীতিকে যুগোপযোগী করে 'জাতীয় শিশুনীতি-২০১১' প্রণয়ন করেছে।
আশার কথা, শিশু অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের অর্জন কেবল সনদ অনুস্বাক্ষর ও আইন-নীতিমালা প্রণয়নেই থেমে নেই। বাস্তবায়ন পর্যায়ে কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্যও এসেছে। সব শিশুকে পর্যায়ক্রমে বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা; বিদ্যালয় থেকে শিশুর ঝরে পড়া অনেকাংশে রোধ করা ও যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করতে মধ্যাহ্ন বিরতিতে গরম খাবার পরিবেশন; শিশুর ওপর সব ধরনের মানসিক ও শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করার মতো উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকার প্রশংসার দাবিদার। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে কমিউনিটিভিত্তিক শিশুশ্রম কার্যক্রম তদারকি দল গঠন, ৮৭% শিশুকে সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় আনা গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের অন্তর্ভুিক্তর ক্রমবর্ধমান হার, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে জেন্ডার সমতা অর্জন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মোটামুটি সন্তোষজনক অগ্রগতি করেছে। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'জাতিসংঘ সহস্রাব্দ পুরস্কার-২০১০' পেয়েছেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্ভবত, বৈষম্যপীড়িত অন্যান্য শিশুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুরা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার বিষয়ে স্বতন্ত্র অনুচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও ২০০৫ সাল অবধি প্রতিবন্ধী শিশুদের সার্বিক অধিকার তেমনভাবে অর্জিত হয়নি। ফলে এ বিষয়ে আবারও গুরুত্ব আরোপ করতে হয়েছে ২০০৬ সালে গৃহীত 'জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদ (সিআরপিডি)'-এ একটি সুনির্দিষ্ট ধারা (ধারা ৭ : প্রতিবন্ধী শিশু) অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে এ বিষয়টি 'জাতীয় শিশুনীতি-২০১১' ও 'জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০'-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপে অটিস্টিক শিশুদের উন্নয়নে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের দ্রুত শনাক্তকরণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের মোট ১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, খুলনা শিশু হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জের মাতুয়াইলের মাতৃ-শিশু ইনস্টিটিউটে মোট ১৮টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুর বিকাশে ২০১১-১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির জন্য ৮.৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় তেমন সন্তোষজনক অগ্রগতি নেই। যথাযথ শিক্ষা একটি শিশুর সামগ্রিক বিকাশে সবচেয়ে জরুরী বিষয়। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষার বিষয়ে একটু দৃকপাত করলেই বাস্তব পরিস্থিতির একটি খণ্ডচিত্র পাওয়া যাবে। ২০০৮ সালে সরকার একীভূত শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ চাহিদা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর আওতায় প্রতিবন্ধী শিশুদের মূলধারার বিদ্যালয়ে ভর্তির দিকনির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ২০০৯ সালের এক বেসরকারি হিসাবমতে, স্কুলগামী ১৬ লাখ (৬-১১ বছর) প্রতিবন্ধী শিশুর মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এই ৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশুর মধ্যেও বেশিরভাগ ঝরে পড়ছে প্রয়োজনীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ, বিশেষ শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতা ও অবকাঠামোগত বাধার কারণে।
মূলত প্রতিবন্ধী শিশুর স্বতন্ত্র চাহিদা/বাস্তবতাগুলোকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে এক ধরনের খয়রাতি মনোভাব রয়েছে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে। নামমাত্র কিছু উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবন্ধী শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এ জন্য দরকার অন্যান্য শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুদের সমমর্যাদা দেওয়া, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের বোঝা হিসেবে না দেখে তাদের বিকাশের সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হওয়া এবং তাদের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃৃক্ত করা। কারণ প্রতিবন্ধী শিশুদের বাদ দিয়ে সর্বজনীন শিশু অধিকার কখনও অর্জিত হবে না। সুদূরপরাহত রয়ে যাবে একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন।
sayema.chowdhury@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.