ডিসিসির বিভক্তিতে সমস্যা বাড়বে-বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা আমলে নিতে সরকার নারাজ by অমিতোষ পাল

নসংখ্যার বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন চীনের সাংহাই। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী শহরটির জনসংখ্যা দুই কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার। আয়তন সাত হাজার ৩৭ বর্গকিলোমিটার। সেখানে একটি মাত্র সিটি করপোরেশন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বা আয়তনের বিচারে বিশ্বের বড় সিটি করপোরেশন হিসেবে পরিচিত চীনের গুয়াংজু, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা, ভারতের মুম্বাই, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক_সর্বত্র একটিমাত্র সিটি করপোরেশনই


কাজ করে যাচ্ছে। অথচ ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (ডিসিসি) দুই ভাগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার।
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করলে সুবিধা-অসুবিধা কী হতে পারে_এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত হলো, এমন পদক্ষেপে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হবে। অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য, উন্নততর নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এম এম শওকত আলী এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একসময় লন্ডনকে ভাঙা হয়েছিল। সেটা অর্থবহ হয়নি। পরে তারা আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে গুলশান, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে পৃথক মিউনিসিপ্যাল করা হয়েছিল। অর্থবহ না হওয়ায় সেটাকেও আবার এক করে সিটি করপোরেশন করা হয়েছে। আসলে ছোট হয়ে গেলে রিসোর্স ক্যাপাসিটি কমে যায়।' তিনি আরো বলেন, 'দুটি সিটি করপোরেশন করার লাভ-ক্ষতি কী হবে সেটা পরে বোঝা যাবে। তবে এটা করার আগে অনেক গবেষণার প্রয়োজন ছিল। আপাতত মনে হচ্ছে, বিভাজন হলে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেবে। তৈরি হবে নানা সমস্যা।'
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, 'একসময় ঢাকায় তিনটি পৌরসভা থাকলেও সুবিধার জন্যই সেগুলোকে আবার এক করা হয়েছে। এখন আবার যথাযথ পর্যালোচনা ছাড়া বিভক্তি ভালো হবে বলে মনে হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে, আলাপ-আলোচনা করে সরকার ধীরগতিতে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারত।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, 'আমাদের দেশে কোনো সিদ্ধান্তই রাজনীতিমুক্ত নয়। ঢাকাকে দুই ভাগ করার পেছনেও কোনো রাজনীতি থাকতে পারে।'
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, 'এত দিন মেয়ররা সিটি গভর্নমেন্টের দাবি তুলে আসছিলেন। সেটা না করে সিটিই দুই ভাগ করে ফেলা হলো। এই বিভাজন নগরবাসীর জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে আমার মনে হয় না।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, বর্তমানে ৯০টি ওয়ার্ডের ২৮টি রাখা হচ্ছে ডিসিসির উত্তরে। ৬২টি দক্ষিণে। অথচ উত্তরের ওয়ার্ড থেকে আদায় হয় ৮০ শতাংশ রাজস্ব। এই আয়ের বেশির ভাগ ব্যয় হয় দক্ষিণের উন্নয়নে। এসব কারণে বৈষম্য তৈরি হবে। পাশাপাশি দুটি সিটি করপোরেশনে ভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তি মেয়র নির্বাচিত হলে সমন্বয়ের অভাব হবে। এতে রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজে জগাখিচুড়ি বাধবে। ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, তিতাসসহ অনেক সরকারি সেবা সংস্থাকে ডিসিসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। তাদেরও বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। কারণ রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির জন্য তাদের দুটি করপোরেশন থেকেই অনুমতি নিতে হতে পারে। ফলে উন্নয়নকাজে স্থবিরতার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ছাড়া মূল নগর ভবন কোন করপোরেশনের আওতায় যাবে সে ব্যাপারেও কেউ কিছু বলতে পারছেন না। যদিও শোনা যাচ্ছে, বনানীর ডিসিসি কমিউনিটি সেন্টারে হবে উত্তর সিটি করপোরেশনের কার্যালয়। গুলশান এভিনিউয়ে অবস্থিত মেয়রের বর্তমান বাসভবনও পাবেন উত্তরের মেয়র। সে ক্ষেত্রে দক্ষিণের মেয়রের বাসভবন কোথায় হবে তাও এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়।
আবার ডিসিসির বিদ্যমান জনবলের কে কোথায় যাবে, তাদের ভবিষ্যৎ পদবি কী হবে_এসব নিয়ে ধোঁয়াশায় আছেন ডিসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ডিসিসির সম্পদের বণ্টন কিভাবে হবে সেটাও পরিষ্কার নয়। এসব নিয়ে ভবিষ্যতে নানামুখী জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ জন্য অনেকে মনে করেন, একক করপোরেশন পদ্ধতি বহাল রেখে ডিসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়কে আরো শক্তিশালী করলে তা ফলপ্রসূ হতো।
বর্তমানে ডিসিসির ৯০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ২৮ জন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। তাঁরাও এ বিভাজন মেনে নিতে পারছেন না। এ ছাড়া সংরক্ষিত ৩০ জন মহিলা কাউন্সিলরের কেউই বিভাজনের পক্ষে নন। তাঁরা বর্তমান করপোরেশনকে অবিভক্ত রাখার দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী আবুল বাশারকে আহ্বায়ক করে ইতিমধ্যে একটি কমিটি হয়েছে। তাঁরা স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার। কাজী আবুল বাশার বলেন, 'সরকারের এ সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। ঢাকাকে যাতে দুই ভাগ করা না হয় সে জন্য সরকারকে বোঝাতে হবে।' আওয়ামী লীগ সমর্থিত ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির বলেন, 'ডিসিসি দুই ভাগ হলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে অন্য অনেক জটিলতা।'
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলেন, করপোরেশন বিভক্ত হলে ব্যয়ও বাড়বে অনেক। এটা বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো অবস্থা তৈরি করবে। অথচ সংসদের একাদশ অধিবেশনেই সিটি করপোরেশন বিভক্তি বিল উত্থাপিত হতে পারে। এমনকি চলতি অধিবেশনেই সেটা পাস হতে পারে বলেও জানা গেছে।
তবে মহাজোট সরকারের অন্যতম শরিক দল আওয়ামী লীগ নেতারা এতসব প্রতিবন্ধকতার শঙ্কা আমলে নিতে নারাজ। আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, 'নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য অবশ্যই ডিসিসির বিভক্তি প্রয়োজন। মন্ত্রিপরিষদ জনগণের স্বার্থেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ঢাকা মহানগরীর লোকসংখ্যা ও আয়তন অনেক বেড়েছে। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনগণের চাহিদা মেটানোর স্বার্থে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, 'সরকার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ আপনারা সবাই স্বীকার করবেন, ডিসিসি জনসেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।'

No comments

Powered by Blogger.