টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে বিলম্বিত খবর এবং আমাদের কর্তব্য by ম. ইনামুল হক

টিপাইমুখ ড্যাম ১৬৩ মিটার উঁচু হবে, যা পশ্চিম মণিপুরের বরাক ও ইরাং নদী এবং উত্তর মিজোরামের টিপাই নদীর প্রবাহপথে ৩১ হাজার ১০০ হেক্টর আবাদি জমি জলমগ্ন করবে। এর ফলে পশ্চিম মণিপুরের হমার ও জেলিয়াংগ্রং নাগা এবং উত্তর মিজোরামের কুকিসহ বিপুল আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হয়ে যাবে। এই জলমগ্নতার কারণে গাছপালাসহ প্রাণী ও পরিবেশের প্রভূত ক্ষতি হবে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা ভারতের বরাক নদীর অববাহিকার মাছসহ


জলজ প্রাণীর প্রজনন প্রক্রিয়া প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হবে


বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় গতকাল সংবাদ প্রকাশিত হলো, ভারত বাংলাদেশকে না জানিয়েই টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। একটি দৈনিকে বলা হয়েছে, \\\\'এই ধরনের চুক্তি করার আগে বাংলাদেশকে জানানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা মানেনি ভারত\\\\' (প্রথম আলো ১৯.১১.২০১১)। অভিযোগটি আংশিক সত্য। আসলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১০ সালের ১০-১২ জানুয়ারি দিলি্ল সফরের সময় যে ৫১ দফা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার ৩১ দফায় বলা আছে, The Prime Minister of India reiterated the assurance that India would not take steps on the Tipaimukh project that would adversely impact Bangladesh এর পর ২৪ এপ্রিল ২০১০ টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্পের জন্যNational Hydroelectric Power Corporation Limited 69%, Sutlej Jal Viddyut Nigam Limited ) ২৬%, মণিপুর সরকার ৫% অংশীদারিত্বের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয় (hmar.in/news ১০ মে ২০১০)। ২০১১ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দু\\\\'দিনের সফরে বাংলাদেশ এলে ৬৫ দফার যৌথ বিবৃতি স্বাক্ষরিত হয়, যার ২১ দফায় বলা আছে, ঞযব চৎরসব গরহরংঃবৎ ড়ভ ওহফরধ ৎবরঃবৎধঃবফ ঃযব ধংংঁৎধহপব ঃযধঃ ওহফরধ ড়িঁষফ হড়ঃ ঃধশব ংঃবঢ়ং ড়হ ঃযব ঞরঢ়ধরসঁশয ঢ়ৎড়লবপঃ ঃযধঃ ড়িঁষফ ধফাবৎংবষু রসঢ়ধপঃ ইধহমষধফবংয. এ দুটি বিবৃতিতেই কোনো চুক্তি করার সময় বাংলাদেশকে জানানোর ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। সম্ভবত তাই যখন গত ২২ অক্টোবর ঘধঃরড়হধষ ঐুফৎড়বষবপঃৎরপ চড়বিৎ ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরড়হ খরসরঃবফ ৬৯%, ঝঁঃষবল ঔধষ ঠরফফুঁঃ ঘরমধস খরসরঃবফ ২৬%, মণিপুর সরকার ৫% অংশীদারিত্বে একটি বিনিয়োগ চুক্তি করে; বাংলাদেশ সরকারের কিছুই বলার বা করার ছিল না। বিসিসির বরাত দিয়ে আমাদের কাছে সংবাদটি প্রায় এক মাস পরে এসে পেঁৗছেছে। ঘটনাটি ঘটেছে একান।ে কারণ এই ড্যাম নির্মাণ নিয়ে মণিপুরে প্রচণ্ড অসন্তোষ বিরাজ করছে। মণিপুর সরকার যে চাপের মুখে এতে স্বাক্ষর দিয়েছে_ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারত সরকার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানার প্রায় ২০০ কিলোমিটার উজানে বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখের ভাটিতে একটি ড্যাম নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সঙ্গে তারা এর ভাটিতে বাংলাদেশের সীমানার প্রায় ১০০ কিলোমিটার উজানে ফুলেরতালে বরাক নদীর ওপর একটি ব্যারাজও নির্মাণ করবে। ভারতের এই উদ্যোগ মণিপুর, মিজোরাম ও কাছাড় এবং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ ও পরিবেশের জন্য সমূহ ক্ষতিকর। কারণ টিপাইমুখ ড্যাম ১৬৩ মিটার উঁচু হবে, যা পশ্চিম মণিপুরের বরাক ও ইরাং নদী এবং উত্তর মিজোরামের টিপাই নদীর প্রবাহপথে ৩১ হাজার ১০০ হেক্টর আবাদি জমি জলমগ্ন করবে। এর ফলে পশ্চিম মণিপুরের হমার ও জেলিয়াংগ্রং নাগা এবং উত্তর মিজোরামের কুকিসহ বিপুল আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হয়ে যাবে। এই জলমগ্নতার কারণে গাছপালাসহ প্রাণী ও পরিবেশের প্রভূত ক্ষতি হবে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা ভারতের বরাক নদীর অববাহিকার মাছসহ জলজ প্রাণীদের প্রজনন প্রক্রিয়া প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হবে।
টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্প মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিধায় মণিপুর, মিজোরাম ও আসামের সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে মানবাধিকার কর্মীরা এর তীব্র বিরোধিতা করছেন (hmar.in/news ১০ মে ২০১০)। তারা বলছেন, টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্পের বেলায় World Commission on Dams -এর নীতিমালা মানা হচ্ছে না, যেখানে কোনো ড্যাম নির্মাণের বেলায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর খোলা মতামত নেওয়ার কথা বলা আছে। তারা এনএইচপিসির সমালোচনা করে বলেন, এই সংস্থা মধ্যপ্রদেশের ইন্দিরা সাগর ও ওমকারেশ্বর, হিমাচল প্রদেশের চামেরা ১ ও ২, মণিপুরের লোকতাক, ঝাড়খণ্ডের কোয়েল কারো, অরুণাচল প্রদেশের নিম্ন সুবনসিঁড়ি ইত্যাদি প্রকল্পে বাস্তুচ্যুত মানুষের যথাযথ পুনর্বাসন করেনি, পরিবেশ ধ্বংস করেছে এবং প্রয়োজনাতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় করে জনগণের ভোগান্তি বাড়িয়েছে।
আমরা বাংলাদেশের সচেতন জনগণের পক্ষ থেকে মণিপুর, আসাম ও মিজোরামের জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এই প্রকল্পের তীব্র বিরোধিতা করে আসছি। ভারত সরকার ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের বেলায়ও একই আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু পরে তা বাংলাদেশের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়। ভারত সরকার এখন বরাক অববাহিকার মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এই প্রকল্পটি নির্মাণের জন্য অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বরাক অববাহিকার শিলচর জেলার মানুষকে এই বলে পক্ষে আনা হয়েছে যে, টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ করা হলে তাদের এলাকায় বন্যা প্রতিরোধ করা যাবে। ভারত সরকারের এই দাবি অসত্য। কারণ পশ্চিমবঙ্গের দামোদর নদ উপত্যকায় বন্যা প্রতিরোধের জন্য একই ধরনের এ্রকটি প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পে পাঞ্চেৎ, বরাকর, তিলাইয়া, মাইথন নামক স্থানে ড্যাম নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু যখন অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত হয় তখন এই প্রকল্পের ড্যামগুলো ছাপিয়ে বন্যার পানি বর্ধমান, নদীয়া, হুগলি ও হাওড়া জেলা প্লাবিত করে। চলতি ২০১১ সালের বিগত বর্ষা মৌসুমে একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের ওই সব জেলায় ভয়াবহ বন্যা হয়েছে।
টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও মতভেদ আছে। তাদের একদল বলেন, টিপাইমুখ ড্যাম হলে বাংলাদেশের উপকার হবে। কারণ টিপাইমুখ ড্যাম বরাক নদীর প্রবাহ রোধ করে জলাধার নির্মাণ এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টারবাইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় হারে জল ছাড়বে। এর ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রিত হবে এবং শুষ্ক মৌসুমে ড্যাম থেকে ছাড়া পানি বাংলাদেশের নদীগুলোতে থাকবে। অন্য দলটির এখানেই আপত্তি। কারণ এর ফলে বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত উঁচু সমতায় থাকবে এবং সিলেট বিভাগের একফসলি বোরো ধানের জমিগুলো জেগে উঠবে না। এতে আমরা প্রতি বছর প্রায় ১০০০ কোটি টাকার বোরো ফসল থেকে বঞ্চিত হব। লখীপুর শহরের উজানে ফুলেরতালে ব্যারাজ নির্মাণ করে বরাক নদীর পানির একটা বড় অংশ সেচের জন্য প্রত্যাহার করলে ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী অববাহিকার সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল খরায় পতিত হবে।
বাংলাদেশের টিপাইমুখপন্থি বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারত আসলে ফুলেরতাল ব্যারাজ করবে না। ফুলেরতাল ব্যারাজ না করলেও ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত খরা ও বর্ষার প্রারম্ভে ভাটিতে কোনো প্রবাহ আসার সম্ভাবনা নেই। ভারত সিকিমে ইতিমধ্যে ৫০টিরও বেশি লো ফ্লো ড্যাম নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে, যেগুলোতে নদীর তলানি প্রবাহ ধরে রেখে ড্যামে মজুদ করা হবে। এসবের বেশ কয়েকটি ইতিমধ্যে নির্মিত হওয়ায় তিস্তা নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। তাই ভারত যা-ই বলুক, টিপাইমুখ প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য যখন জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, তখন ড্যাম পরিচালনার সময় যতটুকু সম্ভব পানি আটকে রেখে উঁচু চাপে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনই তাদের লক্ষ্য হবে। সে ক্ষেত্রে শুষ্ক মৌসুমের সময় তারা নদীর তলানি প্রবাহ ধরে রাখবে ও বর্ষার সময় জলাধার পূর্ণ করে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ঘঐচঈ ও ঝঔঠঘ ৯৫% বিদ্যুৎ নিয়ে যাবে; মণিপুরের জনগণ বাস্তুচ্যুত হবে; কাছাড়ের জনগণ বন্যামুক্ত হবে না; বাংলাদেশের জনগণ ১০০০ কোটি টাকার ফসল থেকে বঞ্চিত হবে।

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক :সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ও কলাম লেখক
minamul@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.