হরতাল-অসহায়ত্বের দিন! by মিনার মাহমুদ

রাজনীতি নাকি বোঝার গভীরতা থেকেও গভীরতর। ক্ষমতাসীন একটি সরকার কেন পারে না 'জনবিরোধী' এই হরতাল প্রথাকে কঠোর আইন দিয়ে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিতে? নাকি ভবিষ্যতে নিজেদের প্রয়োজনেও অব্যাহত রাখা এই অভিশপ্ত হরতাল! প্রতিবাদ জানানোর বিকল্প পল্গাটফর্ম হয়েছে এখন মিডিয়া। যদিও জাতীয় সংসদের মতো মুখোমুখি এবং তাৎক্ষণিক নয়। জাতীয় রাজনীতির যা কিছু চলমানতা_ সবই পেয়ে যাই আমরা মিডিয়ায়।


পরিভাষায় কখনও যা সাধারণ ভব্যতা অতিক্রান্ত। তবুও তো রাজনীতি আছে আমাদের চলমান জীবনেগণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আছে জাতিসংঘের খাতাপত্রে। আছে দেশের রাজনীতিতে 'বাক্য গঠনের' অমোঘ শব্দ হিসেবে। দেশটির আছে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব। আছে একটি পবিত্র সংবিধান (মাস্টার টেইলর কর্তৃক কাটছাঁট হলেও) যেটি আবার রাস্তায় ছোড়াছুড়ি হয় জাতীয় রাজনীতির ক্রোধে।
হরতালের মতো কার্যকর একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার ক্রমাগত অপব্যবহারে এখন জীবনযাপনে চরম এক দুর্ভোগের দিন। আর বাস্তবতায় সরকারি কর্মকাণ্ড হরতালের দিন চলে স্বাভাবিকের চাইতে দ্রুতগতিতে (ট্রাফিক কম থাকায়)। কারও আবার বোনাস ছুটি! অন্যদিকে হরতাল আহ্বানকারী বিরোধীদলীয় নেতারা রাস্তায় পিকেটিং করেন (আহ! কতদিন পর ট্রাফিকবিহীন জনপথ!)। রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে টুকটাক, চলন্ত পাবলিক পরিবহনের দিকে ঢিল, ভাংচুর, গ্রেফতার। ভারি বয়সী বিরোধীদলীয় নেতারা রাতেই থানা থেকে খালাস। গ্রেফতারকৃত লাঠিয়াল কর্মীদের জন্য লাগে কিছু তদবির, টাকা আর সময়। সব যেন রুটিন কাজ। কোনো কোনো হরতালের দিন পুলিশ বাধা দেয় যুদ্ধ ময়দানের মতো। আবার কখনও বিরোধীদলীয় ওয়ানম্যান হিরোইজম। সংসদ সদস্য জয়নাল আবদিন ফারুক বনাম পুলিশ সম্প্রতি এমন একটি উদাহরণ। সাংসদ হিসেবে তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয়। কিন্তু হরতালের সেদিন মারাত্মক উত্তেজিত তিনি। দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে তার উত্তেজনা খুবই প্রাসঙ্গিক, এবং এ জন্য জায়গা_ সংসদ, পল্টন ময়দান, প্রেস ক্লাব অথবা অজস্র প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাইক। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে গণতন্ত্র নিয়ে কী কথা? কিছুক্ষণ পরপর নিজের হাতে কুড়িয়ে নেওয়া ঢিল দিয়ে চলন্ত বাসের জানালায়, বিপুল ক্রোধে। বাসের ভেতরে বসা যাত্রীদের একজন তার ভোটদাতাও থাকতে পারেন। রাজনীতির পরিভাষা এমন যদি, এসব হরতাল মহড়া না করে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা কেন নয়? আজব রাজনীতি! হরতাল-পিকেটিং করে শত শত যানবাহন জ্বালিয়ে দেওয়া। নিজেদের টাকায় কেনা দেশীয় সম্পদ ধ্বংস_ এ কেমন রাজনীতি? পরবর্তী খবরে আরও জানা যায়, দলের ডাকা হরতালের দিন, জনাব ফারুকের পোশাক কারখানাটি পূর্ণ উদ্যমে উৎপাদন চালিয়ে গেছে। হরতাল হবে দেশে, নিজের ব্যবসায় কেন?
হরতাল ডাকা এখন আড়মোড়া ভাঙার মতোই। কিছুই করতে হয় না। অথচ নিকট অতীতে, হরতাল ডাকলে ঘুম হারাম। শহরের সব দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রেস রিলিজ, ছাপানোর জন্য তদবির, ৭-৮ দিন লিফলেট বিতরণ, মাইকিং, জনসংযোগ। কত্তো কাজ! আর এখনকার হরতাল_ শুরু অনায়াসে। ডাক দিলেই চলে আসে 'প্রেস-কনফারেন্স' বিটের সাংবাদিক বহর। ১২-১৩টি টিভি ক্যামেরা। নিজের বিশাল ড্রয়িংরুমে অন্য নেতাকর্মীদের সামনে আহ্বান করা হয় আসন্ন কোনো শুভ (!) হরতাল। এরপর হরতাল প্রচার নিয়ে আর কিছুই করতে হয় না। টিভি মিডিয়ায় তখনি প্রচার হয়ে যাবে পরবর্তী হরতাল তারিখ। প্রতিবারের খবরে জীবন্ত আবারও সেই হরতাল। পর্দার নিচে চলমান মুদ্রিত খবর। বিকেলের ভেতর সমগ্র দেশে প্রচারিত হয়ে যায় হরতালের কথা। পরদিন প্রকাশিত দৈনিকগুলোতে আসবে হরতালের 'লিখিত' খবর। হরতাল আইনের দলিল যেন। আর কিছু দরকার নেই! রাজনীতির পরিচয়ে গুটিকতক মানুষের ডাকা আসন্ন সেই হরতাল নিয়ে দেশের বাকি সব মানুষের সামনে নারকীয় এক কষ্টের দিন এগিয়ে আসতে থাকে। অথচ এই মানুষদের অনাগত শুভদিনের হাতছানি দিয়েই বিরোধী দল ডাকে হরতাল। শেষ হয় সরকারের পালা। ক্ষমতায় আসে হরতাল ডাকা সেই বিরোধী দল। মানুষকে আবার ক্রমাগত স্বপ্ন দেখিয়ে যাওয়া। স্বপ্নের কথা বলে একই না রাখা। ধারা চলে অব্যাহত।
হরতাল শেষে, 'দেশের মানুষকে মুক্ত করতে ডাকা হরতাল' নিয়ে সাধারণ মানুষের কথা শোনা যায় টিভিতে, সরাসরি রাজপথ থেকে প্রচারিত খবরে। প্রতিটি মানুষ হরতালের বিপক্ষে তাদের অসহায় যন্ত্রণার কথা বলেন। ঠিক একই সময়ে হরতালের সাফল্যে গর্বিত বিরোধী দলের নেতা টিভি ক্যামেরার সামনে বলেন :জনগণই নিজেদের ইচ্ছায় হরতাল পালন করেছে এবং এর অর্থই হলো সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। স্বেচ্ছায় হরতাল পালন করল তাহলে কোন জনগণ?
রাজনীতি নাকি বোঝার গভীরতা থেকেও গভীরতর। ক্ষমতাসীন একটি সরকার কেন পারে না 'জনবিরোধী' এই হরতাল প্রথাকে কঠোর আইন দিয়ে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিতে? নাকি ভবিষ্যতে নিজেদের প্রয়োজনেও অব্যাহত রাখা এই অভিশপ্ত হরতাল! প্রতিবাদ জানানোর বিকল্প পল্গাটফর্ম হয়েছে এখন মিডিয়া। যদিও জাতীয় সংসদের মতো মুখোমুখি এবং তাৎক্ষণিক নয়। জাতীয় রাজনীতির যা কিছু চলমানতা_ সবই পেয়ে যাই আমরা মিডিয়ায়। পরিভাষায় কখনও যা সাধারণ ভব্যতা অতিক্রান্ত। তবুও তো রাজনীতি আছে আমাদের চলমান জীবনে। লুই কানের নকশায় নির্মিত জাতীয় সংসদ ভবন_ গরিব দেশের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত জাতীয় সংসদে একতরফা সরকারি দল। গত ২১ বছরে দু'বার বিএনপি এবং বর্তমানসহ আওয়ামী লীগও দু'বার চলছে। দল দুটোর রাজনীতি ভিন্ন হলেও, ক্ষমতায় এবং বিরোধীদলীয় আচরণে প্রায় একই রকম। নিজেদের দলগত স্বার্থেই হরতালের মতো জনবিরোধী একটি প্রথাকে বাতিল করতে দল দুটো একমত হতে পারে। আর রাজনীতিবিদদের ভাষণ অনুযায়ী, জনগণের মঙ্গলের কথা যদি বিবেচনা করা হয়, কোটি কোটি মানুষের জন্য হরতাল এক 'অসহায়ত্ব'র দিন। আর আছে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি।
ছিঃ! হরতাল।

মিনার মাহমুদ : সাংবাদিক ও
কলাম লেখক
minar.mahmood@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.