ঐতিহ্য-শাঁখা আছে, নেই সুদিন by রফিকুল ইসলাম,

ছর কয়েক আগেও শাঁখা তৈরির জন্য শঙ্খ (সমুদ্রের শামুক) কাটতে কেবল হাত এবং সাবেক আমলের যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো। যুগের পরিবর্তনে এখন সেখানে যোগ হয়েছে বিদুৎচালিত যন্ত্র। এই যন্ত্র দিয়ে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার শাঁখারিপাড়ার শাঁখারিরা এখন শঙ্খ কাটাসহ শাঁখা তৈরির প্রধান কাজগুলো করে থাকেন। রাতদিন এই যন্ত্রের আওয়াজই জানিয়ে দেয়, এটি একটি শিল্পপল্লী।


কাজের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এলেও এই শিল্পপল্লীকে যাঁরা দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছেন, সেই শাঁখারিরা এখন তেমন ভালো নেই। যুগ যুগ ধরে বাপ-দাদার চালিয়ে যাওয়া পেশাকে টিকিয়ে রেখে কোনোমতে জীবন চলছে শাঁখারিপাড়ার শতাধিক শাঁখারি পরিবারের সদস্যদের। তাঁদের দাবি, আগের চেয়ে ব্যবসা বেড়েছে। কিন্তু সেই হারে লাভ বাড়েনি। বরং আগের তুলনায় খরচ বেড়েছে। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের, এর ওপর বেড়েছে শঙ্খসহ শাঁখা তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদানের দামও। ফলে এখন দ্বিগুণ টাকা বিনিয়োগ করেও আগের মতো লাভ হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু শ্রমের মজুরিটাই পকেটে ঢুকছে। আবার কোনো সময় পুলিশের থাবায় সেই টাকাও খোয়াতে হচ্ছে। নাটোরের জিরআরপি থানার পুলিশ অথবা থানার পুলিশ তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে বলে অভিযোগ করেছেন শাঁখা ব্যবসায়ীরা।
নাটোর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নে অবস্থিত শাঁখারিপাড়া গ্রাম। সম্প্রতি এই গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পাড়ায় ঢুকতেই হাতের ডানে একটি আধা পাকা বাড়ি। বাড়ির বারান্দায় বসে মোটরচালিত শাঁখা কাটার মেশিনে কুটো শঙ্খ (যেগুলো দুটি জোড়া দিয়ে একটি শাঁখা তৈরি করা হয়) কেটে সাইজ করছিলেন প্রায় ৭০ বছর বয়সী কার্তিক চন্দ্র ধর। বাড়ির আরেক বারন্দায় বসে কুটো শাঁখা এক ধরনের আঠা ও পাউডার
দিয়ে জোড়া লাগানোর কাজ করছিলেন তাঁর স্ত্রী উৎপলা রানী (৬৫)।
কেমন আছেন জানতে চাইলে কার্তিক চন্দ্র ধর বলেন, 'এই তো ভালো আছি। কী আর করা, বাপ-দাদার রেখে যাওয়া পেশাটা এই বয়সেও ধরে রেখেছি।'
কার্তিক চন্দ্র জানান, প্রায় ৪৪ বছর ধরে তিনি এই পেশায় নিয়োজিত আছেন। আগে লাভ ভালো হতো। সেই লাভের টাকা দিয়ে একমাত্র ছেলেকে তিনি উচ্চশিক্ষিত করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন একমাত্র মেয়েকেও। ছেলে এখন একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা। ছেলে এই বয়সে মা-বাবাকে আর শাঁখা তৈরির কাজ না করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু বসে থাকার চেয়ে দুটি পয়সা এলে ক্ষতি কি? এমনটা ভেবেই তাঁরা স্বামী-স্ত্রী এখনো শাঁখা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন।
কার্তিক চন্দ্র ধর আরো জানান, তাঁর বাবা মৃত ধীরেশ চন্দ্র ধর, দাদা মৃত বৃন্দাবন চন্দ্র ধরও এই পেশায় জড়িত ছিলেন। এভাবে বংশপরম্পরায় ব্রিটিশ আমল থেকেই শাঁখা বানিয়া (শাঁখা তৈরিকারক) পেশাটি তাঁরা ধরে রেখেছেন। শাঁখা বানিয়ারা ভারতের মাদ্রাজ থেকে ব্যবসা করার জন্য এ দেশে আসেন বলেও তিনি জানান।
তিনি আরো জানান, ব্রিটিশ আমলে কলকাতা থেকে শাঁখা তৈরির জন্য শঙ্খ আমদানি করা হতো। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারত পূর্ব বাংলায় শঙ্খ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এর পর থেকে শাঁখা তৈরির জন্য শঙ্খ আমদানি করা হচ্ছে শ্রীলঙ্কা থেকে। বর্তমানে ভারতও শ্রীলঙ্কা থেকে শঙ্খ আমদানি শুরু করায় এর দাম এবং চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ফলে অনেক সময়ই আমদানিকারকরা সময়মতো শঙ্খ আনতে পারেন না। ফলে শঙ্খের অভাবে কোনো কোনো সময় কাজ বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকতেও হয় শাঁখারিপাড়ার শাঁখারিদের।
কার্তিক চন্দ্র ধর জানান, শাঁখারিপাড়ায় শতাধিক পরিবার বসবাস করে। এই পরিবারগুলোর সবই শাঁখা তৈরি অথবা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের শাঁখারি বলে ডাকা হয়। গ্রামের নামটিও শাঁখারিপাড়া হয়েছে তাঁদের সুবাদেই।
গত সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, শাঁখারিপাড়া গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই চলছে শাঁখা তৈরির কাজ। এমন কোনো বাড়ি নেই, যে বাড়ির সদস্যরা এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়নি। নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরীরা শাঁখা তৈরির কাজে সম্পৃক্ত। শঙ্খ কাটা থেকে শুরু করে ডিজাইন করা, পলিশ করা, রং করা, আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো, রোদে শুকানো, ফিনিশিং দেওয়া, এমনকি বিক্রি করার কাজও করে থাকেন তাঁরা। যারা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী তারাও হাতখরচের টাকা উপার্জন অথবা মা-বাবাকে সাহায্য করার জন্য সময় পেলেই কাজে নেমে পড়ে বলে জানিয়েছেন গ্রামের শাঁখারিরা।
জানা গেছে, গ্রামের শাঁখারিদের মধ্যে পল্টন নামে এক ব্যক্তির শঙ্খ আমদানির লাইসেন্স আছে। তিনিই শ্রীলঙ্কা থেকে সরাসরি শঙ্খ আমদানি করে গ্রামের শাঁখারিদের কাছে বিক্রি করেন। এ ছাড়া মানিক নামের অন্য এক ব্যবসায়ী ঢাকা অথবা খুলনা থেকে শঙ্খ পাইকারি কিনে খুচরা বিক্রি করেন। আর গ্রামের শাঁখারিরা পল্টন অথবা মানিকের কাছ থেকে কাটা শঙ্খ কিনে সেগুলো দিয়ে শাঁখা তৈরি করেন।
মানিক জানান, গোটা শঙ্খ কিনে আনার পর সেগুলোকে মেশিনে কেটে সাইজ করতে হয়। একটি ভালো শঙ্খ থেকে সর্বোচ্চ ছয় পিস গোটা শঙ্খ বের হয়। এ ছাড়া বাকি অংশ ব্যবহৃত হয় কুটো এবং উচ্ছিষ্ট হিসেবে। গোটা পিস এবং কুটো বিক্রি করা হয় গ্রামের শাঁখারিদের কাছে। উচ্ছিষ্টগুলোও বিক্রি করা হয়। এগুলো চুন তৈরি করার জন্য চুনিরা কিনে নিয়ে যান।
মানিক জানান, এক বস্তা (৭৫ পিস) ভালো শঙ্খের দাম এখন অন্তত ৪৫ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি পিসের দাম এখন প্রায় ৬০০ টাকা পড়ে। এর মধ্যে আবার কোনো কোনোটি খারাপও বের হয়, যেগুলো দিয়ে হিন্দু ধর্মের লোকদের জন্য সন্ধ্যায় বাজানো শাঁখ বানানো হয়। এগুলো এক শ থেকে বড়জোর দেড় শ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। একটি ভালো শঙ্খ থেকে অন্তত ছয় পিস গোটা শঙ্খ বের হয়, যার প্রতিটি দেড় শ থেকে দুই শ টাকা দরে বিক্রি হয়।
সীমা সেন নামের শাঁখারিপাড়ার এক নারী জানান, শঙ্খের পিস কিনে আনার পর সেগুলো মেশিনের সাহায্যে সাইজ করে নিতে হয়। এরপর সেগুলোতে রেত বা যন্ত্রের মাধ্যমে নকশা তৈরি করা হয়। নকশার পর পলিশ করা হয়। এরপর এগুলো হয়ে যায় সনাতন ধর্মাবলম্বী বিবাহিত নারীদের জীবনের অন্যতম মূল্যবান রত্ন হাতের শাঁখা। এই শাঁখাগুলো বাজারে প্রতি জোড়া তিন শ থেকে চার শ টাকায় বিক্রি হয়।
সীমা সেন আরো জানান, একজোড়া ভালো শাঁখা তৈরি করতে বেশ পরিশ্রম করতে হয়। এটিতে নকশা তৈরি করতে হয় খুব যত্ন নিয়ে। এই নকশার ওপর আবার স্বর্ণও বসানো হয়। স্বর্ণ বসানো শাঁখা বাজারে প্রতিজোড়া দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। স্বর্ণকাররা শাঁখা কিনে নিয়ে গিয়ে তাতে স্বর্ণ বসিয়ে বিক্রি করেন।
শাঁখারি কেশব চন্দ্র ধর জানান, ৫০ জোড়া ভালো শাঁখা তৈরি করতে এখন সব মিলিয়ে খরচ হচ্ছে ১৪ হাজার থেকে সাড়ে ১৪ হাজার টাকা। সেই শাঁখা বাজারে বিক্রি করে দাম পাওয়া যাচ্ছে বড়জোর ১৬ হাজার টাকা। আর এই ৫০ জোড়া শাঁখা তৈরি করতে একজন শ্রমিকের অন্তত পাঁচ দিন সময় লাগে। ফলে গড়ে প্রতিদিন দুই শ থেকে বড়জোর আড়াই শ টাকা আয় করা যায়। আর ৫০ জোড়া গুরুদক্ষিণা শাঁখা (জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা বলে এই নামে ডাকা হয়) বিক্রি হয় সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা দরে। সর্বোচ্চ চার শ থেকে পাঁচ শ টাকা লাভ হয়। একজন শ্রমিক প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ জোড়া গুরুদক্ষিণা শাঁখা তৈরি করতে পারেন। সেই হিসাবে এই শাঁখা তৈরি করে গড়ে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করা যায়। কিন্তু এই আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন বলে এখন বাড়ির অন্য সদস্যদের শাঁখা তৈরির কাজে পরিবারপ্রধানের সঙ্গে হাত লাগাতে হয়। অথচ ১০ বছর আগেও এই গ্রামের কোনো মেয়েকে শাঁখা তৈরির কাজ করতে হতো না বলে জানান একজন শাঁখারি।
নীলকমল সেন নামের অন্য এক শাঁখারি জানান, ১০ বছর আগে একজোড়া ভালো শাঁখা তৈরি করে চার-পাঁচ হাজার টাকা লাভ হতো। কিন্তু আগের মতো এই ব্যবসায় আর লাভ হয় না। রাতদিন পরিশ্রম করেও যে টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে কোনোমতে খেয়ে-পরে দিন কাটে। এর ওপর আছে পুলিশের হয়রানি।
নীলকমল অভিযোগ করেন, গত শারদীয় দুর্গাপূজার তিন দিন আগে তিনি জয়পুরহাটে শাঁখা বিক্রি করতে যান। সেখান থেকে কিছু অবিক্রীত শাঁখা নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় নাটোরে পেঁৗছার পর ট্রেনের মধ্যে থানার এক দালাল তাঁর ব্যাগ তল্লাশি শুরু করে। ওই দালাল তাঁর কাছে শঙ্খ কেনার রসিদ আছে কি না জানতে চায়। তাকে রসিদ দেখানো হলে সেটি কেড়ে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে এবং নাটোর সদর থানায় খবর দেয়। কিছুক্ষণ পরেই স্টেশনের বাইরে এনে ওই দালাল পুলিশের হাতে তাঁকে তুলে দেয়। এরপর একজন দারোগা কমলের ব্যাগে চার বোতল ফেনসিডিল ঢুকিয়ে দিয়ে থানায় নিয়ে যেতে থাকে। নাটোর সদরের ফিলিং স্টেশনের কাছে আসার পর কমলের কাছে থাকা দুই হাজার ৮০০ টাকা কেড়ে নেওয়া হয়। ফেনসিডিলগুলোও ওই দারোগা নিয়ে চলে যায়। এভাবে প্রায়ই নাটোর পুলিশ এবং রেলওয়ে পুলিশের হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করেছেন শাঁখারিরা।

No comments

Powered by Blogger.