কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ by এ এম এম শওকত আলী

৯৯৯ সালে প্রণীত কৃষিনীতিতে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান খসড়া কৃষিনীতিতেও এ বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে বা করা হবে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উলি্লখিত বিষয়টি সরাসরিভাবে উল্লেখ করা না হলেও পরোক্ষভাবে এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, মানসম্মত বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং ভেজাল বীজ ব্যবসা রোধ করতে হবে।


একটি বাংলা দৈনিকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ৬০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়েছে। এসব কৃষক কয়েকটি বেসরকারি কম্পানির নিম্নমানের হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে কোনো ফসলই ঘরে তুলতে পারেনি। এ নির্দেশ আইনসিদ্ধ না হলেও কৃষি মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিতে দ্বিধা করেনি। এ নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট কম্পানিগুলো কোনো দ্বিধা করেনি। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে এ নির্দেশ তারা পালন করে। সরকারি বা বেসরকারি বীজ প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের মনোভাব প্রর্দশন করলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকসহ প্রতিষ্ঠানেরও মঙ্গল। কৃষকরা খুব কম খরচে আবার একই ফসল চাষ করতে সক্ষম হবে। বেসরকারি বীজ প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। সরকারের তো কথাই নেই। বেসরকারি বীজ প্রতিষ্ঠানেরও ব্যবসা ভালো হবে।
হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। প্রথমে ধান বীজের জন্য এবং পরবর্তী সময়ে সবজি বীজ আমদানি বেসরকারি খাতেই করা হয়। এর জন্য ১৯৯৩ সালের বীজনীতির আওতায় কৃষি মন্ত্রণালয় ১৯৯৮ সালে আমদানির অনুমতি প্রদান করে; তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে। প্রধান শর্ত ছিল আমদানি করার সময়সীমা হবে সর্বমোট তিন বছর। এ সময়ের মধ্যেই বেসরকারি বীজ কম্পানিগুলো এ দেশেই হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করবে। এটা তারা করতে পারেনি। প্রধান কারণ, গবেষণার জন্য দক্ষ বিজ্ঞানী ছিল না। এখনো যে রয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। বিষয়টি সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। তবে এ দেশের বৃহত্তম এনজিও এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে ব্র্যাক একাধিক জাতের হাইব্রিড ধান বীজ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। সরকারি খাতে বিএডিসি ও ব্রি কয়েকটি জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের কাছে এটা জনপ্রিয় হয়েছে কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
২০০৩ সালে হাইব্রিড ধান বীজ আমদানির সময়সীমা বৃদ্ধি করে সর্বমোট পাঁচ বছর করা হয়। এ সীমা শেষ। এখন সময় এসেছে মাঠপর্যায়ে মূল্যায়নের। কৃষি মন্ত্রণালয় ২০০৩ এবং পরে ২০০৭ সালে হাইব্রিড ধান উৎপাদন বা আমদানি এবং মূল্যায়নের জন্য পদ্ধতি প্রণয়ন বা তা গেজেট প্রকাশ করে। এ পদ্ধতি সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা আবশ্যক। মূল লক্ষ্য হবে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ। প্রকাশিত নিম্নমানের বীজ ব্যবহার ও কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াই এর মূল ভিত্তি। ১৯৯৮ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর মূলত চীন ও ভারত থেকে হাইব্রিড এফ১ (F1) বীজ আমদানি করা হয়। বীজ উৎপাদন শাস্ত্রে এফ১ (F1)-এর অর্থ ফাউন্ডেশন (Foundation Seed) বা ভিত্তি বীজ। নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্ভাবিত ব্রিডার বীজ থেকেই ভিত্তি বীজ ও পরে প্রত্যায়িত বীজ (Certified Seed) উৎপাদনের কথা। এ কারণে ২০০৭ সালের আমদানির শর্তে এফ১-এর পরিবর্তে এ লাইন ও আর লাইন আমদানি বাধ্যতামূলক করা হয়। অন্যথায় কম্পানির নিবন্ধন বাতিলযোগ্য। এ শর্ত সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কি না সে বিষয়টিও নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।
সম্প্রতি এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী বিগত ৯ বছরে হাইব্রিড ধান চাষের এলাকা প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ ২০০৭-০৮ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি পেলেও ২০০৮-০৯ সালে এর ব্যাপকতা হ্রাস পায় এবং ২০০৯-১০ সালে প্রায় ৩৪ শতাংশ হ্রাস পায়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে বৃদ্ধির বিষয়টির মূল কারণ অন্তত কম ভিত্তি নিয়ে এর চাষ শুরু হয়। ১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৮৫টি হাইব্রিড ধান বীজ বাজারজাত করার অনুমতি পায়। এর মধ্যে ৭৭টি আমদানি করা বীজ। আমদানি করা বীজের ৬৬টি চীন, আটটি ভারত এবং একটি ফিলিপাইন থেকে আমদানি করা হয়। ২০১০ পর্যন্ত ৪৪টি প্রতিষ্ঠান দেশে হাইব্রিড ধান বীজ উৎপাদনের জন্য গবেষণা শুরু করে। এর মধ্যে ৪০টি বেসরকারি, দুটি এনজিও এবং বাকি দুটি ব্রি ও বিএডিসি। এ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, হাইব্রিড বীজ আমদানি, উৎপাদন ও বিপণনে বেসরকারি খাতই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চীন থেকে বর্তমানে আমদানিকৃত এ লাইন ও আর লাইন নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে গুণগত মান নিয়ে। তবে এ প্রশ্ন ব্রি কর্তৃক উদ্ভাবিত বীজ সম্পর্কেও উত্থাপিত হয়েছে। বলা হয়েছে, হাইব্রিড ধান-২ ২০০৯-১০ সালে খুব একটা সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্রিসহ ব্র্যাক ও কয়েকটি বেসরকারি বীজ কম্পানি এফ১ বীজ দেশেই উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এ কাজে তারা অর্জিত অভিজ্ঞতা ও চায়নিজ বিশেষজ্ঞদের সহায়তা ব্যবহার করেছে। উলি্লখিত সমীক্ষায় হাইব্রিড ধান উৎপাদনের ব্যবহার ও মাত্রা বৃদ্ধির জন্য কয়েকটি নীতিসংক্রান্ত সুপারিশ করা হয়। এক. চাহিদানির্ভর হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করা। অর্থাৎ কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনে সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। দুই. উৎপাদিত চালের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। তিন. সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করতে হবে। চার. বীজের গুণগত মান নিবিড় পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। পাঁচ. হাইব্রিড ধান-চালকে সরকারি সংগ্রহের আওতায় আনতে হবে। ছয়. বিদ্যমান বীজসংক্রান্ত আইনি ও বিধিগত কাঠামোর পরিবর্তনে চাহিদানির্ভর বীজ উৎপাদন ও বিপণনের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। কৃষকদের চাহিদানির্ভর বীজের উৎপাদন ও বিপণনের বিষয়টি সব উপকরণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বীজের ক্ষেত্রে এ লক্ষ্য অর্জন অত সহজ নয়। এর মূল কারণ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
বীজ বিপণনব্যবস্থা বিশ্বের সব উন্নয়নশীল দেশেই দুই ভাগে বিভক্ত। এক. প্রাতিষ্ঠানিক ও দুই. অপ্রাতিষ্ঠানিক। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রের জন্য বর্তমানে বিএডিসিসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও রয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শেষোক্ত ক্ষেত্রই অধিকতর বীজ উৎপাদন ও বিপণন করে থাকে। সাধারণ অর্থে বলা হয়, কৃষক-পর্যায়েই সিংহভাগ বীজ বিনিময় করা হয়। তবে হাইব্রিড বীজ একবার ব্যবহার করে দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এ কারণেই বেসরকারি খাতের এ বীজ উৎপাদন ও বিপণনে অধিকতর আগ্রহ। অন্যদিকে ইনব্রেড বীজ অর্থাৎ উচ্চফলনশীল বীজ (উফশী) একবার ব্যবহার করে বেশ কয়েক বছর কৃষকরা নিজেই উৎপাদিত ধানের কিছু অংশ বীজ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য সযত্নে সংরক্ষণ করেন। অন্যদিকে বিএডিসি কর্তৃক এ ধরনের বীজ সহনীয় মূল্যে বিপণন করা। এর জন্য নীতিনির্ধারকরা মূলত বিদেশি, সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করার কথা জোর দিয়ে বলেন। অথচ সরকারের অনুসৃত নীতি অনুযায়ী কৃষি উপকরণের জন্য ভর্তুকি প্রদানের নীতি অব্যাহত রাখা হবে।
হাইব্রিড বীজের এলাকার আয়তন নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, এ বীজের ব্যবহারের ব্যাপ্তি প্রায় ১০ লাখ হেক্টর। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতে, মোট এলাকা আট লাখ হেক্টরের বেশি নয়। এর মধ্যে সর্বমোট বোরো এলাকার শতকরা ২২ ভাগ জমিতে এ বীজ ব্যবহৃত হয়। আমনে এর মাত্রা মাত্র শতকরা ৯ ভাগ। অর্থাৎ কৃষকরা বোরো মৌসুমেই এ বীজ অধিকতর ব্যবহার করেন। হাইব্রিড বীজের প্রতি হেক্টরে গড় চাল উৎপাদন ৪.৭৫ টন। উফশীর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ৩.৮৫ টন। এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ হাইব্রিড ধানবীজের বাজারমূল্য উফশীর তুলনায় অত্যধিক। কেজিপ্রতি ১৭০ থেকে ২৪০ টাকা। অন্যদিকে উফশী বীজের কেজিপ্রতি মূল্য অনেক কম। বলা হয়, ভর্তুকির জন্য। এ যুক্তি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ কৃষকপর্যায়ে উৎপাদিত উফশী বীজের মূল্যও মোটামুটি বিএডিসির অনুরূপ। উল্লেখ্য, কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী ব্রি উফশী ব্রিডার বীজ এবং হাইব্রিড বীজের এ লাইন এবং আর লাইন কৃষকদেরও সরবরাহ করে। এ জন্য কোনো মূল্যের পার্থক্য নেই। ব্রি থেকে এ তথ্য জানা যায়।
সার্বিকভাবে হাইব্রিড বীজ বনাম উফশী বীজের কোনটা ব্যবহারে কৃষকরা অধিকতর আগ্রহী_এ বিষয়টি নির্ধারণের জন্য মাঠপর্যায়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। তবে এর ব্যবহারের মাত্রা অধিকতর করার জন্য অহেতুক আশঙ্কিত হওয়ারও কোনো কারণ নেই। নীতিবিষয়ক পদক্ষেপের জন্য সরকারি ধান-চাল সংগ্রহের সঙ্গে এর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বোধগম্য নয়। সব ধরনের চালই নির্ধারিত মানসাপেক্ষে খাদ্য বিভাগ ক্রয় করে থাকে। এ ছাড়া চাল মূলত বেসরকারি চালকল মালিকদের মাধ্যমেই ক্রয় করা হয়। কৃষকরাও সিংহভাগ ধান এদের কাছেই বিক্রি করে। সরকারি খাদ্যশস্য সংগ্রহের বিষয়টি থাকলেও অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, খাদ্য বিভাগের যৎসামান্যই ধান সংগ্রহ করে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.