শ্রদ্ধাঞ্জলি-জমিদার বৌরানি থেকে একজন মাসিমা

ট বছর বয়স থেকেই বাবা-মা বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। কালো ও হালকা ছোটখাটো গড়নের মেয়েটির বর পাওয়া তো সহজ নয়! উৎকণ্ঠায় দিন কাটে তাঁর স্বজনদের। পরিবারের উৎকণ্ঠায় তাঁর নিজের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁর খেয়াল গ্রামের রাস্তা দিয়ে গেয়ে যাওয়া বিপ্লবী গান আর মিছিলের দিকে। আট বছর বয়সেই ১৯০৫ সালে হাতে হলদে সুতোর রাখি বেঁধে ভিড়ে যান ওই গান আর মিছিলের দলে। অবশেষে ১৪ বছর বয়সে ফোটে বিয়ের ফুল।
তাও আবার একেবারে জমিদার পরিবারে। পা খুলে মিছিলে থাকা মেয়েটির জীবন আটকে যায় পালকির খোপে আর জমিদারি অন্দরে। তবে সেই জমিদার বৌরানিই আবার জমিদারি খোলস ফেলে দিনে দিনে হয়ে ওঠেন নিপীড়িত মানুষের প্রিয় 'মাসিমা'। বিপ্লবী মনোরমা বসু মাসিমা। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৮৯৭ সালের ১৮ নভেম্বর বরিশাল জেলার বানারীপাড়ার নরোত্তমপুর গ্রামে জন্ম হয় এই মহীয়সী নারীর।
সাহস ও চেতনা থেকেই জমিদার বধূ স্বামীকে বুঝিয়ে সম্মত করেন নিজের ইচ্ছাকে কাজে লাগানোর জন্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন নিজেকে। গ্রামের নিপীড়িত অসহায় নারীদের কল্যাণে গড়েন বিভিন্ন সমিতি-সংগঠন। বরিশাল শহরে গড়ে তোলেন মাতৃমন্দির। মাতৃমন্দির হয়ে ওঠে একাধারে নারীশিক্ষাকেন্দ্র ও সেবাশ্রম, যা এখন বরিশাল নগরীর ব্রাঞ্চ রোডের (প্রস্তাবিত মনোরমা বসু মাসিমা সড়ক) মাতৃমন্দির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। একদিকে রাজনৈতিকভাবে নিগৃহীত নেতা-কর্মীরা যেমন এখানে মাসিমার আশ্রয় পেতেন, তেমনি তৎকালীন কুষ্ঠরোগীদের সেবাকেন্দ্রও ছিল এই মাতৃমন্দির। রাজনৈতিকভাবে কংগ্রেস থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি-বাংলাদেশের আদর্শে নিজেকে নিবেদিত করে রাখা এই নারী জীবনে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বহুবার জেল খেটেছেন। ১৯২১-২২ সালে 'চরকা ধর-খদ্দর পর' আন্দোলনে সমিতির মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে নারীদের তিনি চরকা কাটার কাজ শেখাতে থাকেন। ১৯২৪ সালে গান্ধীজি বরিশালে এলে আন্দোলনের চাঁদা হিসেবে নিজের বিভিন্ন মূল্যবান স্বর্ণালংকার তুলে দেন গান্ধীজির হাতে। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে স্থানীয় নারীদের নিয়ে কাজ করেন মাঠে-ঘাটে। ১৯৪৮ সালে যক্ষ্মাক্রান্ত নিজ মেয়ের মৃত্যুর মাত্র ১৮ দিনের মাথায় খাদ্য আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন মাসিমা। ১৯৫২ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত কারাবাস করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে স্বামী চিন্তাহরণ বসুর মৃত্যুর কয়েক দিনের মাথায় গভর্নর শাসনের মুখে কাটাতে হয় পলাতক জীবন। এ ছাড়া দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সময় সার্বক্ষণিক স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে লঙ্গরখানায় থেকে খাদ্য-বস্ত্র ও সাহায্য সংগ্রহ করে, মেডিক্যাল টিম পরিচালনা করে বাঁচিয়ে তোলেন হাজারো দুস্থ-বুভুক্ষু নারী-পুরুষকে। সত্তরের বন্যায় দেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করে তা বিলিয়ে দিয়েছেন দুর্গতদের মাঝে। '৬২, '৬৭ ও '৬৯-এর গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিজের মতো করেই নানা প্রক্রিয়ায় কাজ করে গেছেন স্বাধীনতা অর্জনে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় বরিশাল জেলা শাখা গঠন ও কার্যক্রম পরিচালনায় পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর মৃত্যু ঘটে বিপ্লবী মনোরমা বসু মাসিমার। মাসিমা নিজের কর্মগুণে পার্টির ঊধর্ে্ব উঠে মানবতার স্বার্থে কাজ করে গেছেন আজীবন, নিজের কর্মময় জীবনকে রেখে গেছেন দলমতের ঊধর্ে্ব থাকা একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে।
তৌফিক মারুফ

No comments

Powered by Blogger.