মৃদুকণ্ঠ-প্রতিষ্ঠান সংহতকরণ প্রয়োজন by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

ণতন্ত্র কোনো বায়বীয় বিষয় নয়। গণতন্ত্র বাস্তবসম্মত একটি রাষ্ট্রশাসন প্রক্রিয়া, যা সাবলীলভাবে চলতে পারে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভিত্তি করে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংহতকরণ বলতে আমরা বুঝি, ওই সব প্রতিষ্ঠান যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য গঠিত, সেসব লক্ষ্য অর্জনে সক্ষমতা ও সফলতা। দেশের রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক-


সামাজিক সংস্থাগুলো সংহত এবং শক্তিশালী না হলে গণতন্ত্রও দুর্বল হয়ে থাকে, চলার পথে হোঁচট খেতে থাকে। অপশক্তির চাপে ভেঙেও পড়ে কখনো।
রাষ্ট্র নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে তিনটি মূল প্রতিষ্ঠানের ওপর_১. লেজিসলেচার বা সংসদ ২. অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা প্রশাসন ৩. জুডিশিয়ারি বা বিচারব্যবস্থা। সংসদ আইন প্রণয়ন করবে। প্রশাসন আইন বাস্তবায়ন করবে। বিচারব্যবস্থা বিচার করে দেখবে, রাষ্ট্রের কাজকর্ম আইনানুগভাবে চলছে কি না। তারা প্রয়োজনে আইনের ব্যাখ্যা দেবে। এই চেক অ্যান্ড ব্যালান্সব্যবস্থা ব্যক্তিশাসনের বদলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। সমন্বিত ত্রয়ী কার্যপ্রক্রিয়ায় জড়িত সব ব্যক্তি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোনো ব্যক্তিই আইনের ঊধর্ে্ব নয় অথবা আইনকে 'নিয়ন্ত্রণ' করে না; আইনই সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি একটি আদর্শ কথা। এমন আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাস্তবে রয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আদর্শটিকে একটি লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করলে কোনো কোনো রাষ্ট্র লক্ষ্যের অনেকটা কাছাকাছি, আবার কোনো কোনো রাষ্ট্র লক্ষ্যের অনেক দূরে। লক্ষ্যের কাছাকাছি অবস্থানের শর্ত হলো, রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠান তিনটির সংহত অবস্থান।
প্রতিষ্ঠান কখনো প্রক্রিয়াগতভাবে শক্তিশালী হয়ে থাকে, আবার শীর্ষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কারণে কখনো শক্তিশালী বলে মনে হয়। প্রথম ব্যবস্থায় প্রক্রিয়া এতটাই সংহত যে পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রক্রিয়া চলমান রাখেন; কখনো প্রক্রিয়ার কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন না। তেমন আলামত দেখা দিলে প্রক্রিয়াই এরূপ শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দ্বিতীয় ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াগত দুর্বলতার কারণে পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ 'কর্তৃত্ব' দখল করে ফেলেন। এ অবস্থায় প্রক্রিয়া নয়, বরং ব্যক্তিই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন। ব্যক্তি যত শক্তিশালী, প্রতিষ্ঠানটিকেও ততটাই শক্তিশালী বলে ধারণা করা হয়। এই ব্যক্তিগত শক্তি ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক সংহতি নষ্ট করে দেয় এবং প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তিনির্ভর হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে।
উদাহরণ হিসেবে কিছু সম্ভাব্য অবস্থার অবতারণা করা যায়। প্রতিনিধি পরিষদ বা জাতীয় সংসদ জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত। আমাদের দেশে বিগত সময়ে অনেক নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে সামরিক শাসনকে স্বীকৃতি প্রদান বা অপশাসন থেকে অবতরণের নির্বাচনগুলো ছিল প্রহসন। গণভোটের আবরণে প্রকৃতপক্ষে শাসকবর্গই আসন বণ্টন করত। তথাকথিত 'নির্বাচিত' সংসদ সদস্যরা জনপ্রতিনিধিত্বই অর্জন করেননি। তাঁদের সমন্বয়ে গঠিত সংসদ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হবে কিভাবে? এমন পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি পা অবশ হয়ে যায়, গণতন্ত্র খুঁড়িয়ে চলে।
কখনো আবার নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। সংসদ সদস্যরা জনপ্রতিনিধিত্ব অর্জন করেছেন। কিন্তু দলীয় অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে অনেক সদস্য সংসদে যোগদান থেকে বিরত থেকেছেন। জনগণ ভোট দিয়েছে সংসদে অংশ নেওয়ার জন্য। অথচ তাঁরা জনগণের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করে থাকেন। গণতন্ত্রের সঙ্গে এও একধরনের প্রতারণা। অনেক সদস্যের অনুপস্থিতি সংসদকে দুর্বল করে দেয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লেজিসলেচার অঙ্গটি দুর্বল হয়ে যায়। গণতন্ত্র সংহত হয় না।
জনপ্রতিনিধিত্ব সঠিক হলে এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেও অনেক সময় প্রক্রিয়া সাবলীল থাকে না। রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক আচরণের কৃষ্টি গড়ে না উঠলে নেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এবং অঙ্গুলি হেলনে দল চলে। জনপ্রতিনিধিদের সজ্ঞান, দায়িত্বশীলতা এবং স্বকীয় মহামতের ভিত্তিতে দলও চলে না, সংসদও চলে না। চলে যায় নেতার হাতে। সংসদ হয়ে ওঠে আজ্ঞাবহ। রাষ্ট্রে তখন গণতন্ত্রের লেবাসে 'গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতন্ত্র হোঁচট খায়।
এবার তাকানো যাক নির্বাহী বিভাগের দিকে। রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বম্ভ। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। তাঁকে বলা হয় 'সিনিয়র অ্যামাং মিনিস্টার্স', অর্থাৎ মন্ত্রীদের মধ্যে প্রবীণ। মন্ত্রীদের নিয়ে তিনি দেশ পরিচালনা করেন। কিন্তু মন্ত্রীদের 'বস' নন তিনি; মন্ত্রীদের প্রধান সহকর্মী। মন্ত্রিপরিষদ একটি নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। এসব নির্বাহী নির্বাচিত নন। তাঁরা পরিচালিত হন নির্বাহী বিধিবিধান দ্বারা। তাঁরা মন্ত্রীদের 'হুকুমে' চলেন না, বরং মন্ত্রীদের আইনানুগ নির্দেশনায় নির্বাহী বিধানের মাধ্যমে কাজ করেন। মন্ত্রীদের সঙ্গে নির্বাহীদের এ ধরনের সংবেদনশীল ও জটিল সম্পর্কের কৃষ্টি গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মাধ্যমে। মন্ত্রীদের গণতান্ত্রিক মানসিকতা এবং আইনের শাসনের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার না থাকলে সংবেদনশীল নির্বাহী কৃষ্টি গড়ে ওঠে না। নির্বাহীরা আজ্ঞাবহ হয়ে দাঁড়ান। রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র খুঁড়িয়ে চলতে থাকে। গণতান্ত্রিকতা ব্যাহত হয়।
এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক রাষ্ট্রের আরেকটি স্তম্ভ বিচার বিভাগের দিকে। বিচার বিভাগের সদস্য, অর্থাৎ বিচারকরাও নির্বাচিত নন। আইনের মাধ্যমে তাঁদের নিয়োগ এবং আইন দ্বারা তাঁরা পরিচালিত। আইন প্রক্রিয়া মাত্র। নিয়োগদানের স্বচ্ছতাই আইনকে অর্থবহ করে। স্বচ্ছতার অভাবে অযোগ্য লোক যদি নিয়োজিত হন, তাহলে বিচারও ত্রুটিপূর্ণ হবে। আর যদি আজ্ঞাবহ ব্যক্তি বিচারক নিয়োজিত হন, তাহলে তাঁর রায়ে বিচার প্রতিফলিত হবে না; প্রতিফলিত হবে আজ্ঞা। সুবিচার ভূলুণ্ঠিত হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শুধু আইনের মাধ্যমে অর্জন করা যায় না, আইনের সঙ্গে প্রয়োজন আইন মান্যতার কৃষ্টি এবং সৎ উদ্দেশ্য, যা মানসিকতার ওপর নির্ভরশীল এবং নিরবচ্ছিন্ন চর্চার মাধ্যমে পরিশীলিত হয়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বর্ণিত তিনটি প্রধান অঙ্গ ছাড়াও কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থাকে, যেগুলোকে বিধিবদ্ধ সংস্থা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রভৃতি। নির্বাচন কমিশন যদি স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে, তাহলেই মাত্র জনপ্রিতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে, যা গণতন্ত্রের জন্য প্রধান শর্ত। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পশ্চাৎপদতার মধ্যেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার নিদর্শন রেখেছে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভোটারদের বিপুল অংশগ্রহণ এবং নির্বাচন পরিচালনায় পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রাখাটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর পরও উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বর্তমান কমিশন প্রশংসনীয় দক্ষতা বজায় রেখেছে। কমিশনের এই ভূমিকা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকলে ১০-১৫ বছরের মধ্যে নির্বাচন কমিশন একটি সংহত প্রতিষ্ঠানে স্থায়িত্ব লাভ করবে, যা গণতন্ত্রের জন্য অতি প্রয়োজন।
জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য যেমন স্বচ্ছ ও সংহত নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন, তেমনি দক্ষ ও যোগ্য নির্বাহী বিভাগ গড়ে তোলার লক্ষ্যে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইকর্মের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ এবং সংহত কর্মকমিশন বা পাবলিক সার্ভিস কমিশন। প্রতিষ্ঠান যেমন রাষ্ট্রের স্তম্ভ, তেমনি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা হলেন প্রতিষ্ঠানের স্তম্ভ। স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রার্থী বাছাই ও নিয়োগদান করতে ব্যর্থ হলে পুরো নির্বাহী বিভাগ দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যাবে। প্রার্থী বাছাই একটি জটিল প্রক্রিয়া। কমিশনের সদস্যদের এ বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। সেই সঙ্গে হতে হবে সৎ ও বিবেকবান। শুধু আর্থিক সততাই নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক সততাও থাকতে হবে। দক্ষতায়ও ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। আমাদের কর্মকমিশনে কি তেমন ব্যক্তিদের সমাহার ঘটাতে পেরেছি?
বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলের কর্মকমিশনের একটি ঘটনা বর্ণনা করছি। ঘটনাটি ভাইভা বোর্ডে সদস্য ছিলেন, এমন একজন পদস্থ কর্মকর্তার কাছে শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে কর্মকমিশনের মেম্বার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তিনিই। ভাইভা চলাকালে তিনি বারবার বাথরুমে যাচ্ছেন। অন্য সদস্যরা প্রথমে ভেবেছিলেন, চেয়ারম্যান বোধ করি ডায়াবেটিস রোগী। বারবার এমনটি ঘটায় তাঁরা সন্দেহপ্রবণ হয়ে কান খাড়া করলেন। বাথরুম থেকে কথোপকথনের অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রতিবারই বেরিয়ে এসে তিনি নম্বর বাড়িয়ে দিতে অনুরোধ করছেন সদস্যদের। জোর করেই বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কারণ তিনি সরকারের প্রিয়পাত্র হিসেবে বিবেচিত। বর্ণনাকারী নির্বাহী এরপর আর কর্মকমিশনের ডাকে সাড়া দেননি। কিন্তু বাথরুমে মোবাইল ফোনে আলাপকারী মেম্বার তো বহাল তবিয়তে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এমন অনেক ঘটনাই অনেক সময় ঘটেছে। টাকার এবং দলবাজির এমন খেলার ফলে সিভিল সার্ভিসে নিয়োজিত নির্বাহীরা তাঁদের পূর্ণ চাকরিজীবনে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গে ক্যান্সার হিসেবে থাকবেন এবং রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভটি দুর্বল করে ফেলবেন। কর্মকমিশনের সেই মেম্বার হয়তো সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর অপসারিত হয়েছেন। কিন্তু নিয়োজিত নির্বাহীরা তো অপসারিত হবেন না। এভাবেই বিধিবদ্ধ সংস্থা রাষ্ট্রযন্ত্রে ঘুণ ধরায় এবং রাষ্ট্রকে দুর্বল করে ফেলে।
গণতন্ত্র এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে সংহত করতে হবে। আজ্ঞাবহ ব্যক্তি এবং সংস্থা দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না, গণতন্ত্র তো দূরের কথা। ঘুরেফিরে যেসব রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করে থাকে, তাদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থবুদ্ধির ঊধর্ে্ব উঠে বিষয়টিকে দেখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সেই পরিপক্বতা অর্জনে একটু একটু করে হলেও অগ্রসর হচ্ছে কি?
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর,
বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.