৭ নভেম্বর-কর্নেল তাহেরের প্রতিপক্ষ by মুশতাক হোসেন

ত ২২ মার্চ ২০১১ বাংলদেশের হাইকোর্টে কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানকারী আদালতের সব কার্যক্রম ও রায়কে অবৈধ ঘোষণা করার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। ৭ নভেম্বরের রাজনৈতিক লক্ষ্য কী ছিল, তা অর্জন করার রাজনৈতিক কৌশল কী ছিল, তা আবারও বিস্তারিত আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।


৭ নভেম্বরের রাজনৈতিক লক্ষ্য অনুধাবন করতে হলে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) উদ্ভব, তার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কার্যক্রমকে পর্যালোচনা করতে হবে। সে সঙ্গে তাহেরের রাজনৈতিক-সামরিক দর্শনগত বিকাশ ও স্বাধীনতার পরে জাসদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার প্রেক্ষাপটটিও বিবেচনায় আনতে হবে।
স্বাধীনতার পরে জাসদের জন্ম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত লক্ষ্য সমাপ্ত করার প্রত্যয় নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই সে শোষণহীন সমাজকে নিশ্চিত করতে পারে। তাই সমাজতন্ত্র ছিল রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় মূলনীতি (গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ) বাস্তবায়ন করার জন্য আলাদা কার্যক্রম করার প্রয়োজন হয় না।
সমাজতন্ত্র কীভাবে বাস্তবায়িত হবে এর একটি রূপরেখা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকী ২৬ মার্চ ১৯৭২-এ জাতির উদ্দেশে ভাষণে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার সরকার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। শ্রেণী-সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে ধাপে ধাপে সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে বলেও তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন সে ভাষণে।
কিন্তু কয়েকটি বড় বড় কলকারখানা ও পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত শিল্প-কারখানাকে জাতীয়করণ করেই তাকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বড় পদক্ষেপ বলে প্রচার করা হলো। শ্রমিক-মেহনতি মানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল সংস্কারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলো না। শ্রমিক-মেহনতি মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হলো না।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তদানীন্তন নেতৃবৃন্দ (তখনও ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়নি) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রেণী-সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে দলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব শক্তির সমন্বয়ে একটি বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন করে তার সর্বময় নেতৃত্ব গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতৃত্ব। আরও বিস্তারিত প্রস্তাব রাখা হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২২-২৬ মার্চ ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সংসদের বর্ধিত সভা থেকে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সরকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক-সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে গেল না। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পরিচালনার কথা বলে দেশকে পুঁজিবাদী ধারায় পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল শাসক দল আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাকে সংহত না করে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হলো। অন্যান্য দলকে বিরোধী দলে ঠেলে দেওয়া হলো। সরকারের অভ্যন্তর থেকে সমাজতন্ত্রের শক্তিকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগকে বিভক্ত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের বিরোধী শিবিরে ঠেলে দেওয়া হলো। সরকারের অভ্যন্তরে থেকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা খোলা না থাকায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্রলীগ-শ্রমিক লীগ-কৃষক লীগের নেতৃত্ব পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন করে সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সে অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)।
অন্যদিকে কর্নেল আবু তাহের সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে থেকে সামরিক বাহিনী তথা দেশের গোটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল ধারায় রূপান্তরের চেষ্টা করেন। লিখিতভাবে সুস্পষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয় সেনাসদরে ও সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে। তাহের নিজেও কুমিল্লার সেনাবাহিনী ব্রিগেডকে গণবাহিনীর আদলে রূপান্তরের জন্য সীমিত প্রয়াস চালান। কিন্তু তাকে বেশিদিন সে প্রয়াস চালাতে দেওয়া হয়নি। তাহের এর পাশাপাশি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কুচক্রীদের অবৈধ ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করে সেনাসদরে চিঠি লেখেন। ফল হলো উল্টো। ঢাকায় সদর দফতরে বদলি করে এনে সিপাহিদের কাছ থেকে দূরে রেখে নিষ্ক্রিয় করে রাখার চেষ্টা করা হয় তাহেরকে। তাহের তখন পদত্যাগ করে সেনাবাহিনীর বাইরে থেকে গণবাহিনী প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। যোগদান করলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে। এভাবেই জাসদ ও আবু তাহেরের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন স্রোতধারায় এসে মিলিত হলো। মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও পুঁজিবাদী ধারায় দেশ পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে সে সরকারই পুঁজিবাদের রক্ষক ও ধারক-বাহকে পরিণত হয়। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির রেখে যাওয়া প্রশাসন যন্ত্র ও প্রতিরক্ষা যন্ত্র রক্ষা ও লালন-পালন করার কারণে সরকার ক্রমান্বয়ে অসহিষ্ণু ও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, যা শেষ পর্যন্ত একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থায় পরিণতি লাভ করে। ফলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে প্রধান বাধা হিসেবে জাসদ বিদ্যমান ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার ধারক-বাহক আওয়ামী লীগ সরকারকেই চিহ্নিত করে। জাসদসহ সব বিরোধী দলকে বেআইনি ঘোষণা করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো পথ খোলা না থাকায় একটি বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জাসদ।
কিন্তু বাকশাল ঘোষণার পর পুঁজিবাদের জাতীয়-আন্তর্জাতিক মুরবি্বরা পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার দ্রুত বিকল্প পথের সন্ধান করতে থাকল। কারণ জাসদ পরিচালিত বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের রাজনীতি এমন পর্যায়ে পেঁৗছে যাচ্ছিল যে, বাকশালকে পরাজিত করে বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানে জয়ী হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ ধরনের পরিবর্তন কিছুতেই পুঁজিবাদের জাতীয়-আন্তর্জাতিক মুরবি্বরা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তাই পুঁজিবাদের সশস্ত্র রক্ষক শক্তি সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করাটাকেই বিপ্লব ঠেকানোর একমাত্র পথ বলে সাব্যস্ত করল। যার ফলে পরিবারসহ বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে ১৫ আগস্ট '৭৫।
ঘটনার নৃশংসতা ও আকস্মিকতায় দেশবাসী হতভম্ব হয়ে পড়লেও জাসদ কর্তব্য নির্ধারণে এক মুহূর্তও দেরি করেনি। আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল সরকার উৎখাত করে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করলে পুঁজিবাদের ধারক-বাহকের দায়িত্ব গ্রহণ করে সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি মদদপুষ্ট সামরিক জান্তা। তারা বরঞ্চ পুঁজিবাদের আরও খাঁটি সেবক বলে নিজেদের উপস্থিত করে। ফলে জাসদের সমাজ বিপ্লবের প্রধান লক্ষ্যবস্তু স্বাভাবিকভাবেই হয়ে পড়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী সামরিক সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর '৭৫ খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আরেক সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করলে বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের প্রধান প্রতিপক্ষে পরিণত হয় খালেদ মোশাররফের সামরিক সরকার।
জাসদ তথা কর্নেল আবু তাহের পরিচালিত সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানকে এ প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করতে হবে। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক বা সামরিক সরকারের প্রতি তাহের তথা জাসদের দুর্বলতা ছিল না। সমাজ বিপ্লবের প্রতিপক্ষ হিসেবে সব ক্ষমতাসীন সরকারকেই জাসদ রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতা করেছে। সিপাহি বিপ্লবের রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পর জিয়াউর রহমানের সামরিক জান্তাও সমাজ বিপ্লবের রাজনীতির প্রধান প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে।

স মুশতাক হোসেন : সাবেক সাধারণ
সম্পাদক, ডাকসু
mushtuq_husain@col-taher.com
 

No comments

Powered by Blogger.