মাতৃমন্দিরের মাসিমা by শাহজাহান খান

নোরমা বসু মাসিমার জন্ম ১৮ নভেম্বর, ১৮৯৭ এবং মৃত্যু : ১৬ অক্টোবর, ১৯৮৬ সালে। তাকে প্রথম দেখেছিলাম লুকিয়ে আমাদের মেহেন্দীগঞ্জের বাড়িতে। তিনি গিয়েছিলেন এক গোপন রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে। কয়েক বছর পর যে তার স্নেহস্পর্শে আমার জীবনটা নতুন বাঁক নেবে সেটা তখন ভাবতেও পারিনি। ১৯৬৩ সালে পরিবারের অমতেই আমি ঢাকা থেকে বরিশালে চলে যাই।


মুকুল সেন, নলিনী দাস, নুরুল ইসলাম (উকিল সাহেব), মিহির দাশগুপ্ত, ফকরুল আলমসহ সে সময় বরিশালে গোপন ও প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যারাই জড়িত সবার প্রিয় মাসিমা, যেমন তিনি প্রিয় মেথর-রিকশাওয়ালা-দিনমজুর থেকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত অগণিত পরিবারে। তিনি মাতৃমন্দিরে তার নিজের জমিতে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চালু করলেন তার দুয়ারও সবার জন্য খোলা। রাজরোষের শিকার তিনি হচ্ছিলেন বারবার। কারাগারেও নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু যাদের মাধ্যমে এ রোষের প্রকাশ ঘটত সেসব পরিবারেও মাসিমা নমস্য। রাজবন্দি থাকাকালে তিনি অসুস্থতার কারণে জেল হাসপাতালে স্থানান্তরিত হলেন। প্রতিদিন তার জন্য হাসপাতালে দুধ বরাদ্দ হতো এক বাটি। সেটা তিনি পাঠিয়ে দিতেন একই জেলে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের জন্য। এ ঘটনা বঙ্গবন্ধুর কাছেই শোনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাসিমা বললেন, 'ঢাকায় যাব মজিবরের কাছে।' আমি তার সঙ্গী। জাতির জনক অপেক্ষা করছেন গেটে। পেঁৗছার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মাসিমাকে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিলেন তার অফিস কক্ষের টেবিলে। উপস্থিত আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও মহিউদ্দিন আহমদ এবং প্রধানমন্ত্রীর কয়েকজন কর্মকর্তা এ দৃশ্যে মুগ্ধ, বিস্মিত। বঙ্গবন্ধু বলেন, 'এর চেয়ে যোগ্য আসন তোমার জন্য এখানে নেই।' তারপরে সবাইকে শোনালেন তাদের জন্য জেল হাসপাতাল থেকে দুধ পাঠানোর গল্প। জাতির জনক বলেন এক জননীর কথা : 'মাসিমা নিজের কথা নয়, ভেবেছেন আমাদের সবার স্বাস্থ্যের কথা। তোমার ছেলে দেশের প্রধানমন্ত্রী। বলো, কী চাও মাসিমা।' মাসিমা সত্যই সেদিন চাইতে গিয়েছিলেন। তবে নিজের জন্য নয়, সবার জন্য। তিনি বলেন, বরিশালের মাতৃমন্দিরে আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আমি অনেক বছর চালিয়েছি। এখন তুমি এটি সরকারি করে নাও। আর গ্রামের বাড়ির (গৌরনদী উপজেলার বাকাই জমিদার বাড়ি) জমিজমা তো ভোগ করি না। তুমি আমার স্বামী চিন্তাহরণ বসুর ভিটেমাটি নিয়ে সেখানে একটি মাতৃসদন গড়ে তোলো। গরিব পরিবারের মায়েরা বিনামূল্যে চিকিৎসা পেলেই আমি খুশি হবো।'
বঙ্গবন্ধু উচ্চহাসিতে ঘর ভরিয়ে তুললেন। তিনি বলেন, 'দেখ্ তোরা দেখ্। আমি মাসিমাকে বললাম চাইতে। আর তিনি তার যা ছিল সব আমারে দিয়ে দিলেন। এই না হলে আমার মাসিমা!' সাংবাদিকতা পেশায় থাকার সময় বঙ্গবন্ধুর অনেক কর্মসূচিতে আমি অংশ নিয়েছি। কিন্তু তাকে এমন উচ্ছ্বসিত, গর্বিত ও আবেগে আপ্লুত হতে কমই দেখেছি। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, তোমার স্কুল আমি সরকারি করে নিলাম। শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী নিজে গিয়ে তোমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে আসবে। মাসিমা নেই ২৫ বছর। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে মনোরমা বসু মাসিমাকে রোকেয়া পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করেন। কিন্তু বাকাইয়ের জমিদার বাড়ি অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়নি।
মাসিমার মন্ত্র ছিল, সবার ওপরে মানুষ সত্য। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের অনেক জেলা ও মহকুমা সম্মেলনে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তখন আইয়ুব খান-মোনায়েম খানের দাপট। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অনেককেই কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এমন পরিবেশে নির্ভয়ে মুক্তি ও সাহসের বাণী শোনাচ্ছেন মাসিমা। তার কথা শোনার জন্য, সানি্নধ্য পাওয়ার জন্য তরুণ ছাত্রছাত্রীদের সে কী আকুলতা!
মাসিমা নিজের কাজ নিজে করতেন। নিজের কিংবা অন্যের যে ঘরেই থাকতেন এর ব্যতিক্রম হতো না। তাকে ঘর পরিষ্কার করতে দেখে মনে হতো, জীবনের আরাধনা সত্য-সুন্দর প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সব ক্লেদ-গ্গ্নানি ঝেড়েমুছে দিচ্ছেন। বাকাইয়ের জমিদার বাড়ির প্রিয় বধূ মনোরমা বসু কখনও তেমন করে সংসারধর্ম পালন করতে পারেননি। নিজের সন্তানদের জন্য সময় দিতে পারেননি। তাদের মা দেশের অগণিত মানুষের মা হয়ে উঠেছিলেন। এটা তাদেরও
গর্ব ছিল।

শাহজাহান খান : সাবেক ছাত্রনেতা

No comments

Powered by Blogger.