বইপত্র: মন্ত্রিসভা থেকে কেন পদত্যাগ করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ

ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে এল দৃঢ় এক কণ্ঠস্বর—

‘দেশবাসী সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা,

বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রাম আজ সাফল্যের তোরণে উপনীত হয়েছে।...’

রেডিওর সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ শোনে, শোনে আর কাঁদে—আনন্দে, গর্বে, বেদনামিশ্রিত বিজয়ের অনুভূতিতে।

সেই কণ্ঠস্বর ছিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের—পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকা দূরদর্শী এক নেতা, যাঁর কৌশলী নেতৃত্ব ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় সম্ভব হতো না। শেখ মুজিব যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, তখন তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন এক সদ্য জন্ম নেওয়া জাতির—নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী সরকারকে, সামলেছিলেন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি, গড়ে তুলেছিলেন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির ভিত্তি। তাঁর জীবনের এমন সব ঐতিহাসিক সত্য নিয়েই মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন তাজউদ্দীন নামে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

এই বইয়ে তাজউদ্দীন আহমদের কর্মজীবন ও রাজনৈতিক জীবনকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। ভূমিকায় তিনি বলেই দিয়েছেন, ‘এটি তাজউদ্দীন আহমদের জীবনীগ্রন্থ নয়। এটি তাঁর রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্বের আখ্যান। বাংলাদেশের ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায় ১৯৭০ সালে, এই আখ্যানের শুরু সেখান থেকে। শেষ হয়েছে তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের বিয়োগান্ত পরিণতিতে, যেদিন তাঁর শরীর ঘাতকের বুলেট আর বেয়নেটে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল।’

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নিঃশব্দে কাজ করে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও সে সময় তিনি দলের সহকর্মীদের অনেকেরই সহযোগিতা পাননি। ফলে এটি ছিল তাঁর জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর ওই সময়ের তৎপরতা ও গৃহীত অনেক সিদ্ধান্ত শেখ মুজিবের অনুমোদন পায়নি বলেই বোঝা যায়। এ জন্য সরকার ও দলের মধ্যে ধীরে ধীরে ব্রাত্য হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকেও বিদায় করে দেওয়া হয়।

বইয়ে লেখক তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবন, তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা, দলীয় রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক সংকটের বিশ্লেষণ করেছেন। বিশেষত, স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারে তাঁর অবস্থান, মুজিবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জটিলতা এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে হত্যাকাণ্ড—এসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন লেখক।

মহিউদ্দীন আহমদ দালিলিক প্রমাণ, স্মৃতিচারণা ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও রাজনীতির গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর কেন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন তাজউদ্দীন, তা নিয়েও সবিস্তার অনুসন্ধান আছে এখানে। আর এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখক তাঁর বিশ্লেষণের সপক্ষে যুক্ত করেছেন বিভিন্নজনের চিঠি ও পেপার কাটিং। ফলে সেই সময়ের বাস্তবতা খুব নির্মোহভাবেই ফুটে উঠেছে। এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভারত সরকারের সঙ্গে তাজউদ্দীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক টানাপোড়েন সুন্দরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে এখানে।

সৈয়দ মিজানূর রহমান

তাজউদ্দীন নামে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন

মহিউদ্দিন আহমদ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০২৪; প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল; ২৩২ পৃষ্ঠা; দাম: ৫৮০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে prothoma.com এবং বইমেলায় প্রথমা প্রকাশনের ৬ নম্বর প্যাভিলিয়নে

মন্ত্রিসভা থেকে কেন পদত্যাগ করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ

No comments

Powered by Blogger.