গল্প- শুভ নববর্ষ by আন্দালিব রাশদী

১ জানুয়ারি ২০১৫

শুভ নববর্ষ।

২০১৫ আপনার জন্য বয়ে আনুক অনাবিল সুখ ও সমৃদ্ধি। অনাবিল-টনাবিল – এ-ধরনের গেয়ো শব্দ আমার মেজাজ খারাপ করে দেয়।

বছরের প্রথম দিন আমি মেজাজ ঠান্ডা রাখতে চাই – একেবারে কুল। আগের নববর্ষে যেসব রেজোল্যুশন নিয়েছিলাম বছরের শেষ দিন তা রিভিউ করেছি।

আমার টপমোস্ট রেজোল্যুশন ছিল সাড়ে পাঁচ কেজি ওজন কমানো। বাসার ওয়েইং স্কেলটাতে আমার ভরপেট ওজন আর খালি পেট ওজন একই দেখায় বলে আমি নিউমার্কেট ফুটওভারব্রিজের ওপর ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্রের স্বচ্ছ পস্ন্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে কাঁটাটা কোথায় গিয়ে স্থির হয় তা বের করেছি। এটা আমার বছরের শেষদিনের কাজ। আমার ওজন সাড়ে পাঁচ কেজি কমেনি। আরো সোয়া দুই কেজি বেড়েছে। সুতরাং এ-বছর অর্থমন্ত্রীর রিভাইজড বাজেটের মতো রিভাইজড রেজোল্যুশন নিতে হলো – এ-বছর লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে ওজন কমাতে হবে পৌনে আট কেজি – তার মানে ৭ হাজার ৭৫০ গ্রাম। ৩৬৫ দিনে বছর – তার মানে প্রতিদিন সোয়া একুশ গ্রাম ওজন কমাতে হবে।

একটি মাত্র রেজোল্যুশন শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। সিদ্ধান্ত ছিল : বানিয়ে বানিয়ে লেখা কোনো বইপত্র পড়ব না। ২০১৪-তে আমি কারো লেখা কোনো গল্প-উপন্যাস পড়িনি। এটা ২০১৫-তেও অব্যাহত রাখতে হবে।

রাত বারোটা এক মিনিট থেকে সকাল সাড়ে নটার মধ্যে আমি তেরোটি শুভেচ্ছা এসএমএস পেয়েছি।

আগে হ্যাপি নিউ ইয়ার লেখা কার্ড পেতাম। সেগুলো জমিয়ে রাখতাম। আমার ব্যক্তিগত আর্কাইভে আমাকে পাঠানো বিভিন্ন ধরনের অন্তত আড়াইশো কার্ড রয়েছে।

এসএমএস অনেক সস্তা। বিশ টাকার প্যাকেজ নিলে একশ একটা এসএমএস করা যায়।

আমি এসএমএস পাই, দু-এক সপ্তাহ পরপর ডিলিট করি। গোয়েন্দারা চাইলে কিছু কিছু এসএমএস রিট্রিভ করতে পারেন। এটা জমিয়ে রাখার নয়, ডিলিট করার যুগ। সম্পর্ক ধরে রেখে বোঝা বাড়াতে নেই, কান্নাকাটি অর্থহীন, ডিলিট করে ফেললেই হলো।

আমি যে-তেরোটি এসএমএস পেয়েছি তার পাঁচটি বাংলায় টাইপ করা। পাঁচটিই বেশ ইন্টারেস্টিং।

১. পাত্র ও পাত্রীর বন্দোবস্ত করতে পারি। আমরা অগ্রিম কোনো ফি চার্জ করি না। পরীক্ষা প্রার্থনীয়। পাখিভাই মেট্রোমনিয়ালস।

২. শুভ নববর্ষ। আপনাকে স্বীকার করতেই হবে নারীর সৌন্দর্য তার স্তন। আমরা নারীর ফিগারের সঙ্গে সংগতি রেখে স্তনের সমন্বয় করে থাকি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন হারবাল মেডিসিন প্রয়োগ করে স্তনের বৃদ্ধি ও হ্রাসের জন্য সত্বর যোগাযোগ করুন : ব্রেস্টএইড, পেট্রোনাস পস্নাজা, রোড-১৬-এ (পুরাতন ২৭)।

দ্র : ব্রেস্টএইডের সব ওষুধ ও সেবা ৫০% হ্রাসকৃত মূল্যে পাবেন পুরো জানুয়ারি মাস।

৩. রঞ্জুর বাবা,

২০১৫ সালে আপনার ওপর আল্লাহর গজব নাজেল হোক। আপনি ধ্বংস হয়ে যান। – ফাতিমা।

৪. শুভ নববর্ষ। সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। – তুষার।

৫. তিতির ইনশাল্লাহ এ-বছর তোর বিয়ে হবেই। দোয়া করি। – ছোটখালা।

আশ্চর্য, ছোটখালাও বাংলা টাইপ শিখে গেছে। আর আমাকে লিখতে হয় ইংরেজি হরফে।

আমি শুধু একটিই পাঠিয়েছি। ইংরেজি হরফের বাংলায় : নতুন বছরের শুভকামনা। ভালো থাকবেন।

সম্বোধন করিনি, ইতিতে নামও লিখিনি। আমার নম্বর তার সেভ করা। আমি পাঠিয়েছি ২০১৫-এর প্রথম মিনিটে – রাত বারোটা এক মিনিটে। ১২ ঘণ্টায়ও কোনো জবাব আসেনি।

আমার কী লেখা উচিত ছিল : আপনার তিতির?

১৮ ঘণ্টায়ও যখন জবাব এলো না, নিজেকে মনে হলো বেহায়া। এই মেসেজটা আমার পাঠানোর কী দরকার ছিল?

তৃতীয় বার্তাটি রঞ্জুর বাবাকে দেওয়া, কোনোভাবেই আমাকে নয়। প্রথমত, কারো বাবা হওয়ার শারীরিক সামর্থ্য আমার নেই। ফাতিমা আমার অপরিচিত নাম নয়; কিন্তু এই ফাতিমা সম্ভবত রঞ্জুর মা, তিনি মোটেও পরিচিত নন।

নবীজির কন্যা ফাতিমা মুসলিম জাহানের অশেষ শ্রদ্ধার পাত্রী। পাকিস্তানের আইয়ুব আমলে বাঙালিরা প্রেসিডেন্ট পদে সমর্থন করেছিলেন জিন্নাহর ভগ্নি ফাতিমা জিন্নাহকে, ফাতিমা ভুট্টো পিতামহ জুলফিকার আলীর ফাঁসি নিয়ে বই লিখেছেন, ফাতিমা লোপেজ নামে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার এবং ফাতিমা রবিনসন নামে একজন নৃত্যশিল্পী রয়েছেন, তারা কেউই আমার সরাসরি পরিচিত নন, পরোক্ষভাবে জেনেছি। প্রত্যক্ষ পরিচিত একজনই, আমার ক্লাসমেট ফাতিমা আওরঙ্গজেব। গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন, কিন্তু মৃত্যু তাকে গ্রহণ করেনি। কৌতূহল থেকেই বছরের প্রথম দিনই অভিযোগের বার্তা পাঠানো নারী ফাতিমাকে কলব্যাক করলাম।

প্রথম রিংয়ে ফোন ধরে আমার হ্যালো শোনার আগেই তিনি বললেন, বেহায়া কোথাকার! ফোন করতে তোমার লজ্জা হলো না?

আমার নারীকণ্ঠ শুনে তিনি থতমত খেয়ে পরক্ষণেই বললেন, তুই তা হলে সেই বেশ্যা, যে রঞ্জুর বাবাকে কব্জা করে রেখেছিস। এ-বছরই আল্লাহর গজব তোর ওপরও নাজেল হবে।

বছরের প্রথম দিন আমাকে ‘বেশ্যা’ গাল শুনতে হলো এবং সঙ্গে আল্লাহর গজবের অভিশাপ।

আমি বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, ফাতিমা ম্যাডাম এটা রং নম্বর। তিনি বললেন, ওই গাধাটাকে দে কিছু কথা শোনাই।

কৌশল পালটে এবার আমি ধমক লাগাই এবং তুই সম্বোধন করে বলি, তোর সব কথা আমি রেকর্ড করেছি, এগুলো পুলিশকে দেবো।

তখন তিনি বললেন, আপনি কে? কে বলছেন!

আমি তো এটাই বলতে চাচ্ছিলাম, যে আপনি মেসেজটা রং নম্বরে পাঠিয়েছেন।

কিন্তু তিনি তো আমাকে এই নম্বরই দিয়েছেন। আগে যে-নম্বরে কথা বলতাম সেটা এখন আর ব্যবহার করে না।

তিনি সতর্ক ছিলেন নববর্ষের অভিশাপটা যাতে তার কাছে না পৌঁছে। কিন্তু তিনি কি আপনার হাজব্যান্ড? মানে রঞ্জু আপনার ছেলে।

সরি আপা, মাথা ঠিক ছিল না, কী বলতে কী বলেছি ক্ষমা করে দেবেন। দেখুন ফাতিমা আমার নাম নয়, তিনি আমার হাজব্যান্ডও নন এবং রঞ্জু নামে আমার কোনো ছেলেও নেই। যে-মেয়েটি এই বাংলা এসএমএস লিখে দিয়েছে তার নাম ফাতিমা, ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেছে, আমি ফাতিমাদের বাসায় ভাড়া থাকি। ভুলে সে নিজের নাম লিখে ফেলেছে। কিন্তু আপনি কে বলছেন?

আমার নাম তিতির।

তিতির মানে, ওই যে মুরগির মতো? তিতিরের মাংসের স্বাদ কেমন? আমি কখনো খাইনি। এক কেজির দাম কত পড়ে?

দেখুন তিতিরের মাংসের স্বাদ কেমন, কেজি কত আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আপনি রঞ্জুর বাবাকে এত বড় একটা ভয়ংকর অভিশাপ দিলেন কেন?

আপনি আমার মেসেজটা ডিলিট করে ফেলুন। আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিল না। এই সময় লোকটা ঢুকে পড়ে, মানে আমার সঙ্গে একটা সম্পর্ক করে ফেলে, আমাকে বিয়েও করতে চায়। কিন্তু সমস্যা ছিল তার ছেলে রঞ্জু। রঞ্জুর বয়স এগারো বছর। মা নেই। লোকটা বলল, লাখদশেক টাকা হলে রঞ্জুকে কানাডায় একেবারে স্থায়ীভাবে রেখে আসবে। রঞ্জুর ছোট ফুপুর কোনো ছেলে নেই। পাঁচটা মেয়ে, তিনি তাকে অ্যাডপ্ট করবেন। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা খারাপ, সেজন্য তাকেও লাখপাঁচেক টাকা দেওয়ার কথা। আমি আমার হাজব্যান্ডের টাকা মেরে, আমার সব অর্নামেন্ট বেচে তাকে দশ লাখ টাকা দিয়েছি। দুমাস আগে কানাডা যাওয়ার সময় আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে শেষ ফোন করেছে। বলেছে, একুশ দিন পর এসে আমার সঙ্গে বিয়ের কাজটা সেরে নেবে। তার কোনো সাড়া না পাওয়ায় কদিন ধরে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ পত্রিকায় দেখলাম তার ছবি – একটি কোম্পানির বিপুল অংকের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছে। তার এলাকার থানায় খোঁজ নিয়ে জানলাম ছমাস ধরে পলাতক, স্ত্রী ও শাশুড়িকে হত্যা করে পালিয়েছে। তার রঞ্জু নামের কোনো সন্তান নেই।

এবার আমি জিজ্ঞেস করি, লোকটার নাম কি রইসুল ইসলাম খান?

আপনি চেনেন? আপা আপনি কি তাকে চেনেন? কোথায় আছে বলতে পারবেন?

আমি বললাম, রঞ্জুর তো লিউকেমিয়া, বস্নাড ক্যান্সার। মাসদুয়েক আগে আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে রঞ্জুর চিকিৎসার জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা দিলাম। রইসুলের তো ছেলে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে অ্যাপয়েন্টমেন্টের কাগজও দেখিয়েছে। রইসুল অনেকদিন আগে আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটে কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার ছিল। হঠাৎ মাসতিনেকের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় তার চাকরি চলে যায়। সবাই তাকে পছন্দ করত। তার চাকরি ফিরিয়ে দিতে সবাই বলেছে, ইউনিয়নও চাপ দিয়েছে; কিন্তু সিইও সাহেব রাজি হননি। রইসুল রঞ্জুর চিকিৎসা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছে, সামনাসামনি এবং ফোনে। আমার নম্বর তার ফোনে সেভ করা ছিল। রইসুল তাহলে আমার নম্বরটাই আপনাকে দিয়েছে।

এবার তিনি বললেন, আপা আপনার সঙ্গে দেখা করব!

আমি প্রথমে বললাম, কী দরকার?

তারপর ঝামেলা এড়াতে মিথ্যাটাই বললাম, আমি আগামী দুমাস দেশের বাইরে থাকব।

আমি তার ফোন আর ধরিনি। নম্বরটি বস্নক করে দিই।

ব্রেস্টএইড আমার নম্বরটি কোথায় পেল?

স্তন ক্যান্সার-সচেতনতা সপ্তাহের একটি অনুষ্ঠানে আমি লাম্প ডিটেক্টর নিয়ে একটি বক্তৃতা দিই, সঙ্গে ছিল ডিজিটাল প্রেজেন্টেশন। আমাদের কোম্পানির ফার্মাসিউটিক্যাল ইকুইপমেন্টস আমদানির লিস্টে সিনোরা ব্রেস্ট লাম্ব ডিটেক্টরও আছে। আমি বলি, কোনো পুরুষ ডাক্তারকে স্তন দেখানোর বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়িয়ে এমনকি অন্য কোনো নারীকেও না বলে আপনি নিজেই এই ছোট যন্ত্রটি দিয়ে আপনার স্তনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন। কোনো শক্ত বা নরম মাংসপি- ভেতরে বেড়ে উঠতে থাকলে মেশিনই আপনাকে বলে দেবে, সতর্ক করে দেবে।

সেই অনুষ্ঠানে এক ডজন স্পন্সরের মধ্যে ব্রেস্টএইডও ছিল। কাজেই আয়োজকদের কাজ থেকে আমার নম্বর পেতেই পারে। তাদের নববর্ষের শুভেচ্ছাটির সঙ্গে স্তন ক্যান্সার সারানোর কোনো সম্পর্ক নেই, স্তনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির আহবান আছে। এই আহবানে আমার সাড়া দেওয়ার কোনো কারণ নেই। নায়িকা সালমা হায়েক, গায়িকা জেনেট জ্যাকসন, স্পাইস গার্লস ব্যান্ডের ভিক্টোরিয়া বেকহাম, বেওয়াচের পামেলা অ্যান্ডারসন সিলিকন ইমপস্ন্যান্ট করে স্তনের আকার বাড়িয়ে নিয়েছে – বড় স্তন আকর্ষণ করে না বিকর্ষণ করে ছেলেরাই ভালো বলতে পারবে। আমি বলব, পামেলা অ্যান্ডারসনকে কেবল বড় স্তনের কারণে আমার একটুও ভালো লাগে না।

পাখিভাই ম্যাট্রোমনিয়ালস আমাকে শুভেচ্ছা পাঠাতেই পারে। মৃত্যুর আগে আমার মা নিজের হাতে আমার ছবি ও বায়োডাটা দিয়ে এসেছেন – তারা যেন তিতিরের জন্য একটি উপযুক্ত পাত্র খুঁজে দেয়। বিজ্ঞাপন বার্তায় যা-ই লেখা থাকুক, আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবে তিন হাজার সাতশো টাকাও দিতে হয়েছে। পুলিশের খাতায় নাম ওঠা দুশ্চিন্তার কারণ হতেই পারে, ঘটকের খাতায় নাম উঠলে এতটুকু আশ্বস্ত থাকা যায়, জীবনের কিছুটা দায় তো তিনিই নিয়ে নিলেন। আমার বেলায় ঘটক সাহেব এখনো উপযুক্ত পাত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। তিনি আমাকেই বলেছেন, ইনশাল্লাহ আগামী ষাট দিবসের মধ্যেই আমাদের ভগ্নি তিতিরের একটি ফয়সালা হয়ে যাবে। বড় বিয়েতে ঘটকই দাওয়াত পায় না। ভগ্নি, ভুলবেন না কিন্তু।

পাঁচ নম্বর এসএমএসটি আমার ছোটখালার। তিনি মনে করছেন কোনো একটা অশুভ প্রভাবে আমার জন্য ভালো কোনো প্রস্তাব আসছে না, আমার বিয়ে হচ্ছে না। আজমির শরিফ থেকে ইচ্ছাপূরণ সুতো এনে আমার বাহুতে বেঁধে দিয়ে বলেছেন, লক্ষ্মীসোনা, দোহাই আল্লাহর হাত থেকে এটা খুলিস না, গোসলের সময়ও না। এই পূর্ণিমাতে বেঁধে দিলাম অমাবস্যাতে খুলে দেব। খাজা বাবার দোয়ায় ইনশাল্লাহ তোর বিয়েটা হয়ে যাবে।

তিনি ধরে নিয়েছেন, পির-পয়গম্বরের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া আমার বিয়ে হবে না। শ্বশুরবাড়ির ওমরাহ-ফেরত এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের জেরিক্যান থেকে ছোটখালা এক গ্লাস জমজমের পানিও রেখে দিয়েছেন। এই পানির সঙ্গে সেদ্ধ করা ফিলটার করা স্বচ্ছ পানি মিশিয়ে পাঁচশো এমএল বোতলে ভরে আমার জন্য নিয়ে এসেছেন। তার উপস্থিতিতে বিসমিল্লাহ বলে আমাকে প্রায় চারশো পঞ্চাশ এমএল পানি খেয়ে নিতে হলো। অবশিষ্ট পানির সঙ্গে আরো মিশিয়ে আবার পাঁচশো এমএল, এভাবে মোট তিনদিন খাবার হুকুম দিলেন। দুটো ঘটনাই ২০১৪ সালের। তেমন উলেস্নখযোগ্য কোনো প্রস্তাব এলো না।

ছোটখালার মনে তখন ভিন্ন প্রশ্ন – কেউ তাবিজ করেনি তো? আমি হাসি।

ছোটখালা বলেন, হাসিস না। কুফরি কালাম করে মানুষের ক্ষতি করা যায়। তোর বিয়ে ঠেকানোর জন্য কেউ হয়তো তোদের বাড়ির সীমানার ভেতরেই কোথাও তাবিজ পুঁতে রেখেছে।

তিনি আবার মেয়েদের বয়স প্রসঙ্গে ফিরে আসেন। ছেলেদের বয়স যত বাড়ে বাড়ুক সমস্যা নেই। কিন্তু একটা বয়সের পর মেয়েদের লাবণ্য কমতে থাকে। বিয়ের কাজটা সারতে হয় তার আগে। বাচ্চাকাচ্চাও নিয়ে হয় তরতাজা যৌবনে। ভাটির কোনোটাই জুতমতো হয় না – বিয়েও না, সন্তানও না।

তা হলে আমার লাবণ্য কমতে শুরু করেছে?

ছোটখালা বললেন, আমি তা বলিনি, কিন্তু এটা তো সত্য বিশ্বসুন্দরীদের অনেকে এর মধ্যে বুড়ি হয়ে গেছেন। সুস্মিতা সেন, ঐশ্বরিয়া রাই এমনকি এ-বছর যে-মেয়েটা মিস ইউনিভার্স হলো কী যে তার নাম – সবাই বেঁচে থাকলে থুত্থুড়ে বুড়ি হবে। এটাই সত্যি। চার নম্বর এসএমএসটিতে একটি প্রাচীন, বহুল ব্যবহৃত, জরাজীর্ণ দার্শনিকী বাক্য : সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কথাটা তুষার আমাকে নতুন করে মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছে। তার মানে আমি সাড়া না দিলে সে আমার জন্য বসে থাকবে না, কিংবা আমি বসে থাকলে সময়ের বার্ধক্যলেপন থেমে থাকবে না। একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে যাব! আমার চেহারাটা এমন হাড়গিলার মতো হলো কেমন করে? আমি তো এমন ছিলাম না।

তুষার নিশ্চয়ই মনে করেছে এতদিন পর তার বার্তা পেয়ে আমি গদগদ হয়ে তখনই কল করে বসব। একদম ভুল ধারণা। তুষার যতই সেলিব্রেটি হয়ে উঠছে, তার সম্পর্কে আমার আগ্রহ ততই কমেছে। ততই দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাকে নিয়ে গসিপ কলাম যা ইচ্ছা তা-ই লিখুক, কখনো আমাকে যেন না জড়ায়। তুষার এখন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, চ্যানেল ঘুরিয়ে যেখানেই যাই সেখানেই তুষার। স্টুপিড, আমার যেন কাজ নেই।

----দুই----

আমি বছরের প্রথম দিনের খবরের কাগজ হাতে তুলে নিই। প্রথম পৃষ্ঠায় বাঁদিকে এক কলাম ইঞ্চিতে রজনীগন্ধার কটি ডাঁট, এরই নিচে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সব পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীকে ২০১৫ সালের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

আমাদের বাড়িতে চার-পাঁচটি পত্রিকা আসে। একটি কেবল গাঁটের পয়সায় কেনা, বাকিগুলো সৌজন্যে আসা। আমার বাবা মোটামুটি একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক।

আমাদের বাড়িতে আমিই, আর কেউ কখনো পত্রিকার ভাঁজ ভাঙে না, বাবা কখনো নয়। আমার যেদিন ইচ্ছা হয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি, বিশেষ করে ক্ল্যাসিফায়েড বিজ্ঞাপনের পাতা। বছরের প্রথম দিন বলে খুব মনোযোগ দিয়ে যা পড়েছি তার কিছুটা তুলে ধরছি :

শ্রীলংকার প্রিমিয়ার লিগে খেলতে গিয়ে বাংলাদেশের কৃতী ক্রিকেটার আশরাফুল ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। জেরার মুখে তিনি স্বীকার করেছেন, ২০১২-এর ২৬ আগস্ট রুহুনু রয়ালস ভার্সাস ওয়েমবা ইউনাইটেডের খেলায় তিনি ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অপরাধ করেছেন। পাঁচ বছরের জন্য তাকে ক্রিকেট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছোটখাটো গড়নের আশরাফুল আমার প্রিয় ব্যাটসম্যান ছিলেন। এখন কী আর করা – যদি প্র্যাকটিস ছেড়ে দেন, ফিরে আসার আর সম্ভাবনা থাকবে না।

রওশন এরশাদ বলেছেন, নির্বাচনের সময় এলে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা দল ছেড়ে চলে যান। সেটাই তো করার কথা। যেখানে তাদের প্রাপ্তিযোগ বেশি হবে, ভবিষ্যৎ বেশি ঝলমলে মনে হবে, তারা তো সেখানেই যাবেন। এটা দোষের কিছু নয়। তিনি বলেছেন, এ-কারণেই তিনি পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। আপনি ঠিক কাজটিই করেছেন, পার্টি চেয়ারম্যানের নির্দেশ পালিত হবে না তো কারটা পালিত হবে। তাছাড়া তিনি তো আপনার স্বামীও। স্বামীর নির্দেশ পালনে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। আমার স্বামী নেই, থাকলে আমিও তার কথা শুনতাম। স্বামী নেই মানে এই নয় যে, আমি অল্পবয়সে বিধবা কিংবা স্বামী-পরিত্যক্ত কোনো নারী। কিংবা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে যোগসাজশ করে স্বামীকে দুনিয়া থেকে একেবারে সরিয়ে দিয়েছি, এমনও নয়। আমার বিয়েই হয়নি। মা বলত, উপযুক্ত ছেলে আসছে না। চেষ্টা অব্যাহত আছে। পাখিভাই ম্যাট্রোমনিয়ালস ছাড়াও অনানুষ্ঠানিকভাবে আমার মায়ের পরিচিতজনরা আমার বিয়ের জন্য সক্রিয়।

বলেছিই তো, স্বামী থাকলে আমি তার কথা শুনতাম। কিন্তু আমার মেজফুপু তার স্বামীর কথা শুনতেন না, শুনতেন আপনার স্বামীর কথা। এ-নিয়ে তাদের সংসারে যথেষ্ট অশাস্তি হয়েছে। ফুপু এই অশাস্তিটাই উপভোগ করতেন। ফুপা ভোট দিতেন নৌকায় আর ফুপু লাঙলে।

ফুপা এরশাদ সাহেবকে নিয়ে এটা-ওটা বলতেন। কিন্তু ফুপু যেদিন বললেন, তুমি কত বড় সাধু আমার তা জানা আছে – এর পর থেকে ফুপা আপনার স্বামীর সঙ্গে নারীনাম জড়িয়ে বিদ্রূপ করা বন্ধ করলেন। পরে নৌকা ও লাঙলের সমন্বয় ঘটে যাওয়ায় তাদের ঘরে শাস্তির সুবাতাস বইতে থাকে।

ফুপু সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফুপুর চেয়ে বারো বছরের কমবয়সী এবং যথেষ্ট আকর্ষণীয় একজন নারী কনুইয়ের গুঁতোয় তাকে থমকে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান। ফুপু নমিনেশনের দৌড়ে অনেক পিছিয়ে পড়েন।

ফুপা তার স্ত্রীর এই পিছিয়ে-পড়াটা খুব উপভোগ করেন এবং বলেন, তোমার আরো পনেরো বছর আগে জন্মগ্রহণ করা উচিত ছিল।

আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি লোকজন কেন আপনার স্বামীকে  স্বৈরাচার বলে। তিনি যদি আমাদের এলাকা থেকে নির্বাচন করেন, আমি তাকে ভোট দেবো। তবে আমার মেজফুপু শওকত আরা জুলহাস উদ্দিনের মন এতটাই ভেঙে গেছে যে, তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, এমনকি আর কখনো ভোট দেবেন না – এ-ঘোষণাও দিয়েছেন।

আমি ফুপুকে ফোন করি।

ফুপু, শুভ নববর্ষ।

আরে রাখ তোর শুভ নববর্ষ। নববর্ষের গুষ্টি মারি।

সরি ফুপু, তোমার সম্ভবত মেজাজ খারাপ। এ-সময় আমার ফোন করা ঠিক হয়নি।

তাহলে কখন করতি, রাতের বেলায়? তাহলে তো তৃতীয় মহাযুদ্ধের গোলাগুলির শব্দ শুনতি। গত দুদিনের মধ্যে এখনই বরং মেজাজটা ভালো। সারা সকালে মাত্র এক কাপ কড়া কফি খেয়েছি। তোর কী খবর? ঘটক কাউকে এখনো পায়নি?

চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বলেছেন ইনশাল্লাহ ২০১৫ সালে পেয়ে যাবেন।

শোন তিতির আমি তোকে বলি। এখনই ভালো আছিস। তোর মা ভেবেছিল, তোকে কারো গলায় ঝুলিয়ে দেবে, যেমন করে সে নিজে আমার ভাইটার গলায় ঝুলে পড়েছিল। খোকাবাবু একটা মাটির মানুষ, সেজন্য নূপুরকে মেনে নিয়েছে। তোর বেলায় হবে ঠিক তার উলটো, পাত্র এসে তোর গলায় ঝুলে পড়বে। বাপের ভোগাস্তির প্রায়শ্চিত্ত তোকেই করতে হবে। তুই দেখতে সুন্দর, পড়াশোনায় ভালো, বিদেশি ডিগ্রি পেয়েছিস, ভালো চাকরি আছে। তোর বিয়ে করার কী দরকার? সুখ আর স্বাধীনতা সহ্য হয় না, তাই না? আমার যদি তোর মতো পড়াশোনা থাকত, বিদেশি একটা এমবিএ থাকত, একটা ভালো চাকরি থাকত, আমি সৈয়দ জুলহাস উদ্দিনকে বিয়ে করি?

ফুপু আস্তে বলো, ফুপা শুনলে আমার ক্ষতি হবে। তুমি খুব ভালো করে জানো আমার পাঁচজন ফুপার মধ্যে আমি জুলহাস ফুপাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। বিদেশে গেলে একমাত্র তিনিই বইয়ের দোকানে ঢুকে আমাকে ফোন করে বলেন, বইয়ের নাম বলো কী বই কিনব। অথচ আমি জানি তিনি নিজে একটা বইও পড়েন না। একবার আমার ফোনে চার্জ ছিল না। আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেননি তবু অনুমান করে আমার জন্য দুটো বই কিনে এনেছেন : ওরিয়ানা ফ্যালাসির ইন্টারভিউ উইথ হিস্টি আর ওয়াল্টার স্কেটের দ্য কনসাইজ ডিকশনারি অব ইংলিশ ইটিমোলজি, হার্টের বাইপাস সার্জারি করাতে সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরার সময় আনলেন লি কুয়ান ইডর ফ্রম দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফার্স্ট।

ফুপু বললেন, থাম থাম, দুটো বই দিয়ে তোর মাথা কিনে নিয়েছে। তার নিজের মাথায় কী ছিল কে জানে? লিলিয়ানকে কী এনে দিত জানিস কিনা বল?

আমি জিজ্ঞেস করি, লিলিয়ান কে?

লিলিয়ান রড্রিগস। জুলহাস উদ্দিনের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তার জন্য আনতো ব্রা আর প্যান্টি আর আমার জন্য এনেছিল সৌদি বোরকা। জুলহাস কোম্পানির তিনজন বোর্ড মেম্বার আর লিলিয়ানকে নিয়ে হ্যাপি নিউ ইয়ার করতে কক্সবাজার গেছে। বছরের শেষে সূর্যাস্ত দেখবে। হুইস্কি খেয়ে রাত বারোটা এক মিনিটে নতুন বছরকে বরণ করবে। অথচ আমাকে বলেছে প্রোডাক্ট প্রমোশন ম্যানেজারদের কনফারেন্স। আমি জিজ্ঞেস করি, লিলিয়ানও যাচ্ছে? কী বলেছে শুনবি, ওর সেক্রেটারিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স ছাড়া তো চলবেই না? অন্য কেউ হলে বলত ‘তার’, লিলিয়ানের বেলায় ‘ওর’।

ফুপু তোমার সঙ্গে শিগগির দেখা করব, ভালো থেকো।

ক্যান্ লিলিয়ানের কথা আর শুনবি না? আজই চলে আয় সন্ধেবেলায়, পুতুল আর পুপুল বার-বি-কিউ করবে।

ফুপুর যমজ দুই মেয়ে পুতুল আর পুপুল। আইডেন্টিক্যাল টুইন। সন্ধ্যায় বাসা থেকে বেরোব না, জানিয়ে দিই।

ফুপু ধ্যাৎ বলে লাইনটা কেটে দিলেন।

ভালো করেছেন। আমাকে পেপারটা তো পড়তে হবে।

নিচের দিকে দু-কলাম জুড়ে : স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই দাম্পত্য নির্যাতনের শিকার।

পাঁচ থেকে পঁচিশ বছর দাম্পত্যজীবন কেটেছে এমন পাঁচশো ষাট দম্পতির ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাহাত্তর শতাংশ নারী এবং নয় শতাংশ পুরুষ দাম্পত্য নির্যাতনের শিকার। বাকি উনিশ শতাংশ নারী ও পুরুষ বলেছেন, সংসার এমনই। স্বামী বা স্ত্রীর বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। এই উনিশ শতাংশের কয়েকজন স্বামী ও স্ত্রীর সাড়া লক্ষণীয় :

আমার বাবা আমার মায়ের ওপর যে নির্যাতন চালাতেন সে-তুলনায় আমার স্বামী তো ফেরেশতা।

আমার শাশুড়ি প্ররোচনা না দিলে আমার স্বামী কখনো নির্যাতন করেন না, এটা তো আর তার দোষ নয়।

আমার মায়ের ক্যাটক্যাট শুনতে শুনতে আমার বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, আমি তো এখনো আছি।

সমীক্ষকরা ধরে নিয়েছেন, দাম্পত্যজীবনের প্রথম পাঁচ বছরে স্বামী ও স্ত্রীর প্রকৃত চেহারার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে না, আর পঁচিশ বছর সংসার করে ফেলতে পারলে যা-ই ঘটুক, সবটাই গা-সহা হয়ে যায়।

এই সমীক্ষা প্রতিবেদনটি কমসংখ্যক নমুনার ওপর ভিত্তি করে করা। আমার চারপাশে যত দম্পতি দেখতে পাচ্ছি মেজফুপাসহ অধিকাংশ স্বামীই নির্যাতিত বলে আমার ধারণা। এমনকি আমাদের গৃহকর্মী (আমরা এখন আর কাজের বুয়া বলি না) গোলাপের মাও বলেছে, একটা ফিউজ বাল্ব গোলাপের বাবার ওপর ছুড়ে মেরেছিল, গালের কাছে বেশ খানিকটা কেটে রক্ত বেরিয়েছে। শেষ পৃষ্ঠার একটি সংবাদ : তিন বোতল ফেনসিডিলসহ পুলিশের কনস্টেবল মামুন চৌধুরী গ্রেফতার। রাত একটার দিকে সিভিল ড্রেসে কুড়িগ্রামের মিতালী সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওত পেতে থাকা মাদক প্রতিরোধ বাহিনী সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে তাকে আটক করে। তার ব্যাগ তল্লাশির পর তিন বোতল ফেনসিডিল পায়। তাকে থানায় সোপর্দ করা হয়।

মাত্র তিন বোতল ফেনসিডিল!

কাশি সারাতেই তো দুই বোতল লেগে যায়। বছরের শুরুতে এমন লঘুপাপে একজন পুলিশ গ্রেফতার – বছরটা পুলিশের জন্য না জানি কেমন যায়।

আরো একটি খবর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে :

একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সিফাত নামের এক যুবক সঙ্গোপনে ঢুকে বর ও তার সঙ্গীদের ওপর গুঁড়ো দাহ্যপদার্থ ছড়িয়ে তাদের ওপর জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি ছুড়ে মারে। দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে। সিফাতকে ধাওয়া করে ধরে ফেলা সম্ভব হয়। জনতা তাকে গণধোলাই দেয়। বর সেলিমউল্লাহসহ তিনজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ছয় মাস আগে একই পাত্রীর সঙ্গে সিফাতেরও গায়ে হলুদ হয়। কিন্তু গায়ে হলুদের পর পাত্রী বিগড়ে যায় এবং সিফাতকে প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিশোধ নিতেই এ-কা- করেছে বলে সে জানায়, কিন্তু যেহেতু মেয়েটিকে সে ভালোবাসে সেজন্য তাকে অক্ষত রেখেছে। দুজন পাত্র এই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাচ্ছে, কিন্তু আমার বেলায়?

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ২০১৪ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৩১, বাড়ি ভাড়া ৯.৭৫; বাড়ি ভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বস্তি এলাকায় ১৬.০৭ আর ফ্ল্যাটের ভাড়া বেড়েছে ১২.৮২ শতাংশ। দাম কমেছে ভোজ্যতেল, লবণ, ডাল, সুগন্ধি চাল, মসলা, চা, ডিম ও আটার। এসব প্রতিবেদন পড়ে আমার কী লাভ? নিজের অবস্থা বুঝতে পারা? হতে পারে। অক্টোবরে আমার বেতন শতভাগের কাছাকাছি বেড়েছে। কাজেই আমার যথেষ্ট উদ্বৃত্ত থাকবে।

----তিন----

সম্পাদকের নববর্ষের শুভেচ্ছার ঠিক নিচে প্রথম পৃষ্ঠায় যে-সংবাদটি দেখে আঁতকে উঠব বলে কেউ কেউ মনে করে থাকবে তা মোটেও আঁতকে ওঠার মতো কিছু নয়। বেশ পুরু হরফে ছাপা : ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সচিবের ছড়াছড়ি। যে-কজনের ছবি ছাপা হয়েছে মোস্তফা আল আমিনও তাদের মধ্যে আছেন।

আমি অবাক হইনি তার কারণ আমি তো মোস্তফা আল আমিনকে সেই কবে থেকে চিনি, মনেও নেই। স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার সময়ও তিনি হুংকার দিতেন, আমি আফটার অল বীর মুক্তিযোদ্ধা। জয়নব, তার বোকা স্ত্রী বলল, একটা ভীরু মুক্তিযোদ্ধা দেখাও তো? কোন ফ্রন্টে তুমি লড়াই করেছিলে বলো তো শুনি? আমি সব খবর জানি। তুমি একাত্তরে নারায়ণগঞ্জে বেশ্যাখানায় গিয়েছ, বাহাত্তরে নূরজাহান রোডের বাড়িতে বিহারি মেয়ে রেপ করেছ, তিয়াত্তরে তুমি প্রকৃতই শহিদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে বাস্ত্তচ্যুত করে সে-বাড়ি দখল করেছ।

মোস্তফা আল আমিন বললেন, ইম্পসিবল! একাত্তরে আমার বয়স তো বারোও হয়নি, তেরো বছরের ছেলের পক্ষে বিহারি মেয়ে রেপ করা সম্ভব? আর চোদ্দো বছর বয়সে কী করেছি বললে?

বলেছি তুমি একটা ভ-। তুমি একটা ভুয়া, তোমার সবই ভুয়া।

দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, আর একবার যদি কথাটা শুনি, তাহলে…।

এ পর্যন্ত বলে তিনি দম নিলেন। তারপর সাঁড়াশির মতো নিজের দুই বলিষ্ঠ হাতে স্ত্রীর গলা টিপে ধরলেন, জোরে, আরো জোরে।

সম্ভবত দম বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে মোস্তফা আল আমিনের মাথায় তার মেয়ের সদ্য কেনা গিটারের প্রচ- আঘাত লাগলে তিনি ছিটকে পড়েন, মাথা থেকে অঝোরে রক্তের ধারা নেমে আসে। গলা থেকে হাতের ফাঁস সরে যাওয়ার পর চোখ খুলে রক্ত দেখে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, আমি কিছু করিনি।

মোস্তফা আল আমিন, সরকারের স্থায়ী সচিব এবং রণাঙ্গনের বীর দাবিদার সুদর্শন মানুষটি আতঙ্কিত চোখে এদিক-ওদিক তাকান – কোনো সাংবাদিক আসেনি তো?

গিটারের আঘাতটা কি ঠিকমতো লাগেনি? লাগলে মেয়েটি খুনের মামলায় জড়িয়ে যেত। মেয়েটি সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে আর ফিরে যায়নি। মার মৃত্যুর সময় বাংলাদেশেই ছিল না।

এটা জানা কথা, তিনি বলেছেন, আরে ধ্যাৎ, পত্রিকায় ছবি ছাপা হলেই হলো? সংখ্যায় তো আমরাই বেশি। আসল আর কজন চাকরি পেয়েছে? ভোট হলেও আমাদের কেউ হারাতে পারবে না। গণতন্ত্র বলে একটা কথা আছে না।

মেয়ে জানে, বাবা-মায়ের বিষয় নিয়ে ছেলেমেয়েদের মাথা ঘামাতে নেই। সেও ঘামাবে না।

তাছাড়া ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বিয়ে বাবার ভুয়া হওয়ার কারণে ভেঙে গেছে – এমন নজির নেই। ভুয়া হলেই বরং কামাই বেশি। আর্থিক নিরাপত্তা গ্যারান্টেড। সুযোগও বেশি।

ছোটখালা ফোন করলেন, বললেন, দুলাভাইয়ের এবার খুব নামডাক হয়েছে, সব কাগজে ছবি। তিতির, তোর বিয়ে এবার কেউই ঠেকাতে পারবে না।

একুশ ঘণ্টা পর তুষারের আর একটা বাংলা এসএমএস : তিতির,  তোমার বাবা তো খুব ইন্টারেস্টিং মানুষ! হ্যাপি নিউ ইয়ার।

গিটার কত কাজে লাগে। আর একটা কিনব।

No comments

Powered by Blogger.