আর কয়টি লাশ দরকার? by সিফাত মাহমুদ

সনি, আবু বকর সিদ্দিক, ফারুক হোসেন, মহিউদ্দিন মাসুম_ এক একজন মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীর নাম, অকালে বিসর্জন দেয়া এক একটি নিরীহ প্রাণ। ছাত্র রাজনীতির নামে দেশের শিৰা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে নৈরাজ্য ও বর্বরতা চলছে এরা তারই নির্মম শিকার।
বিগত বিএনপি সরকারের আমলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের দুপৰের গুলি বিনিময়ের সময় নিহত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী সনি। অথচ সে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। ঠিক একইভাবে গত ১ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দু গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয়ে হাসপাতালে মৃতু্যবরণ করে মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক। কৃষক পরিবারের নিরীহ সন্তান আবু বকরও কোন দল করত না। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের পৈশাচিক তা-বে প্রাণ দেয় এক ছাত্রলীগ কর্মী, আরেকটি মেধাবী নাম ফারম্নক হোসেন। শিবিরের ক্যাডাররা তাকে কুপিয়ে, হাত ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ক্যাডাররা আরও অনেক ছাত্রের হাত ও পায়ের রগ কেটে দিয়েছে, যারা আর কোনদিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্বরতা দেখে যখন সারাদেশ সত্মব্ধ এবং শোকে মুহ্যমান, ঠিক তখনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে আরেক ছাত্র মহিউদ্দিন মাসুমকে। মাসুমকে নিজেদের কমী দাবি করে ছাত্রশিবির লাশ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও তার পরিবার জানিয়েছে সে কখনও শিবির করত না।
এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররাজনীতি অনেক আগেই তার গৌরব হারিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নামে শিৰাজ্ঞনে যে অরাজকতা ও বর্বরতা চলছে তা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির আজকের চিত্র তার সম্পূর্ণ বিপরীত। অতীতে একটা সময় ছিল যখন ছাত্ররাজনীতি দলীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে ছিল না। মেধাবী ছাত্ররা নিজেদের ও জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজনীতি করত। কিন্তু বর্তমানে দলীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের ব্যবহার এবং দলের লেজুরবৃত্তি ছাত্ররাজনীতিতে অবৰয় ডেকে এনেছে। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে ছাত্র সংগঠনগুলো সম্পূর্ণ মেধাশূন্য। ছাত্ররাজনীতির কার্যকারিতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আজকের কলুষিত ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে কোনভাবেই ভবিষ্যতের জন্য দৰ নেতৃত্ব গড়ে তোলা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে দৰ নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য নিশ্চয়ই সুশিৰার বিকল্প কোন কিছু হতে পারে না। তাছাড়া দেশে এখন এমন কোন ক্রান্তিকাল চলছে না যে, ছাত্রদের রাজপথে থেকে রাজনীতি করতে হবে।
ছাত্ররাজনীতিতে আজকে এই অবৰয়ের দায় দেশের প্রধান দলগুলো কোনভাবেই এড়াতে পারে না। একদা স্বৈরশাসকরা গায়ের জোরে ৰমতা ধরে রাখতে গিয়ে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে রাজনৈতিক দলগুলো এই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। যে ছাত্রলীগ একসময় দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখত, আজকে সে সংগঠনটিও দলীয় রাজনীতির লেজুরবৃত্তি করতে গিয়ে নীতি আদর্শ ও শৃঙ্খলাবর্জিত হয়ে পড়েছে। ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারের অনেক বড় সাফল্য মস্নান হয়ে যাচ্ছে। অথচ ৰমতাসীন দল কোনভাবেই ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অপরদিকে জন্মলগ্ন থেকেই ছাত্রদল অস্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। আর যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী তাদের ছাত্র সংগঠনকে গড়ে তুলেছে সম্পূর্ণ জঙ্গী কায়দায়। জামায়াত পরিচালিত বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে বিস্ফোরক ও জিহাদি বই উদ্ধার হওয়ার পর এটা এখন প্রমাণিত সত্য। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটির পৈশাচিকতায় সারাদেশ শিউরে উঠেছে। পুলিশের চিরম্ননি অভিযানে সংগঠনটির দেশব্যাপী ষড়যন্ত্রের ছক বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
কাজেই সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রেৰিতে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীতার ব্যাপারে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই ব্যাপারে অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি। ফলে ছাত্ররাজনীতিতে পচন ধরে তা এখন এর মাথায় এসে ঠেকেছে। এটাকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লাইফ সাপোর্টের ন্যায় বাঁচিয়ে রাখতে গেলে দেশে শিৰার পরিবেশ বিনষ্ট তো হবেই, সেই সাথে ভবিষ্যত রাজনীতিতে অনিরাপদ ও অদৰ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নামে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তারা নিঃসন্দেহে জঘন্য অপরাধী। কিন্তু তাদেরকে অপরাধী বানানোর পেছনে অবধারিতভাবে বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব দায়ী। যে দরিদ্র বাবা মা সন্তানকে নিজেদের একমাত্র সম্পদে পরিণত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিল, আবু বকর, ফারুক হোসেনের সেই বাবা-মাকে আমাদের নেতৃত্ব আজ কি সান্তনা দেবেন? এই নেতৃত্বের বিবেকে নাড়া দিতে আর কয়টি লাশ দরকার?
আইনের ছাত্র

No comments

Powered by Blogger.