তিনি শুধু আমার শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন সাহিত্য সাধনায় শিক্ষাগুরুও by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। কেবল শিক্ষক বললে সবটা বলা হয় না। কেবল কলেজীয় শিক্ষক নন, তিনি আমার সাহিত্য সাধনারও শিক্ষগুরু ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের একেবারে গোড়ায় আমি যখন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, তখন তিনি ছিলেন আমাদের ইংরেজীর অধ্যাপক।
নিজে সাহিত্য চর্চা করতেন প্রধানত বাংলায়। আমি তার অসংখ্য ছাত্রের মধ্যে একজন। কিন্তু আমিও গল্প-কবিতা লিখি জেনে নিজেই আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তিনি গম্ভীর, অল্পকথার লোক ছিলেন। সাহিত্যের আলোচনা উঠলে উচ্ছ্বসিত আলোচনায় মেতে উঠতেন।
মাসিক মোহাম্মদীতে তখন আমার 'আদিম' নামে একটি গল্প ছাপা হয়েছে। এক গ্রাম্য দাগী আসামির চরিত্র নিয়ে গল্প। সে অপরাধ জগত ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সমাজের বিরোধিতায় না পেরে আবার অপরাধ জগতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। গল্পটি পাঠ করে তিনি একদিন আমাকে কাসের শেষে তাঁর কৰে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তোমার গল্পটি আমি পড়েছি। কিছুদিন আগে আলাউদ্দীন আল আজাদের 'জেগে আছি' গল্পগ্রন্থটিও পড়েছি। তোমাদের সব গল্প গ্রাম এবং গ্রামের চরিত্র নির্ভর। আমাদের নগর নেই, মধ্যবিত্ত সমাজ এখনও গড়ে ওঠেনি। আমরা নগর ও নাগরিক চরিত্র খুঁজে পাব কোথায় ?
নিজের কথা বলতে গিয়ে বললেন, আমার জন্ম কলকাতায় ১৯১৯ সালে এক উচ্চমধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে। তখন বাংলাদেশে মুসলমান সমাজে উচ্চমধ্যবিত্ত দূরে থাক শিৰিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ই গড়ে ওঠেনি। মুষ্টিমেয় যাঁরা ছিলেন তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনার মতো। আমি তাই প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে চিনি। কিন্তু কলকাতার বাইরের মুসলিম পল্লী সমাজকে তেমন চিনতাম না। আর তোমাদের মতো পূর্ব বাংলার পল্লী সমাজকে চেনা ছিল আরও দুরূহ। তাই আমার লেখায় গ্রাম এবং গ্রামের চরিত্র কম পাবে। কিন্তু একজন বাঙালী মুসলিম লেখক হিসেবে চেষ্টা করেছি আমাদের গড়ে উঠতে যাওয়া নগর ও নগর চরিত্রগুলো গল্পে-উপন্যাসে তুলে আনতে কতটা সৰম হয়েছি তার বিচার করবেন পাঠকরা।
নিজের সম্পর্কে তাঁর এই মূল্যায়ন ছিল সঠিক এবং যথার্থ। ত্রিশের ও চল্লিশের দশকে বাংলার মুসলিম কথাসাহিত্যের যখন হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা তখন আবু রুশদ মতিন উদ্দীন ছিলেন সেই সাহিত্যের প্রভাবশালী অগ্রপথিক।
তিনি গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ৯১ বছর বয়সে ঢাকায় প্রয়াত হয়েছেন (ইন্নালিলস্নাহি...রাজিউন)। বর্তমান প্রজন্মের কাছে আবু রুশদ মতিন উদ্দীন হয়ত শুধুমাত্র একটি নাম। কিন্তু গত প্রজন্মের শিল্পী-সাহিত্যিক_এমনকি সাধারণ পাঠকের কাছে আবু রুশদ নামটি ছিল অত্যন্ত পরিচিত। কথাশিল্পের ৰেত্রে তিনি ছিলেন এক পথিকৃৎ।
আবু রুশদ মতিন উদ্দীন, আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শওকত ওসমান, কাজি আফসারুদ্দীন আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রমুখ যখন আমাদের কথাসাহিত্যে আবির্ভুত হন তখন এই সাহিত্যের ভাণ্ডের বলতে গেলে শূন্য ছিল। বিষাদসিন্ধু, আনোয়ারা, মনোয়ারা প্রভৃতি ঐতিহাসিক ও সামাজিক উপন্যাস ছিল আমাদের উল্লেখ করার মতো বই। আধুনিক নাগরিক সাহিত্য সৃষ্টি করার মতো নাগরিক সমাজ ও সমাজচিত্রও আমাদের ছিল না। ফলে সে যুগের কোন কোন মুসলিম কথাশিল্পীও হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে চরিত্র আহরণ করে গল্প-উপন্যাস লিখতেন। যেমন মোহাম্মদ মোদাব্বের রচিত ছোট গল্পের বই 'মিস লতা সান্যাল ও অন্যান্য গল্প'।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের ভয়াবহ দুর্ভিৰ আমাদের সমাজ জীবনের এতদিনের গ্রামীণ ভিত্তিকে প্রচ- নাড়া দেয় এবং তাতে ভাঙনের সূচনা করে। এই ক্রান্তিকালেই শওকত ওসমান, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রমুখ ভাঙন ধরা গ্রামীণ সমাজচিত্র নিয়ে কথাসাহিত্য তৈরিতে অগ্রসর হন এবং সফল হন।
এৰেত্রে আবু রুশদের ভূমিকা ছিল একটু ভিন্ন। তিনি তার কথাসাহিত্যে গ্রাম ও গ্রামীণ চরিত্র অঁকলেও নাগরিক চরিত্র ও চিত্র সৃষ্টির দিকেই তার ঝোঁক বেশি ছিল। উদীয়মান শহরে বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের অন্দরমহল তখন দারম্নণ পর্দাপ্রথার আড়ালে ঢাকা থাকলেও আবু রুশদ ও আবুল ফজলের মতো দু'একজন কথাশিল্পী সাহসের সঙ্গে সেই অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে নায়ক-নায়িকা তুলে আনার এবং নাগরিক সমাজচিত্র অঁকার চেষ্টা করেছেন।
আবু রুশদদের পরবতী যুগের কথাশিল্পও ছিল গ্রাম সমাজভিত্তিক। আলাউদ্দীন আল আজাদ, আবু ইসহাক, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলীর প্রথম দিকের গল্প-উপন্যাসও ছিল মুখ্যত গ্রামীণ সমাজভিত্তিক। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ঢাকা শহর একটি বড় গ্রামের চেহারা থেকে নগর চরিত্র ধারণ করতে থাকে এবং মুসলমান নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠতে থাকে। তখন সৈয়দ শামসুল হকই সম্ভবত তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্র ও চিত্র নগর জীবন থেকেই সংগ্রহ করতে শুরু করেন। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ তাস তার প্রমাণ।
এখন অবশ্য ঢাকা শহর একটি বড় নগর। তার নাগরিক সমাজও প্রতিষ্ঠিত এবং বড় এবং এই সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয় কথাশিল্পী হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন প্রমুখ অবরোধ ও কুসংস্কারমুক্ত নগর জীবনের সব রকম ছবিই আঁকতে পারছেন। কয়েক দশক আগেও এটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আজকের এই নাগরিক চরিত্রের কথাশিল্পের ভিত রচনার জন্য প্রচ- বাধা ও প্রতিকূলতার মধ্যে যাঁরা অগ্রপথিকের ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সদ্য প্রয়াত আবু রুশদ মতিন উদ্দীনের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করার মতো।
তিনি শুধু ঔপন্যাসিক বা ছোট গল্প লেখক ছিলেন না। একজন মননশীল প্রাবন্ধিকও ছিলেন। সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার মধ্যে বৈদগ্ধের ছাপ রয়েছে। তাঁর লেখার মধ্যে যে মানুষটি ফুটে উঠেছেন তিনি একজন অত্যন্ত আধুনিক মনের মানুষ। তাঁর লেখা এলোমেলো, রাজধানীতে ঝড়, ডোবা হলো দীঘি, সামনে নতুন দিন প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে শুধু একজন শক্তিশালী কথাশিল্পীর নয়, একজন মননশীল, বিদগ্ধ চরিত্রের মানুষেরও পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর ভাই রশিদ করিমও একজন আধুনিক কথাশিল্পী।
আবু রুশদ হলেন ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। এই ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ নিয়েছেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত। তারপর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপক ও সাহিত্য চর্চা। অল্প দিনেই তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে শিৰা কাউন্সিলর থাকাকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পৰে বিশ্ব জনমত গঠনের জন্য ইংরেজীতে একটি পাৰিক নিউজ লেটার সম্পাদনা করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি লন্ডন দূতাবাসেও শিৰা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এই সময় তাঁর জামাতা দেশের বিখ্যাত ব্যাংকার (বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান) কাজি বাহারুল ইসলাম লন্ডনে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন। আমরা ছিলাম পরস্পরের পরিচিত এবং বন্ধু। একদিন তাঁর মুখে শুনলাম তিনি আবু রুশদ মতিন উদ্দীনের জামাতা এবং আবু রম্নশদ লন্ডনেই আছেন। তবে শীঘ্রই বদলি হয়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সঙ্গে সাৰাত করি। তিনি আমাকে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন এবং অনেকৰণ ধরে দেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তারপর একবার ঢাকায় গিয়েও তাঁর বাসায় তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। তাঁর মুখে ইংরেজীতে তাঁরই অনুবাদ করা লালনগীতির কয়েকটির আবৃত্তি শুনেছি। এই গীতির মূল রসের সঙ্গে অনুবাদের সমন্বয় বিস্ময়কর। এবারেও ঢাকায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার কথাই সর্বপ্রথম ভেবেছি। তাঁর জামাতা কাজি বাহারুল ইসলামের কাছ থেকে তাঁর বাসার টেলিফোন নম্বরও নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যেতে পারিনি। ফলে শেষ দেখাটা আর হলো না। এই দুঃখ মনে চিরটাকাল বয়ে বেড়াতে হবে।
লন্ডন ॥ ১০ ফেব্রুয়ারি, বুধবার ॥ ২০১০

No comments

Powered by Blogger.