এবার সাম্বায় নাচবে দক্ষিণ আফ্রিকা by কাজী ওয়াহিদুজ্জামান

সময় ঘনিয়ে আসছে। আজ থেকে ঠিক ৯২ দিন পর দৰিণ আফ্রিকার মাটিতে বসছে বিশ্বকাপ ফুটবলের মহারণ। ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামবে ৩২ দল।
না, ৩২ দলের সবাই ফেবারিটদের তালিকায় নেই। শক্তি-সামর্থ্য-অতীত পরিসংখ্যান আর সর্বশেষ পারফরম্যান্সের হিসেব আর সেই সঙ্গে তারকা-মহাতারকার উপস্থিতির মানদণ্ডে বিচার করা হয় বিশ্বকাপের ফেবারিট কোন্ দল। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে এগিয়ে রাখছেন কেউ কেউ। কেউবা আবার স্পেনের মধ্যে দেখছেন বিশ্বকাপ জেতার সমূহ সম্ভাবনা। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সের মতো শক্তিগুলোকেও কেউ কেউ যখন একটু বিশেষ দৃষ্টিতে দেখছেন তখন কেউ আবার হিসেব-নিকেশ কষছেন দিয়াগো ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনাকে ঘিরে। ব্রাজিলের মতো পাঁচবার, ইতালির মতো চারবার কিংবা জার্মানির মতো তিনবার বিশ্বকাপ জিততে পারেনি আর্জেন্টিনা। তবে বরাবর ফেবারিটদের তালিকায় আর্জেন্টিনাকে উপেৰাও করতে পারেনি কেউ। এবারের বাছাই পর্বেও ম্যারাডোনার দলের পারফরম্যান্সে ছিল না চমকিত করার মতো উজ্জ্বলতা। কিন্তু তারপরও আর্জেন্টিনাকে ফেবারিট মানতে হচ্ছে, এর কারণ একটাই_ বিশ্বের বড় বড় ফুটবল আসর, বিশেষ করে ইউরোপের তিনটি ফুটবল আসর_ ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ, ইতালিয়ান সিরি-এ ফুটবল এবং স্প্যানিশ লা লিগা ফুটবলে এখন আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের জয়জয়কার। আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা একচেটিয়া দাপটে খেলছেন সেখানে। লিওনেল মেসি, কার্লোস তেভেজ, গঞ্জালো হিগুয়াইন, দিয়াগো মিলিটো, সার্জিও এ্যাগুয়েরো, জাভিয়ের ম্যাশচারেনহোরা এখন ইউরোপে তথা বিশ্বের বড় খ্যাতনামা কাবগুলোর আশা-ভরসার নাম। ম্যাচ জয়ের জন্য এসব কাব তাকিয়ে থাকে আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের দিকেই।
গত বছর ঈর্ষা করার মতো সাফল্য লাভ করে কাব বার্সিলোনা। যার পেছনে একটা বড় অবদান রেখেছেন লিওনেল মেসি। এর স্বীকৃতি হিসেবে ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব জেতা মেসি এবারও দুর্বার। ম্যাচের পর ম্যাচ গোল করে বার্সিলোনকে জয় পাইয়ে দিচ্ছেন। মেসি দুর্বার। ম্যাচের পর ম্যাচে গোল পাচ্ছেন। হ্যাটট্রিক পেলেন মাস দেড়েক আগে। শুধু মেসি নন, এভাবে ইউরোপের অনেক বড় দলের জন্যই বর্তমানে আর্জেন্টাইন ফুটবলাররা নির্ভরতার প্রতীক_ সাফল্যের চাবিকাঠি।
মেসির প্রতি বার্সিলোনা যেমন ঠিক, তেমনই ম্যাচ জিততে বর্তমানে কার্লোস তেভেজের দিকে তাকিয়ে থাকে ইংলিশ কাব ম্যানচেস্টার সিটি। গত সপ্তাহে তেভেজের জোড়া গোলেই এ মৌসুমে দুর্দানত্ম ফর্মে থাকা চেলসিকে ৪-২ গোলে হারায় ম্যানসিটি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে ম্যানসিটির জার্সি গায়ে ২৬ ম্যাচে ১৫ গোল আদায় করে নিয়েছেন তেভেজ। এর মধ্যে একটি হ্যাটট্রিকও রয়েছে। ২০০৯ সালের ডিসম্বরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের মাসসোর ফুটবলারের খেতাব জিতে নেন তেভেজ। বার্সিলোনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ। এবারে স্প্যানিশ লা লিগা ফুটবলে শিরোপা দৌড়ে বার্সিলোনার সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছে রিয়াল। এর পেছনেও রয়েছে এক আর্জেন্টাইন তারকার অবদান, যার নাম গঞ্জালো হিগুয়েন। ২০০৭ সাল থেকে স্প্যানিশ দলটির হয়ে খেলছেন হিগুয়েন। এ মৌসুমে ১৮ ম্যাচে ১৬ গোল করে রিয়ালের গতি অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছেন আর্জেন্টাইন তারকা। যেখানে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে পতর্ুগিজ তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবং কাকাকে দলে টানার পর এ দুই তারকার কাছ থেকে এখন পর্যনত্ম মাত্র ২১টি গোল পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। এর মধ্যে ১৬ খেলায় রোনাল্ডো ১৪টি গোল করেন। ২১ ম্যাচে কাকার গোল মাত্র ৭। ইতালিয়ান লীগের টানা চারবারের চ্যাম্পিয়ন দলটির নাম ইন্টার মিলান। এবারও পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে দলটি। এর পিছনে অন্যতম অবদান দুই আর্জেন্টাইন ফুটবলার দিয়াগো মিলিটো এবং ওয়াল্টার স্যামুয়েলের। ২০০৯ সালের ২০ মে ইন্টার মিলানের যোগ দিয়ে এখন পর্যনত্ম ২৪ ম্যাচে ১৫ গোল করেছেন মিলিটো। এর মধ্যে যার অনেকই ইন্টারকে উপহার দিয়েছে গুরম্নত্বপূর্ণ সব জয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ২৪ ফেব্রম্নয়ারি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফুটবলে নকআউট পর্বে ইংলিশ শক্তি চেলসির বিরম্নদ্ধে ২-১ গোলে ম্যাচ জেতে ইন্টার মিলান। দলের পৰে ওই রাতে একটি গোল করেন মিলিটো। অপর গোলটি যিনি করেন তিনিও আর্জেন্টাইন_ এসত্মেবান কামবিয়াসো যার নাম। ইন্টারের এ অব্যাহত জয়ের ধারায় গুরম্নত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন স্যামুয়েল ওয়াল্টারও, যিনি সেন্টার ব্যাক হিসেবে দারম্নণ সাপোর্ট করছেন দলকে। মাঝেমধ্যে গোলও করছেন। স্প্যানিশ দল এ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে খেলছেন ম্যারাডোনার মেয়ে-জামাইখ্যাত তরম্নণ আর্জেন্টাইন সার্জিও এ্যাগুয়েরা। খারাপ করছেন না তিনি। এ্যাথলেটিকো মাদ্রিদকে অনেক ম্যাচেই জয়সূচক গোল উপহার দিচ্ছেন। ফরাসী দল মার্সেইলির হয়ে লেফট ব্যাক/সেন্টার ব্যাক সামলাচ্ছেন গ্যাব্রিয়েল হেইনেজ। ১৬ ম্যাচে দলটির হয়ে দু'টি গোলও করেছেন আর্জেন্টাইন তারকা। এর দু'টিই উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে। এর একটি মিলানের বিরম্নদ্ধে। আরেকটি জার্মান দল বায়ার্ন মিউনিখের বিরম্নদ্ধে, যা মার্সেইলিকে ম্যাচ জিতে সাহায্য করে। সফলভাবেই ইংলিশ দল লিভারপুলের ডিফেন্স সামলাচ্ছেন জাভিয়ের মাশচেরানহো। এই দলেই খেলছেন আরেক আর্জেন্টাইন তারকা ম্যাক্সি রডরিগুয়েজ। কখনো মিডফিল্ডার আবার কখনো উইঙ্গার হিসেবে ভালই করছেন রডরিগুয়েজ। এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন কাবের হয়ে ফর্মেই রয়েছেন আর্জেন্টাইন তারকা। দৰিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে যা আর্জেন্টিনার জন্য হতে পারে বাড়তি অনুপ্রেরণা। বর্তমানে ব্রাজিল, স্পেনের মতো টপ ফেবারিট দলগুলোর জাতীয় দলের তারকারদের এমন ফর্মে দেখা যাচ্ছে না। ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে রোনাল্ডিনহো এবং আলেকজান্ডার পাতোর নামই বেশি উচ্চারিত হতো সাম্প্রতিক সময়ে। ইতালিয়ান দল এসি মিলানের হয়ে মাঠ মাতাচ্ছেন এ দুই তারকা। এর মধ্যে রোনাল্ডিনহো দলেই নেই। এ দুই তারকার পাশাপাশি মাইকন, থিয়াগো সিলভারা ভাল ফর্মে রয়েছেন বটে তবে আর্জেন্টাইনদের দুর্বার গতির কাছে পরাসত্মই তাঁরা। একমাত্র স্প্যানিশরাই হয়ত তুলনায় আসতে পারেন আর্জেন্টাইনদের বর্তমান ফর্মের সঙ্গে। ফার্নান্দো টোরেস, আন্দ্রেস ইনিয়েসত্মা, কার্লোস পুয়ল, জাভি এ্যালেনসো, মার্কোস সিনা. জেরার্ড পিকু্য, ডেভিড ভিলা, সার্জিও রামোসরা ফর্মেই রয়েছেন। তবে তাদের পাশ কাটিয়ে আর্জেন্টাইনরা এখন দুর্বার। আর তাই প্রশ্নটা এসেই যায়_ দৰিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা কি করবে? কোচ দিয়াগো ম্যারাডোনা কি পারবেন তাঁর শিষ্যদের এই দুর্বার পারফরম্যান্সকে একসুতায় গাঁথতে? নাকি বাছাই পর্বের মতোই সমন্বয়ের অভাব থেকে যাবে বিশ্বকাপেও? অবশ্য ম্যারাডোনা যদি খেলোয়াড়দের মধ্যে সমন্বয় গড়তে সফল হন, যদি ইনুজরির আকস্মিক মহামারী না লাগে তাহলে দৰিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের শিরোপা আর্জেন্টিনার হাতে ওঠা অস্বাভাবিক না_ এমন মনত্মব্য ফুটবলবোদ্ধাদের। অবশ্য মেসির পারফরম্যান্সকেও বিবেচনায় রাখছেন তাঁরা। স্প্যানিশ লীগের মতো দৰিণ আফ্রিকার মাটিতে মেসি জ্বলে ওঠার বিষয়টিকে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতার অন্যতম নিয়ামক হিসেবেই দেখছেন ফুটবলবোদ্ধারা। একই মতামত দিয়াগো ম্যারাডোনার_ আর্জেন্টিনাকে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তুলতে গত দেড় বছরে যিনি ১০০ ফুটবলারকে যাচাই-বাছাই করেছেন নিন্দুকের মুখ উপেৰা করে!
দৰিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার অন্যতম বড় একটি পরীৰা ছিল গত ৩ মার্চ জার্মানির বিরম্নদ্ধে আনত্মর্জাতিক প্রীতি ম্যাচটি। বাছাইপর্বে টালামাটাল অবস্থা পারি দিয়ে বেশ ক'টি প্রীতি ম্যাচে সাফল্য-ব্যর্থতার রশি ধরে জার্মানদের বিরম্নদ্ধে তাদের নিজ মাটিতে ম্যাচ খেলতে নামে আর্জেন্টিনা। দৰিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা আসলে কতটা কি করতে পারবে এরই যেন ট্রায়াল বার্সন ছিল এটি। কারণ তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি বরাবরই ফেবারিটদের তালিকায় থাকে। তাদের দুর্বল দলটির বিরম্নদ্ধেও ম্যাচ জিততে সংগ্রাম করতে হয় বড় বড় অন্য দলগুলোকে। আর্জেন্টিনা-জার্মানি প্রীতি ম্যাচের দিকেই তাই কৌতূহলী দৃষ্টি ছিল সবারই। শেষ পর্যনত্ম গঞ্জালো হিগুয়েনের গোলে ওই ম্যাচে ১-০তে জয় পায় আর্জেন্টিনা। এটা যে কেবল নিছক সৌভাগ্যের বশে তা নয়, ওই রাতে সত্যিকারের ফুটবল শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েই ম্যাচ জিতে আর্জেন্টাইনরা। এবং এর পরই যেন আর্জেন্টিনাকে আবার নতুন চোখে দেখতে শুরম্ন করেছে ফুটবল বিশ্ব। দৰিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের শিরোপা জেতার বিয়য়ে আর্জেন্টিনার নামের পাশে বাড়ছে বাজির দর। যদিও এবারের বিশ্বকাপে শিরোপার দাবিদার হিসেবে স্পেনকে দেখা হচ্ছে বিশেষ দৃষ্টিতে। যে রাতে জার্মানির বিরম্নদ্ধে ম্যাচ জেতে আর্জেন্টিনার সেই একই রাতে ফ্রান্সের বিরম্নদ্ধে ২-০ গোলে ম্যাচ জেতে ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেন। ফ্রান্সের মাটিতে ১৯৬৮ সালের পর যা স্প্যানিশদের প্রথম ম্যাচ জেতার রেকর্ড। ২০০৮ সালে ইউরো ফুটবলে শিরোপা জেতার পর থেকে এখন পর্যনত্ম স্প্যানিশদের হারাতে পারেনি কোন দলই। টানা ৪২ ম্যাচ অপরাজিত রয়েছে স্পেন। সেই সঙ্গে একই রকম দুর্দানত্ম ফর্ম ধরে রেখেছে স্প্যানিশ ফুটবলাররা। সঙ্গতকারণেই এবারের বিশ্বকাপে স্পেনকে ফেবারিটের মর্যাদা দেয়া হচ্ছে_ বলা হচ্ছে প্রথমবারের মতো এবার বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখতে পারে স্প্যানিশরা। তবে বিশ্বকাপের আগের ফর্ম আর বিশ্বকাপের মূল আসরের ফর্ম সবসময় এক থাকে না। আসর শুরম্ন আগের সময়টায় হোঁচট খেতে থাকা অনেক দলকেও দেখা গেছে চূড়ানত্ম সাফল্য নিয়ে ঘরে ফিরতে। আসরে প্রথমবার খেলতে এসে ক্রোয়েশিয়ার মতো কোন দল আবার দেখিয়েছে অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স। দৰিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের শিরোপা তাই আসলে কার হাতে উঠবে এটা অমীমাংসিত এ প্রশ্নই হয়ে থাকবে চলতি বছরের ১১ জুলাই রাত পর্যনত্ম। তবে জার্মানির বিরম্নদ্ধে প্রীতি ম্যাচে আর্জেন্টিনার জয়কে অনেকেই বড় করে দেখছেন এ কারণে যে এই জার্মানির কাছে হেরেই ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। জার্মানদের বিরম্নদ্ধে যে কোন দলের জয় মানেই তাই কোয়ার্টার ফাইনাল কিংবা সেমিফাইনালের মতো বড় ম্যাচ জেতার সামর্থ্য। দিয়াগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে তাই দৰিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের সম্ভাব্য শিরোপাজয়ী দল হিসেবে দেখছেন ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফের ফুটবল প্রতিবেদক ররি স্মিথের মতো অনেকেই। জোয়ান সেবেসত্মাইন ভেরনের মতো অভিজ্ঞ ফুটবলারের পাশাপাশি এ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, সার্জিও এ্যাগুয়েরা এবং লিওনের মেসিদের সংমিশ্রণকে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে দেখছেন তাঁরা। এর সঙ্গে দিয়াগো ম্যারাডোনার উপস্থিতির বিষয়টি তো রয়েছেই।

No comments

Powered by Blogger.