দেশসেরা হকি তারকা রানা- তারকা কথন by শেখ আঃ আওয়াল

 একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় খেলা হিসেবে সুপরিচিত ছিল হকি। সেটা ক্রিকেটের চেয়েও। বাংলাদেশ তো বটেই, গোটা উপমহাদেশেই ছিল হকির জোয়ার, উপচেপড়া জনপ্রিয়তায় ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে কোন অংশেই পিছিয়ে ছিল না বাংলাদেশের হকি।
আন্তর্জাতিক হকিতে তো বটেই, ঘরোয়া হকির খোঁজখবর রাখতে হকিপ্রেমীদের আগ্রহের কোন কমতি ছিল না। ঢাকার হকি স্টেডিয়ামে হকি লীগের আসরে, বিশেষ করে মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে গ্যালারিতে এত পরিমাণ দর্শক সমাগম হতো যে, যা ছিল অবিশ্বাস্য। এককথায় বললে পুরো স্টেডিয়াম থাকত হাউসফুল। যত দর্শক মাঠে উপস্থিত থাকতেন, তার দ্বিগুণেরও বেশি টিকেটের অভাবে স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কালোবাজারিরাও সুযোগ বুঝে দেদার উচ্চমূল্যে টিকেট বিক্রি করে টুপাইস কামিয়ে নিত। তবে সেসব আজ সবই অতীত। এই প্রজন্মের কাছে এসব মনে হবে আষাঢ়ে গল্পের মতো। তবে যারা এই সেই স্বর্ণালি আশি ও নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশের হকির স্বর্ণযুগের সাৰী, তারা স্বীকার করবেন ওপরের বাক্যগুলো মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, হকির সেই সুদিন আর নেই। সাংগঠনিক দুর্বলতা, আর্থিক সমস্যাসহ নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের হকি আজ পিছিয়ে গেছে অনেকটাই। নতুন প্রজন্মের ক্রীড়াপ্রেমীরা অনেকেই আজ জানে না, এক সময় বহু হকি তারকার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের হকিতে। কয়েকজনের নাম না বললেই নয়_ বশির আহমেদ, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, সাদেক, শামসুল বারী, ইব্রাহীম সাবের, হোসেন ইমাম, জামাল হায়দার, খাজা ড্যানিয়েল, রামা লুসাই, আশিকুলস্নাহ আয়েশ, মাশুকুলস্নাহ কায়েস, ওয়ালিউল ইসলাম নাসিম, বায়জিদ, সাইফুল, মুনির, জুম্মন লুসাই, কিসমত, মাহবুব হারম্নন, সাদেক, মামুন, নিক্সন, রফিকুল ইসলাম কামাল প্রমুখ। তবে বর্তমানেও বাংলাদেশের হকিতে যে কোন তারকা নেই, এমনটা নয়। আছেন, তবে তাদের সংখ্যা নিতানত্মই হাতেগোনা। এদেরই একজন মোঃ মাহাবুবুল এহসান (রানা)। হকি অনত্মঃপ্রাণ এই তরম্নণ ক্রিকেট বা ফুটবলের পথে না গিয়ে বেছে নিয়েছেন হকির ক্যারিয়ার। হকিতে সময়টা ভাল যাচ্ছে না জেনেও তিনি এই ক্যারিয়ার বেছে নিয়েছেন হকির প্রতি নিখাদ ভালবাসা থেকেই। আজকের প্রতিবেদন তাঁকে নিয়েই।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা খেলোয়াড় গড়ার স্থান হিসেবে পরিচিত। খেলাধুলা এবং শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে গফরগাঁও উপজেলা দারম্নণভাবে এগিয়ে। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, কাবাডি, ভলিবলে রয়েছে অসংখ্য মেধাবী খেলোয়াড়। মফস্বলে থেকেও এদের চোখে-মুখে থাকে বড় খেলোয়াড় হওয়ার রঙিন স্বপ্ন। স্বপ্নের দৌড়ে কেউ ঝরে পড়েন আবার কেউ পিছিয়ে পড়েন, আবার কাঙ্ৰিত লৰ্যে পেঁৗছে যান কেউ কেউ। হঠাৎ স্বপ্নও পূরণ হয় কারও। এমনি একজন খেলোয়াড় মোঃ মাহাবুবুল এহসান রানা, পিতার নাম আলহাজ মোঃ গিয়াস উদ্দিন, বাড়ি গফরগাঁও উপজেলার ৫নং যশরা ইউনিয়নের বখুরা গ্রামের ১৯৮১ সালের এই তরম্নণ খেলোয়াড়ের জন্ম। ছোটকালেই তাঁর স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে খেলে অনেক সুনাম বয়ে আনা। মা-বাবার ইচ্ছায় তিনি বিকেএসপিতে ভর্তি হন। এরপর থেকে নিজেকে একটু একটু করে গড়ে তোলা। ১৯৯২ সালে হকি খেলোয়াড় হিসেবে বিকেএসপিতে ভর্তি হন রানা। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় জুনিয়র দলে ডাক পান। তখন থেকেই খেলার গতি, ঝোঁক, মানসিক শক্তি আরও দ্বিগুণ হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে দাপটের সঙ্গে খেলে জাতীয় দলে অনত্মর্ভুক্ত হন। ১৯৯৭ সালে জাতীয় যুব হকি প্রতিযোগিতায় বিকেএসপির অধিনায়ক নির্বাচিত হন। জাতীয় দলে খেলার সুবাদে হকি খেলোয়াড় হিসেবে চারদিকে পরিচিতি বাড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে এ্যাজাক্স স্পোর্টিংয়ের হয়ে ঢাকা লীগে যোগ দেন। তখনই সবার নজর কাড়েন। মেধাবী খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৯৮ সালে এ্যাজাক্সের অধিনায়ক মনোনীত হন।
মাহাবুবুল এহসান রানা ২০০০ সালে মোহামেডানের হয়ে ঢাকা লীগে অংশ গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে জাতীয় হকি প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হকি দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ পর্যনত্ম ঢাকা আবাহনী লিমিটেডের হয়ে খেলে দারম্নণভাবে প্রশংসিত হন। এরই মধ্যে ২০০৩ সালে ঢাকা আবাহনীর অধিনায়কের দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা হকি দলের অধিনায়কত্ব্ব করেন। দেশে যখন রানার খেলার প্রশংসা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখনই তাঁর সামনে সুযোগ আসে ১৯৯৭ সালে প্রথম আনত্মর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে ভারতের পাঞ্জাবে অংশ গ্রহণের। দেশ ছেড়ে দেশের বাইরেও খেলার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জাতীয় দলের হয়ে এ পর্যনত্ম ১৭০টি ম্যাচে অংশ গ্রহণ করেন। দেশীয় বিভিন্ন টুর্নামেন্টে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের জাতীয় দলের হয়ে যে সব দেশে খেলতে গিয়েছেন তার মধ্যে ভারতেই সর্বাধিক
আটবার, মালয়েশিয়ায় তিনবার, থাইল্যান্ড দু'বার। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা, বাহরাইন, কাতার, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ডসহ অনেক দেশে। তিনি আনত্মর্জাতিক খেলায় ১৫টি গোল করেছেন। মাহাবুবুল এহসান রানা আজ গফরগাঁওয়ের গৌরব তথা দেশের ইতিহাস। তাঁর খেলায় শৈল্পিক ও নান্দনিক মাধুর্য রয়েছে। দেশসেরা হকি সেন্টারহাফ ও পেস্ন-মেকার হিসেবে এক সময় মাঠ মাতিয়েছেন। নজরকাড়া নৈপুণ্য উপহার দিয়েছেন দর্শককে। অনুপ্রেরণা হিসেবে তাঁকে দেখে বর্তমান প্রজন্ম ছুটছে নিজেদের গড়তে। আমরা আশাবাদী গফরগাঁও উপজেলার মাটি খেলোয়াড় তৈরির জন্য খুবই উপযুক্ত জায়গা। ক্রীড়া েেত্র অবদানের জন্য গফরগাঁও প্রেসকাব ২০০৮ সালের ২৫ জুলাই ক্রীড়া েেত্র প্রেসকাব পদকে ভূষিত করে। বর্তমান গফরগাঁও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক রানার প্রত্যাশা বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এরই অংশ হিসেবে বর্তমান সরকারের কাছে তাঁর দাবি গফরগাঁওয়ে একটি স্টেডিয়াম হলে উপজেলার খেলোয়াড়রা বিভিন্ন খেলাধুলায় দেশীয় এবং আনত্মর্জাতিকভাবে বিভিন্ন অবদান রাখতে পারবে। মাহাবুবুল এহসান রানা ২০০৫ সালে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম মনিরা আক্তার (লিপি)। তিনি এক কন্যা সনত্মানের জনক। রানা বলেন, আমার যত সাফল্য, ব্যর্থতা সকল কিছুর পিছনেই পিতৃত্বের ছায়ার মতো কাজ করেছেন, সানত্ম্বনা দিয়েছেন, ভালবাসা দিয়েছেন, যার অবদানের স্বীকৃতস্বরূপ আমি তাঁকে কিছুই দিতে পারিনি তিনি আমার বড় ভগি্নপতি, বিশিষ্ট শিল্পপতি আব্দুল হামিদ। পাশাপাশি আমাকে গড়ে তোলার জন্য যাঁরা আমার মেধা এবং শ্রমে অবদান রেখেছেন যেখানে আমার খেলার হাতেখড়ি সেই বিকেএসপির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাঁর শখ, গফরগাঁও তথা বাংলাদেশের হকিসহ বিভিন্ন খেলায় মান বাড়ানোর চেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.