ব্রাজিলের সাদা পেলে জিকো by ফারজানা নবী

পুরো নাম আর্থার আন্তুনেস কোইম্ব্রা। ডাক নাম জিকো। এই নামেই তিনি বিশ্বব্যাপী তুমুল পরিচিত। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ব্রাজিলের হয়ে যিনি আলোর দু্যতি ছড়িয়েছেন পুরোমাত্রায়।
নিজদলের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও সুউচ্চে অধিষ্ঠিত করেছেন বহুমাত্রায়। আর তাই তো ব্রাজিলের বিখ্যাত কয়েকজন ফুটবলারের নাম উচ্চারণ হলেও চলে আসে তার নাম। ব্রাজিলের কালো মানিক পেলের পরই তার উত্থান। অসাধারণ খেলার ধরন, দুই পায়ে সমান পারদর্শী আর এ্যাটাকিং ফুটবল খেলার জন্য সবাই তাঁকে ডাকে ফুটবলের সাদা পেলে বলে। বয়সের সব ধাপেই তিনি সফল। তরম্নণ বয়সে কাবের হয়ে, পরিণত বয়সে নিজ দল ব্রাজিলের হয়ে এবং খেলোয়াড়ী জীবনের পর বিভিন্ন দল বা দেশের হয়ে কোচের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন নৈপুণ্যের সঙ্গে। আবার ব্রাজিলের মন্ত্রিসভায়ও তাঁর অবস্থান। দায়িত্ব পালন করেছেন ক্রীড়ামন্ত্রীর। আর তাই তো ব্রাজিল নয় গোটা বিশ্বের একজন সফল ফুটবল ব্যক্তিত্বের নাম জিকো। সম্প্রতি ফিফা ডট কমের মুখোমুখি হয়েছিলেন জিকো। একানত্ম আলাপচারিতায় জিকো স্মৃতিচারণ করেছেন অতীতের স্বর্ণালী দিনগুলোর। দুরনত্মভাবে বেড়ে ওঠা রিও ডে জেনিরোর গল্প। সেই গল্পের উলেস্নখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য। বড় দুই ভাই ছিলেন ফুটবলার। খেলতেন আমেরিকার হয়ে। ফলে শৈশবেই ফুটবলের ভুতটা ভালোমতোই চেপেছিল তার জিকোর মাথায়। সারাৰণ ফুটবল আর ফুটবল। বাসায় স্থির হয়ে বসার বান্দা তিনি ছিলেন না। ছয়ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। বাবা পর্তুগিজ ইমিগ্রান্টের অধিকারী হলেও তাদের বসবাস ছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে। ছোটবেলা কেটেছে ব্রাজিলিয়ান সব তারকা ফুটবলারদের খেলা দেখে। সেখান থেকেই জিকোর স্বপ্নের যাত্রার শুরম্ন। আর তাছাড়া ঘরের মধ্যে দুই ভাইয়ের ফুটবলের সখ্য জিকোর স্বপ্নের গতিকে করেছিল ত্বরান্বিত। ১৯৬৭ সালেই আমেরিকায় বড় দুই ভাইয়ের সাথে ট্রেনিং সেশনে অংশ নিত কিশোর জিকো। এখান থেকেই শুরম্ন আনুষ্ঠানিক ফুটবলের যাত্রা। এক রেডিও রিপোর্টার চেলসো গার্সিয়ার হাত ধরে। মাঠে জিকোর খেলার ধরন আর উত্তরোত্তর সাফল্য ধরা পড়ে এই রিপোর্টারের চোখে। তিনি জিকোর বাবাকে অনুরোধ করেন ছেলেকে ফেম্যাঙ্গো কাবে দিতে। অসম্মতি জানাননি বাবা। তা ছাড়া ফেম্যাঙ্গোর কাবের দারম্নণ ভক্ত ছিলেন জিকো। ফলে জিকোর কাছ থেকেও আসেনি না সূচক কোন মনত্মব্য। শুরম্ন হয়ে গেল ফুটবল অধ্যায়। কাবে যোগ দেুয়ার পর সমস্যা তৈরি হলো জিকোকে নিয়ে। শারীরিকভাবে খুব হাল্কাপাতলা ছিলেন তিনি। যা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের জন্য রীতিমতো বৈরী বিষয়। শুরম্ন হলো শারীরিকভাবে ফিট হওয়ার লড়াই। এখানে তাকে সাহায্য করতে এলেন এক ফিজিক্যাল এডুকেশন স্কুলের এক শিৰক । নাম তার রবার্তো ফ্রান্সেলিক্কি। তার নিবিড় পরিচর্যায় দ্রম্নত নিজেকে ফিট করে তুললেন জিকো। একজন পরিপূর্ণ এ্যাথলেট হিসেবে যা করা দরকার তাই করে দিয়েছিলেন এই শিৰক। ফেম্যাঙ্গো কাবের যুব দলে তিনি খেলেন ৪ বছর। দুর্দানত্ম পারফরমেন্সে ১৯৭১ সালেই ঢুকে পড়েন ফেম্যাঙ্গো কাবের পেশাদার দলে। এরপর স্বপ্নের পথচলা। একের পর এক সাফল্য আসে তার পায়ে । ১৯৭৬ সালে জায়গা পান ব্রাজিলের জাতীয় দলে। খেলতে থাকেন অসাধারণ গতিতে। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের ঘটনা। যে বিশ্বকাপ ছিল জিকোর প্রথম। এই বিশ্বকাপের একটি ঘটনা এখনও জ্বলজ্বলে স্মৃতি হয়ে আছে জিকোর জীবনে। জিকোর মতে এমন ঘটনা ফুটবলের ইতিহাসে বিরল। সুইডেনের সাথে এক ম্যাচে। নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ১-১ গোলে ড্র। ইনজুরি সময়ও শেষের দিকে। এক মিনিটেরও কম সময় বাকি। এমন মুহূর্তে জিকোর আবির্ভাব। কর্নার কিকে মাথা লাগিয়ে প্রতিপৰের জালে বল পাঠিয়ে দিলেন জিকো। জয়ের আনন্দ ব্রাজিলের শিবিরে। কিন্তু গোল হিসাবে মানলেন না ওয়েলসের রেফারি কিভ থমাস। তার দাবি তিনি ম্যাচের শেষ বাঁশি যখন বাজিয়েছেন তখন জিকোর হেড করা বল শূন্যে ছিল। ফলে ড্র নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাদের। নিজ দেশের কাব এবং জাতীয় দলের হয়ে খেলার পাশাপাশি জিকো খেলেছেন ইতালী এবং জাপানের কয়েকটি কাবে। ১৯৮৩ সালের ঘটনা। রেকর্ড কয়েক মিলয়ন অর্থের বিনিময়ে তিনি খেলতে যান ইতালির উডিনেস কাবে। দেশ ছেড়ে বিদেশে খেলতে যাওয়ায় অনেক ব্রাজিলীয় সমর্থক বেদনায় মুষড়ে পড়েছিলেন। তাদের দাবি ছিল দেশের ছেলে দেশেই খেলুক। কিন্তু অদম্য জিকো বিদেশেই খেলে যান। ইতালি লীগ প্রসঙ্গে জিকো বলেন 'সিরিএ লীগে তখন বিশ্বের নামকরা খেলোয়াড়দের উপস্থিতি ছিল। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তখন খুব কঠিন ছিল আমাদের। এই সময়টা ছিল ফুটবলের দারম্নন সময়। তবে খুশি ঐ সময়ে নিজেকে যথার্থ প্রমাণ দিতে পেরেছিলাম আমি।' সিরিএ লীগে উডিনেসের হয়ে দারম্নন খেলতে থাকেন জিকো। ৮৩-৮৪ মৌসুমে তিনি করেন ১৯ গোল। এই সময়ে জিকোর প্রতিপৰ ছিলেন আর্জেন্টিনার ডিয়েগো ম্যারাডোনা এবং ফ্রান্সের মিশেল পস্নাতিনি। এরাও খেলতেন ইতালি লীগে। ম্যারোডোনা নেপোলি আর পস্নাতিনি খেলতেন জুভেন্টাসের হয়ে। পারফরমেন্স ভাল করার দৌড়ে এই তিন জনের মধ্যে সবসময় চলত ঠা-া লড়াই। ফলে এই তিনজনের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়েও জোর বিতর্ক ছিল তখন। এই মৌসুমে উডিনেসকে ট্রফি এনে দিতে ব্যর্থ হন জিকো। চ্যাম্পিয়ন হয় পস্নাতিনির দল জুভেন্টাস। লীগে না জিততে পারায় দেশের কাব ফেম্যাঙ্গোতে আবার ফিরে আসেন জিকো। ফেরার বছরেই হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন তিনি। চলে বেশকিছুদিন। এমন অবস্থা নিয়েই খেলেন ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ ফুটবল। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপে ঘটে তিক্ত অভিজ্ঞতা। কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মিশেল পস্নাতিনির দল ফ্রান্সের কাছে হেরে যায় জিকোর দল ব্রাজিল। নির্ধারিত সময় খেলা ১-১ গোলে ড্র থাকায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে পেনাল্টিতে তিনি গোল দিতে পারলেও মিস করেন সতীর্থ সক্রেটিস এবং জুলিয়ো সিজার। ফ্রান্সের পস্নাতিনি গোল মিস করলেও জেতে তাদের দলই। বিশ্বকাপের পর ইনজুরি থেকে মুক্ত হয়ে আবার খেলে যান প্রিয় কাব ফেম্যাঙ্গোতে। জেতান চতুর্থবারের মতো শিরোপা। এরপর থেকে জাতীয় দল থেকে আসত্মে আসত্মে নিজেকে গুটিয়ে নেন জিকো। ১৯৮৮ সালে খেলেন ব্রাজিলের হয়ে শেষ ম্যাচ। জাতীয় দলের বাইরে থাকলেও তিনি কিছুদিন খেলে যান জাপানের দুই কাব সুমিতোমো মেটালস এবং কাশিমা এন্টলার্সে। ব্রাজিলের হয়ে ৭২ ম্যাচ খেলেছেন জিকো। গোল করেছেন ৫২টি। তবে ফেম্যাঙ্গো কাবে তার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তিনি খেলেছেন মোট ৭৩১ ম্যাচ। আর গোলের সংখ্যা ৫০৮। কাবের ইতিহাস তিনি সর্বোচ্চ গোলদাতা। আর ম্যাচ খেলার রেকর্ডে তিনি দ্বিতীয়। বিশ্ব কাব ফুটবলের ইতিহাসে এমন নজির স্থাপন করায় ব্রাজিলিয়ান সিঙ্গার জর্জ বেঞ্জর জিকোর সম্মানে লিখেছিলেন একটি গান। ফেম্যাঙ্গো কাব প্রসঙ্গে জিকোর মূল্যায়ান 'আসলে ফেম্যাঙ্গো আমার সবচেয়ে প্রিয় কাব। সেই শৈশব থেকে শুরম্ন করে ক্যারিয়ারে অনত্মিম লগ্নে এসেও খেলেছি আমি। এই কাবের কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারব না। কাবের জন্য অনেক করেছি। আবার এখান থেকে অনেককিছু পেয়েছিও। এই কাবের হয়ে প্রত্যেকটি জয় যেন আত্মার সাথে মিশে যেত'। তাহলে অন্য কাবের জয়গুলো কেমন ছিল? সে জয়গুলোও মজার ছিল।

No comments

Powered by Blogger.