একুশের আমতলার ঐতিহাসিক সভার পুনর্নির্মাণ by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

কলকাতার 'স্টেটসম্যান' পত্রিকার (বাংলা সংস্করণ) সম্পাদক মানস ঘোষ আমার দীর্ঘকালের বন্ধু। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকেও তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কলকাতার ইংরেজী দ্য স্টেটসম্যানের প্রতিনিধি ছিলেন এবং '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় একেবারে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অবস্থান নিয়ে রণাঙ্গন থেকে তাঁর কাগজে যুদ্ধের রিপোর্ট পাঠাতেন।
একবার হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়তে পড়তে তিনি বেঁচে যান। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে (২১ ফেব্রুয়ারির আগে) তিনি একটি সেমিনারে বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে তাঁর সহকর্মী অচিন রায়কে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। একুশের স্মরণীয় রাতে তাঁরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মাঝরাত পর্যন্ত ছিলেন এবং আজিমপুর গোরস্তানে কয়েক ভাষা শহীদের সমাধিতেও গিয়ে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেছেন।
আমি তার আগেই লন্ডনে চলে এসেছি। মানস ঘোষ কলকাতায় ফিরে গিয়ে টেলিফোনে কথা বলার সময় আমাকে জানালেন, ঢাকায় একুশ তার আগেকার আকর্ষণ, প্রাণোন্মাদনা এবং বলিষ্ঠতা হারিয়েছে। বাহাত্তর এবং তেহাত্তর সালেও তিনি একুশে উদ্যাপনে যে গণপ্রণোদনা, উন্মাদনা এবং প্রতিবাদের ভাষা লৰ্য করেছেন, এখন তা নেই। এখন একুশ যেন কেবলই আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব একটি পর্ব। আজিমপুর গোরস্তানেও গিয়ে তাঁরা দেখেছেন, আগে একুশের রাতে যে গোরস্তান ছাত্র, যুবক, জনতায় ভরে যেত, শহীদদের কবর ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত হতো, এখন তা হয় না। তাঁরা প্রায় জনশূন্য গোরস্তানে গিয়ে ভাষা শহীদদের জীর্ণদীর্ণ সমাধিতে ফুলের স্তবক রেখেছেন।
মানস ঘোষের এ কথার জবাব তাঁর নিজেরও জানা। তাই আর কথা বাড়াইনি।
কোন আন্দোলনই তার পরিণতিতে পৌঁছে আগের গতিময়তা ও উন্মাদনা ধরে রাখতে পারে না। তা তখন আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত হয়। এ কথা একুশের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কেও সত্য। তুলনামূলক উদাহরণ টানতে চাইলে আমরা ভারতের স্বাধীনতা দিবসটির দিকে তাকাতে পারি। স্বাধীনতা লাভের আগে ভারতের স্বাধীনতা দিবস ছিল ৯ আগস্ট। ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট কংগ্রেস কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন শুরম্ন করার এ দিনটিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১৯৪৬-৪৭ সাল পর্যন্ত দিবসটি পালিত হয়।
আমার কৈশোরে অর্থাৎ অবিভক্ত ভারতে প্রতিবছর এ দিবসটি পালনে যে গণসম্পৃক্ততা ও গণউন্মাদনা দেখেছি, তা এখন কল্পনাই করতে পারি না। ৯ আগস্ট তারিখটি ভারতে জনজীবনে এখন বিস্মৃত। ১৯৪৭ সাল থেকে তাদের স্বাধীনতা দিবস হলো ১৫ আগস্ট এবং ২৬ জানুয়ারি তারিখ তাদের প্রজাতন্ত্র দিবস। ২৬ জানুয়ারি তারিখে ভারতের প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান পার্লামেন্টে গৃহীত হয়েছিল।
ভারতের স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবস_ দু'টি দিবসের অনুষ্ঠানেই একবার দিল্লীতে এবং আরেকবার কলকাতায় উপস্থিত থাকার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। বিস্মিত হয়ে দেখেছি ৯ আগস্টের স্বাধীনতা দিবস পালনের গণজোয়ার ও গণউন্মাদনা এখন স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবস দু'টি দিবসের অনুষ্ঠানেই অনুপস্থিত। এখন দু'টি দিবস পালনই সরকারী আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে।
ইতিহাস বহতা নদীর মতো। যে স্বতঃস্ফূর্ততা ও উদ্দাম গতি নিয়ে নদী গিরিগুহা থেকে বের হয়, সমতটে নেমে সেই অস্থিরতা ও উদ্দামতা সে হারায়। তখন সে শান্ত এবং ধীর প্রবাহিত জলধি। তার কোন কোন ধারা আবার মাটির শুষ্কতায় হারিয়ে যায়। ইতিহাসও নদীর মতো। সূচনায় তার যে শক্তি ও গতি, পরিণতিতে তা থাকে না। তার অনেক ধারা স্মৃতিবিস্মৃতির মাঝে হারিয়ে যায়। অনেক সময় বিকৃতি এবং বিভ্রমও তাকে গ্রাস করে।
এজন্যেই নদীর মতো ইতিহাসের অনেক সময় পুনর্খনন দরকার হয়; পুনর্নির্মাণ দরকার হয়। তার কোন কোন ধারাকে বিস্মৃতি ও বিকৃতি থেকে উদ্ধার করা দরকার হয়। একটি স্বাধীন এবং উন্নত জাতি তার জাতীয় প্রগতি ও অগ্রগতির স্বার্থেই এ কাজটি করে। তার তরুণ ও নতুন প্রজন্ম যাতে প্রকৃত ইতিহাস ভুলে না যায়; বিকৃত ও বিভ্রান্ত ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত না হয়, সেজন্যে তারা ইতিহাসকে রিক্রিয়েট বা পুনর্নির্মাণ করেন। কেবল বইয়ের ইতিহাস পাঠে কোন জাতির নতুন প্রজন্ম যতটা ইতিহাসসচেতন হতে পারে, পুনর্নির্মিত (রিক্রিয়েটেড) ভিস্যুয়াল ইতিহাস প্রত্যক্ষভাবে দর্শনে তারা সেই সচেতনতা আরও বেশি লাভ করে। তাদের মন থেকে অন্যদের দ্বারা সৃষ্ট ইতিহাস-বিকৃতি ও বিভ্রান্তি দূর হয়।
বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতিরও একটা গৌরবময় অতীত আছে। সংগ্রাম ও আন্দোলনমুখর সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ সঠিক ইতিহাসকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। দূরঅতীতের অনেক গৌরবময় গাঁথা বিস্মৃতির আঁধারে ডুবে গেছে। সাম্প্রতিক অতীতের অনেক সংগ্রামের ইতিহাসও (যেমন ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ) একশ্রেণীর অশুভ ও গণবিরোধী শাসকদল অথবা জোট মুছে ফেলার অথবা বিকৃত করার চেষ্টা করেছে। জাতীয় ইতিহাসে অনেক খলনায়ককে দেয়া হয়েছে নায়কের মর্যাদা এবং নায়কদের নাম মুছে ফেলায় অথবা কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে আমরা আমাদের গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের গতিময়তা এবং তার ইতিহাসকেও সুষ্ঠুভাবে রৰা করতে পারিনি। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি ফিরে আসে। কিন্তু মানস ঘোষের ভাষায়_ তাতে তার অতীতের প্রাণোন্মাদনা দেখা যায় না, একটা নিষ্প্রাণ আনুষ্ঠানিকতা যেন তাকে গ্রাস করে ফেলে। একুশের প্রতিবাদী ও আন্দোলিত কণ্ঠ আর শোনা যায় না। তার রক্তঝরা ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের প্রকৃত নায়করাও উৎসব, গানবাজনা এবং সরকারী-বেসরকারী অনুষ্ঠানের ঢাকঢোলের আড়ালে হারিয়ে যান।
স্বাধীনতা লাভের দু'তিন বছর পর থেকে এটাই হয়ে আসছে বাংলাদেশে। নতুন নতুন ভাষাসৈনিক, ভাষা আন্দোলনের 'তমদ্দুনি জনকেরও' আবির্ভাব হয়েছে মাঠে। যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে হয়েছে একজন 'স্বাধীনতা ঘোষকের' আবির্ভাব। হয়ত একদিন দেশের সুস্থ ও মুক্তবুদ্ধির ইতিহাস-গবেষকদের কল্যাণে আমাদের জাতীয় ইতিহাস সর্বপ্রকার বিকৃতি ও বিভ্রান্তিমুক্ত হবে; তবে সে দিনটি এখনও দূরে। স্বাধীনতার ইতিহাস দূরে থাক, আমাদের ভাষা আন্দোলনেরও একটি সম্পূর্ণ ও সঠিক ইতিহাস এখনও তৈরি হয়নি। যেটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নামে কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত, সেটিও অসম্পূর্ণ এবং পক্ষপাতদুষ্ট। গবেষণার নামে কিছু লোকের ডায়েরি ও স্মৃতিকথা টুকে লেখা।
ইতিহাসকে ধরে রাখা এবং তা তরম্নণ ও নতুন প্রজন্মের মনে সর্বক্ষণিকভাবে জাগিয়ে রাখার জন্য উন্নত দেশগুলোতে সরকারী-বেসরকারীভাবে অবিরাম নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, প্রতিষ্ঠা করা হয় জাদুঘর, গবেষণা ইনস্টিটিউট, লেখা হয় শিশুপাঠ্য থেকে শুরু করে বয়স্ক-পাঠ্য পর্যন্ত অসংখ্য ইতিহাস, শুধু লেখালেখি ও গবেষণার মধ্যেই এ কাজ সীমাবদ্ধ থাকে না; তার ভিস্যুয়াল বা চোখে দেখার ইতিহাস এবং ওরাল ইতিহাসও তৈরি করা হয়।
হিটলারের ইহুদী নিধনের গ্যাস চেম্বারগুলোর কথা এতদিনে হয়ত কেবল ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যেত, ইউরোপের নতুন প্রজন্ম তা মনে রাখত না। যদি এ ভয়াবহ গ্যাস চেম্বারগুলোকে আগের মতো সংরক্ষিত রেখে মিউজিয়ামে পরিণত করা না হতো। জার্মানির আউসবার্গ আর মিউনিক শহরের মাঝামাঝি একটি স্থানে এ রকম একটি সংরক্ষিত গ্যাস চেম্বার আমি দেখেছি। চেম্বারের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে অসংখ্য দর্শকের মতো আমারও মনে হয়েছে, আমি যেন জার্মানিতে চল্লিশের গোড়ার দশকের সেই ইহুদী হত্যার ভয়াবহ ঘটনা নিজের চোখের সামনে দেখছি।
পুরনো ইতিহাসকে চোখের সামনে জীবন্ত করে তুলে ধরার জন্য ক্যামেরার সাহায্যে পুরনো ঘটনাকে আবার নতুন করে রিক্রিয়েটও করা হয়। ইউরোপের মিলিত শক্তিগুলোর সঙ্গে নেপোলিয়নের যুদ্ধ হয়েছিল।
১৮১৫ সালে। যে যুদ্ধ ওয়াটারলুর যুদ্ধ নামে বিখ্যাত। এ যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হয়েছিলেন। এ বিশ্ববিশ্রুত যুদ্ধের কথা যদি কেবল ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকত, তাহলে কবে তা মানুষ ভুলে যেত। কিন্তু ব্রাসেলস শহর থেকে পনেরো-বিশ মাইল দূরে ওয়াটারলুতে এ যুদ্ধের শুধু মিউজিয়াম তৈরি করে রাখা হয়নি, পুরো যুদ্ধটি ক্যামেরার সাহায্যে রিক্রিয়েট করে তিন ঘণ্টা ধরে তা পর্দায় দেখানো হয়।
এতকাল পরে তো তখনকার সৈন্যবাহিনী, তাদের ঘোড়া, অস্ত্র, পোশাক আর পাওয়া যাবে না। তাই সে যুগের সবকিছুই অবিকল তৈরি করা হয়েছে। নকল যুদ্ধটি ঘটানো হয়েছে ওয়াটারলুর রণাঙ্গনেই। পর্দায় সেই যুদ্ধের ছবি দেখে মনে হয়েছে যুদ্ধের মাঠের কিছু দূরে বসে এ ঐতিহাসিক যুদ্ধটি চোখের সামনে দেখছি। আমি যেন ওয়াটারলুর যুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
সবচাইতে মুগ্ধ হয়েছি ১৯৭২ সালে ভারতে বেড়ানোর সময় পুরনো দিলস্নীতে মোগল আমলের ঘটনার লাইট এ্যান্ড সাউন্ডের অনুষ্ঠান দেখে। মোগল সম্রাটদের পত্নীরা তাদের দামী বাঁদিদের নিয়ে প্রাসাদের বাইরে মাসে একদিন বিসত্মীর্ণ এলাকাজুড়ে মীনাবাজার বসাতেন। সেখানে পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না। লাইট এবং সাউন্ডের সাহায্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সপ্তাহে একদিন রাতের বেলা এ মীনাবাজার রিক্রিয়েট করতেন (এখন করা হয় কিনা জানি না)। আমি এক রাতে সম্রাট শাহজাহানের দেওয়ানে খাসের চত্বরে বসে ছায়া শব্দ আলোর খেলা দ্বারা তৈরি এ মীনাবাজার দেখেছি। এমনকি মোগল বেগমদের টুকটাক কথার আওয়াজ কানে এসেছে। মোগল যুগের একটি ইতিহাসের অধ্যায় যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখেছি।
এতক্ষণ ধরে যে এত কথা লিখলাম তার কারণ, এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে সরকারী উদ্যোগে নয়, বেসরকারী উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় বায়ান্নর একুশের সেই ঐতিহাসিক সভাটি রিক্রিয়েট করার চেষ্টা হয়েছিল। বর্তমানের একুশের প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতার বদলে বায়ান্নর একুশের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের ছবিটি অর্ধশতকেরও বেশি সময় পরে আবার দেশের নতুন প্রজন্মের চোখে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তখনকার ভাষাসৈনিকদের যাঁরা জীবিত আছেন এবং যাঁদের পাওয়া গেছে তাঁদের এ অনুষ্ঠানে আনা হয়েছিল।
এ মহৎ কাজটির উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিক এবং একটি টেলিফোন কোম্পানি। এ দৈনিকটির ভূমিকা এবং ফোন কোম্পানিটির কার্যকলাপ সম্পর্কে অনেকের মতো আমারও যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে এবং প্রায়ই আমার লেখায় আমি তাদের সমালোচনা করি। কিন্তু বায়ান্নর একুশের পুনর্নির্মাণ করে এ প্রতিরোধ ও সংগ্রামের দিনটিকে দেশের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার ব্যবস্থা করে এ দৈনিক পত্রিকা ও টেলিফোন কোম্পানিটি যে একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে সে কথা স্বীকার করতে আমার কোন দ্বিধা নেই। আমার সাংবাদিক বন্ধু মানস ঘোষের ভাষায়, যে একুশে ক্রমশ প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত হচ্ছে, তার অতীতের বিস্মৃত সংগ্রামী রূপকে আবার জাগ্রত করা এবং ভাষা আন্দোলনে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা অবশ্যই একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন।
ওয়াটারলুর যুদ্ধের মতো ক্যামেরায় অতীতের পুনরুজ্জীবন ঘটানো কিংবা মোগল বেগমদের মীনাবাজার লাইট এ্যান্ড সাউন্ডের দ্বারা আবার পুনর্নির্মাণের মতো যদি বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি অনুরূপ ব্যবস্থায় জীবন্ত করে তোলা যেত তাহলে আরও ভাল হতো। যা হোক প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে যা করা হয়েছে, তাকেও অভিনন্দন জানাতে হয়। ভবিষ্যতে দেশের সরকার যদি এসব করার দায়িত্ব নেয় এবং শুধু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি নয়, '৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনা, ২৫ মার্চের গণহত্যার কালরাতের এবং ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা নিয়ে ডকুমেন্টারি ছবি তৈরি এবং লাইট এ্যান্ড সাউন্ডের অনুষ্ঠানের মতো অনুষ্ঠানের নিয়মিত ব্যবস্থা করেন, তাহলে দেশকে ইতিহাস বিকৃতি থেকে রৰা এবং সেই বিকৃতির প্রভাব থেকে তরম্নণ প্রজন্মকে মুক্ত করা ও মুক্ত রাখার ব্যাপারে সরকার সত্যই একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে।
লন্ডনে প্রতিবছরই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার (এমনকি প্রথম মহাযুদ্ধেরও) দিনটি পুরনো দিনে ফিরে যাওয়ার মহড়ার মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। দুই মহাযুদ্ধের যেসব যোদ্ধা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁরা সেই পুরনো দিনের যুদ্ধপোষাক ও অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজপথে কুচকাওয়াজ করেন এবং কুইন তাদের স্যালুট নেন। এ ভ্যাটার্নদের নানা সম্মানে ভূষিত করা হয়।
বাংলাদেশে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রবীণ এবং বিশিষ্ট ভ্যাটার্নদের প্রতিবছর সরকারী উদ্যোগে এক সঙ্গে মিলিত করে নানা ধরনের সম্মান দেয়ার প্রথাটি প্রবর্তিত হওয়া আবশ্যক। ভাষা আন্দোলনের কোন কোন জীবিত প্রবীণ নেতা গুরম্নতর আর্থিক সঙ্কটে ভুগছেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের কথা উল্লেখ করতে পারি। তাঁর এখন উপযুক্ত চিকিৎসা দরকার। সরকারের এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
নেহেরু একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, প্রকৃত ইতিহাসের বিকৃতি দূর করতে হলে তার পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন। এ কথা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কেও প্রযোজ্য। কেবল কালি-কলম দ্বারা প্রকৃত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখলেই চলবে না, একজন নিরক্ষর মানুষও যেন সেই ইতিহাস জানে ও বোঝে সেজন্যে ভিসুয়াল ইতিহাসও নির্মাণ এবং পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারী উদ্যোগের অনুপস্থিতিতে অন্তত বেসরকারী পর্যায়ে একটি জাতীয় দৈনিক এবং একটি টেলিফোন কোম্পানি যে বায়ান্নর একুশের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার মাঠে সাধারণভাবে আবার যথাযথ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন, এজন্যে তাদের অভিনন্দন জানাই। তারা এ ধরনের আরও উদ্যোগ গ্রহণ করম্নন।
লন্ডন, ৯ মার্চ, মঙ্গলবার ॥ ২০১০।

No comments

Powered by Blogger.