দিনগুলো রক্তাক্ত হলো কেন? by মমতাজ লতিফ

ফেব্রুয়ারি ও আগস্ট মাসকে আঘাত-আক্রমণের মাস হিসেবে বেছে নিয়েছে বাঙালীর স্বাধীনতা ও উন্নয়নের বিরোধী চক্র! কেন, ২১ ফেব্রুয়ারির শোকের মাসটিতেই বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যের নায়কেরা ও পরিকল্পকেরা সারাদেশের সব বিডিআর স্থাপনায় বিদ্রোহ সংঘটিত করার মাধ্যমে দেশে একটি চরম বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল এবং পুরোপুরি '৭১-এর আলবদরদের কায়দায় দেশপ্রেমিক,
জঙ্গী, সন্ত্রাসী নির্মূলে বদ্ধপরিকর অতি মেধাবী ও দক্ষ সেনা কর্মকর্তাদের খুন, নির্যাতন, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করেছিল? ভাষা শহীদদের শোকের মাসটিকে আবারও ওই একই গোষ্ঠী ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির সেনা শহীদের মাসে পরিণত করল কেন? সন্দেহ নেই, এদের কাছে
মাতৃভাষা বাংলা অনাদৃত, হিন্দুর ভাষা হিসেবে চিহ্নিত এবং পাকিস্তানী উর্দুভাষাই বেশি আদৃত। একই চিন্তা ও ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে এরা বাঙালীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্মারক, বেদি-মিনার, সৌধ স্থাপনাকে হিন্দুয়ানী মূর্তি পূজার অনুকরণ গণ্য করে লোকসঙ্গীত যাত্রা, মেলা, অভিনয় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোকেও পরিত্যাজ্য বিবেচনা করে।
প্রকৃত পৰে মাতৃভাষার সম্মান রৰার তাগিদ থেকে '৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালীর আত্মদানের মধ্যে দিয়ে বাঙালী তার আত্মপরিচয় হিসেবে মাতৃভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করার পর থেকে দেহে বাঙালী কিন্তু মনে উর্দু পাকিস্তানপ্রেমিক চক্র ওই '৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিকে শত্রু গণ্য করেছে। কাকতালীয়ভাবেই হয়তো বিডিআরের দরবার ফেব্রম্নয়ারি মাসেই নির্ধারিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার শুধু নয়, জঙ্গী ও মৌলবাদী সন্ত্রাসী নির্মূলে ভূমিকা রাখা সেনারাও এই মহান ভাষা শহীদের মতই বাংলা, বাংলার স্বাধীনতা ও এর কৃষ্টি বিরোধীদের চরম আঘাতের মুখে পড়েছে। নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুত থাকার কারণে ৫৭ জন সেনা ও অন্যরা শহীদ হলো। ফেব্রুয়ারি মাস জাতির শ্রেষ্ঠ সনত্মানদের রক্তে ভিজে, তাদের আত্মোৎসর্গে নিবেদিত মৃতদেহের ভারে আরও ভারি হয়ে উঠল। ২০০৯ এর ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি '৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরের মতই জাতিকে দেশপ্রেমিক সেনাশূন্য করার গভীর এক ষড়যন্ত্রের কথাই চিরকাল স্মরণ করিয়ে দেবে! '৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর ছিল জাতিকে পরিকল্পিতভাবে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস আর ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর দরবারে একত্রিত হওয়া দেশপ্রেমিক মেধাবী, সাহসী, দৰ জঙ্গী ও মৌলবাদীবিরোধী সেনা কর্মকর্তা হত্যা দিবস।
ফেব্রুয়ারির এই নিরস্ত্র শহীদদের রক্তে ভেজা ২৫কে ২১ ফেব্রুয়ারির মতই জাতি কখনও ভুলবে না।
অন্যদিকে ১৯, ২০ ফেব্রম্নয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঘাইছড়িতে নিরীহ আদিবাসীদের ওপর অনেকের মতে সেটলার বাঙালী ও সেনা পোশাকধারীদের দ্বারা গুলিবর্ষণে নিহত হয় বেশ কয়েকজন পাহাড়ী নারী-পুরুষ, এদের কেউ কেউ নিখোঁজ আছে। পাহাড়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে পাহাড়ীদের গ্রাম, পরে আক্রান্ত হয়েছে বাঙালী সেটলারদের কিছু বাড়িঘর। পাহাড়ীদের খাদ্য, সামান্য বস্ত্র, তৈজসপত্র, অর্থ লুট হয়েছে। জানা যাচ্ছে, পাহাড়ে খালেদা-নিজামী জোট আমলে যে দুর্বৃত্তদের উত্থান ঘটেছিল তারা ও তাদের প্ররোচনায় গড়ে ওঠা শান্তিচুক্তিবিরোধী সংস্থা ইউপিডিএফ বাঙালী সেটলাররা কিছু গুজব পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিয়ে এই দাঙ্গা, অগি্নসংযোগ, লুট এবং খুনের ঘটনা সংঘটিত করেছে। এই ঘটনায় সেনাপোশাকধারীদের গুলিবর্ষণের তথ্যও জানা গেছে। এ ঘটনাটিও রাষ্ট্র ও জাতি বিধ্বংসী একটি ষড়যন্ত্রের অংশ এতে কোন সন্দেহ নেই। যারা শানত্মি বিনষ্টকারী অপকর্ম করে, তারা সরাসরি সরকারবিরোধী অবস্থানে রয়েছে, এত বলা বাহুল্য। কারা, কাদের দ্বারা এই কু উদ্দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে তা তদনত্মে নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে। তবে একটি সোজা হিসাব, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা দেশের অন্য জেলার মতই আইনশৃঙ্খলা রৰাকারী নিরাপত্তা বাহিনী যেমন_ পুলিশ, বিডিআর (সীমান্তরৰী), জেলা-উপজেলা প্রশাসন, আদালত এবং উপজাতি কাটারি পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় পরিচালিত হতে কোন বাধা নেই। সেটলার বাঙালী যেহেতু পরিকল্পিতভাবে নদীভাঙ্গা ও উপকূলীয় এলাকা থেকে এদেরকে পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ট্রাকে করে নিয়ে গিয়ে বসতি স্থাপন করানো হয়েছিল সুতরাং দরিদ্র এসব মানুষ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তাদের স্ব স্ব জেলার খাসজমিতে অথবা একটি বাড়ি, একটি খামার ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের অধীনে তাদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেওয়া হলে, তারা তা গ্রহণ করবে বলেই ধারণা করি। '৮০-এর দশকের সরকারী নীতিমালা সময়ের প্রেৰিতে অনুপযুক্ত হয়ে পড়তেই পাবে এবং সেহেতু সরকারী নীতিমালাও পরিবর্তিত হতে পারে এটা তারা বুঝবে বলে মনে হয়। তবে নেপথ্যে যারা কলকাঠি নেড়ে পাহাড়ীদের জানমালের ৰয়ৰতি করে সরকারকে নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিতে চায় তদন্তের মাধ্যমে তাদের পরিচয় উদঘাটিত হলে তবেই তারা এ অপকর্ম থেকে হতে নিবৃত্ত হতে পারে। সরকারকে শান্তিচুক্তির মূল বিষয় ভূমিজরিপ ও মালিকানা নির্ধারণের কাজও দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
বিরোধ সৃষ্টির উৎসমুখ বন্ধ করতে হবে।
এরপর ফেব্রুয়ারির রক্তধারা ২৩ ফেব্রম্নয়ারি আবারও সৃষ্টি করা হলো এবং অকারণে চরম অবহেলার উদাহরণ হিসেবে গরিব ও গরিব গার্মেন্টের ২১ জন তরুণ-তরুণী শ্রমিক আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হলো। এ সমস্যা চলমান এবং বিজিএমইএ প্রতিটি ঘটনার পর প্রতি শ্রমিক হত্যার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে তাদের দায়িত্ব শেষ করে। টাকা দিয়ে কি কোন প্রাণের মূল্য হয়? হতো, যদি এ সংস্থায় নিবন্ধিত সব গার্মেন্টের অগি্ননির্বাপণ ব্যবস্থা সচল ও উন্নত করা হতো, কারখানা থেকে বের হওয়ার সিঁড়ি ও গেট উন্মুক্ত রাখার ব্যবস্থা থাকত এবং এমন নীতি থাকত যে সে স্থানে অনেক মানুষের সমাবেশ আছে তা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করা নিষিদ্ধ হবে কেননা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকলে বিপদে মানুষ দ্রুত সে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে পারে। আমরা সাধারণ নাগরিকেরা কাজের মানুষ বাসাবাড়িতে একা থাকলে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করা নিষিদ্ধ এবং অমানবিক বলে মনে করি। এৰেত্রে কয়েক শ' শ্রমিকের কর্মস্থলের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ থাকবে কেন এবং কোন নীতিতে? এ প্রশ্ন বিজিএমইএ'র প্রতি। ফেব্রম্নয়ারি ২০০৯ ও ২০১০-এর এসে রক্তে ভিজে, লাশের ভারে এত ভারি হয়ে উঠেছে যে, ফেব্রুয়ারি আজ আমাদের জন্য রোদনের মাসে পরিণত হয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.