জীবন কথন- আছো কি প্রভু তুমি আপন আসনে- রণজিৎ বিশ্বাস

অনেক মানুষ, অনেক সহকর্মী, অনেক সহপাঠী, অনেক পার্শবর্তী, অনুবর্তী ও অগ্রবর্তীজন আমাকে অনেক ঠকা ঠকিয়েছে, অনেক ভুগিয়েছে। তাদের কাউকে চিনি, কাউকে চিনি না, কাউকে কখনও চিনতেও চাইনি, কাউকে না চেনার জন্য কোন দুঃখও নেই।
তবে, সত্য এই_ এদের কারও তি আমি করিনি। সে রুচি আমার হয়নি। রা জায়গায় জায়গায় বসে অথবা একটি কিংবা দু'টি বাড়িতে বসে বিশেষ বিশেষ তালিকায় আমার নাম তুলেছে ও বিশেষ বিশেষ তালিকা থেকে আমার নাম কেটেছে।
এদের সবাই আমাকে সমান দুঃখ দেয়নি। কেউ কেউ তো আমাকে দুঃখ দেয়ার অধিকারই পায়নি। কিন্তু, একজন সামান্য পেয়েছিল এবং সেই খুব বড় একটি কোপ মেরেছে। তার নিজের কি লাভ হয়েছে, সে-ই জানে; তবে সে অসামান্য এক অমানবিক তি করার পর এখন ছদ্মবেশী হয়ে বসে আছে এবং জায়গা মতো বসা ও ভাগ্য নির্ধারক হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে বোকা বানিয়ে অথবা ভজে ও ভেজে বাছা জায়গায় বসার কোশেশ করছে। কোশেশে সফলও হয়ে যাচ্ছে। আমার কিছু বলার নেই। তার ক্ষতি করার কোন রুচি আমার ভেতর তৈরি নেই। সে ভাল থাকুক। নষ্ট লোকদের কোন লাভ ও দেশের কোন ক্ষতি যেন তার দ্বারা না হয়।
আমার কাসরুম ফ্রেন্ড। একদিন ভোররাতে চাটগাঁ থেকে বাসে চেপে কুমিল্লা বোর্ডে গিয়েছিলাম। এসএসসি ও এইচএসসির প্রভিশনাল সার্টিফিকেট তোলার জন্য। মূল সার্টিফিকেট তখনও আমরা পাইনি। কিন্তু ও দুটো পরীা যে পাস করেছি, তার প্রমাণ দরকার। বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য। আমরা তখন মাস্টার ডিগ্রীর জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে লড়ছি। আমাকে লড়তে হচ্ছিল তিনটি টিউশনি ও পত্রিকায় চাকরি করে। দরিদ্রদের মধ্যে যে দরিদ্রতম, তাকে তো এমন করতেই হবে।
সার্টিফিকেট নিয়ে আমরা মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ফিরলাম। দু'জনই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। সে য়ুনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষায় ভাল ফল করে লেকচারার হওয়ার চেষ্টায় শ্রমী মনোযোগী ও কৌশলী কুশলী হয়ে ওঠায় পরীক্ষা দিল না, আমি দিলাম, পাস করলাম ও চাকরি পেলাম। সে লেকচারার হলো, তারপরও পরের বছর পরীক্ষা দিল, পাস করল ও চাকরি পেল এবং পেয়ে আমার অনুবতর্ী হলো। অনেক জনের অনুবর্তী। ইতিহাসে এমন ঘটনা নতুন নয়, অনেকবার ঘটেছে।
আমার চাকরি জীবন হলো আলোছায়ার চৌখুপিতে ভরা এক দাবা ছক। ওরটি তেমন হলো না। ওর ক্যারিয়ারে আলো থাকল, ছায়াও থাকল_ তবে অন্ধকারের ছায়া নয়; সহায়তার ছায়া, সময়মতো সমর্থনের ছায়া।
ধীরে ধীরে আমরা দূরে গেলাম। খুব কাছে আমরা কখনও ছিলাম না, এবার ক্রমে ক্রমান্বয়ে বড় দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। চাকরি সূত্রে ভৌগোলিক দূরত্বও, আন্তর্জাতিক দূরত্বও। সমান্তর না হওয়ার কারণে মনের দূরত্বও।
এই দূরত্বের একটা পর্যায়ে তার কিছু স্থানিক ও অবস্থানিক সুবিধা তৈরি হলো। আমাকে তখন 'জোটকদলী' নামের একটি পুনর্মুদ্রিত গল্পের সূত্র ধরে কিছু ইডিয়ট ও কীটানুকীট ভোগাচ্ছে। ভোগাচ্ছে কিছু অশিতি ও ঈর্ষাতুরের অস্থির প্ররোচনায়। যারা গল্পটি পড়েও দেখেনি, পড়ে দেখলেও বোঝেনি অথবা বস্তুটি কি খাওয়ার না গায়ে মাখার অনুমানও করতে পারেনি, কিন্তু আমার তি করার জন্য ও আমার কষ্টার্জিত, স্বেদার্জিত ও শ্রমনির্মিত ক্যারিয়ারের দ্বাদশ ঘটিকা বাজাবার জন্য এক পায়ে খাড়া হয়ে গেল, তাদের মধ্যে সেও শামিল হয়ে গেল। কেন হয়ে গেল, কেন এমনটি হওয়া সে জরুরী মনে করল, সে-ই জানে।

নষ্ট লোকদের এবং সামপ্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রভুদের নিয়ে ঠাসা বিশেষ একটি বাড়িতে বসে বার বার সে আমার তি করতে থাকল। দুর্দিনে-দুঃসময়েও 'জোটকদলী' (একটি গ্রামীণ কুসংস্কারকে আঘাত করে লেখা গল্প) আমাকে দোষী প্রমাণ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এক 'মানবসন্তান' এর বিচারে-বিবেচনায় আমি সফেদ হয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। বিলম্বে হলেও একটি কাগজ আমি হাতে পেলাম, যার শেষ বাক্য ছিল ব্যক্তিগত শুনানি, উপস্থাপিত কাগজপত্র ও তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আনীত অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হলো।
নিঃশর্ত মুক্তি। নষ্ট মানুষের অভিভাবকত্বের কালে ও কালসময়ে যে মুক্তি আমার কিছুতেই পাওয়ার কথা নয়, সেই মুক্তি। কিন্তু, মুক্তি জুটল কাগজে, ওদের অন্তরে নয়। মুক্তি না জুটলেও যে পরিণতি আমার হতো, জোটার পরও তাই হলো। পর পর চার বার কাটা পড়ার সময়েও, ভয়াল ভয়াবহ সেই সময়েও, আমার নাম একটি তালিকায় ঢুকে একটি বিশেষ জায়গা থেকে একটি বিশেষ বাড়িতে অনুমোদনের শেষ স্বারের জন্য গিয়েছিল। তালিকাটি প্রমোশনের তালিকা। উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব হওয়ার তালিকা। আমার ঐ 'কাসরম্নম ফ্রেন্ড' শ্রমজীবনে আমার অনুবর্তীজন সেই বাড়িতে সুবিধাজনক চেয়ারে বসে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে ও উপাসনার আন্তরিকতায় আমার নাম বার বার কাটিয়েছে। যারা নাম কেটেছে তাদের কাছে সংসারের সবচেয়ে বড় বিস্ময় ঝেড়ে দিয়ে সে বলেছে_ 'ও কি করে প্রমোশন পায়! ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে যাবে। ওকে বাদ দিতেই হবে।' যেন 'ও' প্রমোশন পেলে সংসার টলে যাবে। কাউকে কাউকে সে বলেছে_ যতদিন আছে এ সরকার ওর এগুবার দরকার নেই। এগুতে সে পারবে না। এগুতে তাকে দেয়া হবে না। বলতে শুধু বাকি রেখেছিল, আমিই বাধা দেব। স্রোতের আড়ে বাঁধ হয়ে শুয়ে থেকে আমিই রুখব। যদ্দিন আমি এখানে আছি, আমিই সব সামলাব, আমিই ওর 'মৃত্যু' নিশ্চিত করব।
এখনও সে দিব্যি আছে। ঈশ্বর ওর কল্যাণ করুন, যদি তিনি তাঁর আসনে থাকেন। 'তুমি কি তোমার আসনে আছো প্রভু!'
লেখক : শ্রমজীবী কথা সাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.