কারিগরি শিক্ষার নামে ॥ রমরমা বাণিজ্য! by বিভাষ বাড়ৈ

'এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না, এটা একটা টর্চার সেল। আমরা আগে জানতাম না শিৰার নামে এখানে কেবল অর্থ আদায় করা হয়। হাজার হাজার টাকা নিয়ে ভর্তি করিয়ে একেক সময় একেক কথা বলে ফি আদায় করা হয় এখানে।
জরিমানা হিসেবে হাজার হাজার টাকা আদায়ের জন্য ইচ্ছাকৃত পরীক্ষার্থীদের ফেল দেখানো হয়। প্রতিবাদ করলে অথবা অভিভাবকদের জানালে কাসে নানা ছুঁতোয় লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো হয়। আমার মতো অনেক ছাত্রী অধ্যৰের বর্বরতার শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। ছাত্ররা অহরহ বর্বরতার শিকার হচ্ছে।'
নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন রাজধানীর বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক ছাত্রী। মহাখালীর কলেরা হাসপাতালের বিপরীত দিকে অবস্থিত কলেজের পাশে এক রেসত্মরাঁয় বসে ঐ ছাত্রী যখন প্রতিষ্ঠানের শিৰার নামে চলা উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরছিলেন তখন পাসে ছিলেন তার সহপাঠীরা। ব্ধকণ্ঠে বললেন, অনেকের পিঠে ও কাঁধে এখনও আছে নির্যাতনের চিত্র। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে রৰা পেতে এই কলেজ থেকে কেউ চলে যেতে চাইলেও শীঘ্র ছারপত্র দেয়া হয় না। তার পরেও কর্তৃপৰের রোশানল থেকে বাঁচতে ছারপত্র ছাড়াই চলে গেছেন অনেক ছাত্রছাত্রী।' জানা গেল, কারিগরি শিৰা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে এভাবেই চলছে দেশের প্রথম বেসরকারী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ৪ বছর মেয়াদী ডিগ্রীদানের নামে চলছে বেপরোয়া শিৰা বাণিজ্য। এদিকে জনকণ্ঠের অনুসন্ধনে কেবল এই প্রতিষ্ঠানেই নয়, বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য কারিগরি শিৰা প্রতিষ্ঠানের শিার আড়ালে চলা অবৈধ শিা বাণিজ্যের চিত্র। ক্যাম্পাস, শিক, লাইব্রেরী বলতে গেলে কিছুই নেই। তবুও ভাড়া করা বাড়ির এক-দু'কৰে আকর্ষণীয় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চলছে ব্যবসা। টাকা হলেই ভর্তি, ভর্তির সময় উচ্চতর ডিগ্রীধারী ব্যক্তিদের শিৰক হিসেবে দেখিয়ে আকর্ষণীয় প্রসপেক্টাস ধরিয়ে দেয়া, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বেতন ভাতার ফিরিসত্মি, কাস না করিয়ে কোর্স শেষ। খেয়াল খুশিমতো পরীা গ্রহণ। যত টাকা তত পাসভিত্তিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন আর ডিগ্রী দান। এভাবেই বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে কারিগরি শিৰাদানের নামে দেশব্যাপী চলছে বাণিজ্য। জাতীয় শিৰা জরিপেও বেরিয়ে এসেছে কারিগরি শিৰার নৈরাজ্যের আরেক চিত্র। কারিগরি বোর্ড থেকে এ পর্যনত্ম অনুমোদন নেয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪ হাজার ৫১৩। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা যায় এমন প্রতিষ্ঠানের অসত্মিত্ব পাওয়া গেছে ৩ হাজার ৩৪৩। ফলে জরিপের পর রীতিমতো প্রশ্নের মুখে পড়েছে কারিগরি বোর্ডের অনুমোদন পাওয়া প্রায় ১২ শ' শিৰা প্রতিষ্ঠানের অসত্মিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে।
দেশে কারিগরি শিৰা প্রসারের লৰ্যে কারিগরি শিৰা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে কম্পিউটার কোর্সসহ ৪ বছর মেয়াদী ডিপেস্নামা ইন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপেস্নামা ইন ভোকেশনাল এডুকেশন, ডিপেস্নামা ইন টেকনিক্যাল এডুকেশন, ডিপেস্নামা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপেস্নামা ইন এ্যাগ্রিকালচার বিষয়ে বেসরকারী উদ্যোগে শিৰা কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। মান বজায় রাখতে একটি নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু অভিযোগ, শক্তিশালী সিন্ডেকেট চক্রের কবলে কারিগরি শিৰা বোর্ড। সংঘবদ্ধ অসাধু চত্রের কাছে অসহায় খোদ এর চেয়ারম্যানও। তাকে থোরাই কেয়ার করে শিৰা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ও কোর্স স্বীকৃতি নিয়ে এখানে চলছে ঘুষ বাণিজ্য। বছরের পর বছর ধরে ঘুষের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠান ও কোর্স অনুমোদন নিচ্ছেন মালিকরা। সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে কারিগরি শিৰা বোর্ডে আবেদন করলেই পাওয়া যায় অনুমোদন। নীতিমালা আর যোগ্যতার প্রয়োজন নেই, ঘুষ দিলেই সব হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। অন্যদিকে অনিয়মের মাধ্যমে অনুমোদন নিয়েই সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বেসরকারী কারিগরি শিৰা প্রতিষ্ঠান নামধারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আবার আয়-ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ভর্তির সময় অর্ধশতাধিক সুযোগ-সুবিধার কথা বলে গণহারে শিার্থী ভর্তি করিয়ে শিৰার নামে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
সরকারের সংশিস্নষ্ট দফতর ও বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এই মুহূর্তে অনত্মত ২০ ধরনের কারিগরি ও ভোকেশনাল শিৰা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে। কারিগরি বোর্ড থেকে এ পর্যনত্ম অনুমোদন নেয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪ হাজার ৫১৩। কিন্তু ব্যানবেইস পরিচালিত জাতীয় শিৰা জরিপে এমন প্রতিষ্ঠানের অসত্মিত্ব পাওয়া গেছে ৩ হাজার ৩৪৩। ফলে জরিপের পর প্রশ্নের মুখে পড়েছে কারিগরি বোর্ডের অনুমোদন পাওয়া ১ হাজার ১৭০ শিৰা প্রতিষ্ঠানের অসত্মিত্ব। অসত্মিত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যাবে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের হিড়িক। যেখানে সারাদেশে সরকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৩৩৬, সেখানে বোর্ডের অনুমোদন নেয়া বেসরকারী কারিগরি শিৰা প্রাতষ্ঠানের সংখ্যা ৩ হাজার ৭। মোট শিৰার্থী ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৮৭১ । শিৰকের সংখ্যা ২৩ হাজার ৭৬৯ । ইনস্টিটিউট হিসিবে বিবেচনা করা যায় এমন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ১৭৩। এর মধ্যে সরকারী ৫০ এবং বেসরকারী ১২৩। টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ হিসেবে গ্রহণ করা যায় এমন প্রতিষ্ঠানের অসত্মিত্ব পাওয়া গেছে ৮০। এর মধ্যে সরকারী ৬৪ এবং বেসরকারী ১৬। ২৩ কমার্শিয়াল কলেজের অসত্মিস্ব পাওয়া গেছে; যার মধ্যে সরকারী ১৬ এবং বেসরকারী ৭। টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের সংখ্যা ৩৫। এর মধ্যে সরকারী ৩১ এবং বেসরকারী ৪। ১৫ সরকারী এবং ৯ বেসরকারী মিলিয়ে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট আছে ২৪। ২৮ সরকারী এবং ১২ বেসরকারী মিলিয়ে টেক্সটাইল ভোকেশনাল ৪০। এ্যাগ্রিকালচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট আছে ১০৪। এর মধ্যে সরকারী ১৩ এবং বেসরকারী ৯১। মেরিন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট আছে সরকারী একটি। এসএসসি ভোকেশনাল (স্বাধীন) সরকারী ১১ এবং বেসরকারী ১২৪। ৪৯৭ এইচএসসি ভোকেশনাল বি/ম্যানেজমেন্টের (স্বাধীন) ৪৮৮ বেসরকারী। মাত্র ৯ সরকারী। ১ হাজার ৪৫৩ এসএসসি ভোকেশনালের (সংযুক্ত) ১ হাজার ৪০৭ বেসরকারী। বাকি ৪৬ সরকারী। এইচএসসি ভোকেশনাল বি/ম্যানেজমেন্ট (সংযুক্ত) আছে ৭৭৪। এর মধ্যে ৪৮ সরকারী, বাকি ৭২৬ বেসরকারী।
অনুমোদন ছাড়াও বিভিন্ন কোর্সের সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। মিরপুরে সাইক ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজি বোর্ড অনুমোদিত নীতিমালার ৬০ ভাগ প্থরণ না করেই অনেকে কোর্স পরিচালনা করছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিরম্নদ্ধে বহুবার অভিযোগ উঠলেও সংশিস্নষ্ট কর্তৃপৰকে ম্যানেজ করে নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । যতবারই অভিযোগ উঠেছে সাংবাদিকদের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপৰ দাবি করেছে, দেশের কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে বেশি শর্ত পালন করছে। অনেকদিন ধরে শিৰার্থীদের প্রতিবাদ আর ৰোভের মুখে বন্ধ হয়ে আছে দেশের প্রথম বেসরকারী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামের এই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপৰের অবশ্য দাবি, সামনে পরীৰা তাই কেবল কাস বন্ধ আছে। গত সপ্তাহে ৪ দিন গিয়েও কলেজের দায়িত্বরত কাউকে পাওয়া গেল না। গেটে দারোয়ান তালা লগিয়ে বসে থাকেন সব সময়। সর্বশেষ সোমবার কলেজের পাশেই কথা হলো শিৰার্থীদের সঙ্গে। সমস্যার কথা বলতেই তারা ডেকে নিয়ে গেলেন একটু আড়ালে, এক রেস্টুরেন্টে। এক ছাত্রী বললেন, 'সামনে আমাদের পরীৰা। কর্তৃপৰের বিশেষত অধ্যৰ আব্দুর রহমান খানের বর্বর আচরণের কারণে এখানে শিৰার্থী ও অভিভাবকরা ভাল নেই। বাইরে থেকে মানুষ জানে না শিৰার নামে এখানে কি হচ্ছে? প্রত্যেকেই কর্তৃপৰের বিরম্নদ্ধে পরীৰায় ফেল করিয়ে জরিমানা হিসেবে হাজার হাজার টাকা আদায়, ইচ্ছামতো ফি বৃদ্ধি এবং অধ্যৰের বিরম্নদ্ধে কাসে পড়ালেখার ছুঁতো তুলে পুলিশ ব্যবহার করে লাঠি দিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। এর আগে সমপ্রতি সনত্মানদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন অনেক অভিভাবক। সোমবার দুপুরে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য কলেজের ভেতরে প্রবেশ করে পাওয়া গেল রেজিস্ট্রারের অফিসের কয়েক সহকারীকে। পরিচয় দিয়ে কর্তৃপৰের কাউকে পাওয়া যাবে কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, এই মাত্র রেজিস্ট্রার গিয়াস উদ্দিন স্যার শিৰা বোর্ডে চলে গেলেন। আর প্রিন্সিপ্যাল স্যার অসুস্থ, বাসায় আছেন। মোবাইল নম্বর নিয়ে রেজিস্ট্রারকে কল করা হলে তিনি বলেন, আমি এসব বিষয়ে কথা বলার দায়িত্বরত কেই নই। আমি কিছু বলতে পারব না শিৰা কার্যক্রম নিয়ে। আপনি অধ্যৰের সঙ্গে কথা বলুন, তিনি বাসায় আছেন। অধ্যৰের মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় টেলিফোনে কল করতেই তার স্ত্রী রিসিভ করে কি ব্যাপার বলে প্রশ্ন করলেন। বিষয় জানালে তিনি বলেন, তিনি বাসায় নেই, বোর্ডে গেছেন। কোন উপায় না দেখে অফিস সহকারীদের কাছে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, এখন আর পেটান না, আগে পেটাতেন। অন্যান্য অভিযোগের কথাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন কলেজের অনেক শিৰক। এদিকে কারিগিরি শিৰা নিয়ে চলা এই নৈরাজ্যকে কারিগরি শিৰা বোর্ডের দীর্ঘদিনের ঘুষ বাণিজ্যের ফল বলে মনে করেন সংশিস্নষ্টরা। বোর্ডের সাবেক এক চেয়ারম্যান জনকণ্ঠকে বলেন, গণঅনুমোদনই আজ কারিগরি শিৰার এই সঙ্কটের জন্য দায়ী। আমি সঙ্কটের সমাধান করতে পারিনি, বর্তমান চেয়ারমা্যন কতদূর পারবেন, তা নির্ভর করে সরকারের সহায়তার ওপর। তবে ইতোমধ্যেই এই সেক্টর চরম সঙ্কটে চলে গেছে। বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কাসেম ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের বলেছেন, অনুমোদনে অনিয়মের অভিযোগ আমাদের কাছেও আছে। তবে সমস্যা অনেকদিনের। তিনি বলেন, শিৰার স্বার্থে অনিয়মের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরম্নরী।

No comments

Powered by Blogger.