সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় শেষ ॥ হারিয়ে গেছে মূল্যবোধ, আইনের প্রয়োগ না থাকায় বাড়ছে খুন by তৌহিদুর রহমান

 পাড়ার বখাটেদের আড্ডা দিতে নিষেধ করেছিলেন তিনি। আর এই নিষেধের কারণে জীবন দিতে হয় সিলেটের প্রকৌশলী মেহরান সিদ্দিকী সজীবকে। বখাটেরা সিলেট নগরীর শিবগঞ্জ খরাদিপাড়ায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আড্ডা বসাত।
কখনও কখনও ছিনতাই করত। ফেনসিডিলও সেবন করত। এ কারণে তাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিল খরাদিপাড়ার মানুষ। তবে মুখ ফুটে কেউ প্রতিবাদ করতে পারত না। তাদের কাছে এক রকম জিম্মিই ছিল এলাকার মানুষ। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিলেন প্রকৌশলী সজীব। আর এ কারণেই গত ১০ ডিসেম্বর প্রকৌশলী সজীবকে কুপিয়ে হত্যা করে বখাটেরা।
রাজধানীর মিরপুরের ১০ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাড়ির ৫ তলায় একটি ফ্ল্যাটে সাদিয়া আফরিন তাঁর স্বামী মানিকের সঙ্গে ভাড়া থাকতেন। তিনি ১৬ জানুয়ারি নিজ ফ্ল্যাটে খুন হন। প্রতিবেশীরা থানায় খবর দেয়ার পরে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ মামলার আসামি মানিক মিরপুরের নিম ফ্যাশন নামে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। বর্তমানে মানিক পলাতক।
অপরদিকে রাজধানীর বড় মগবাজারের একটি আবাসিক হোটেলে চান মিয়া (৩৮) নামে আশুলিয়ার এক ব্যবসায়ী খুন হন। ২২ জানুয়ারি মগবাজারের একটি হোটেল কক্ষ থেকে তাঁর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে রমনা থানার পুলিশ। পরিবারের অভিযোগ, সময় মতো মুক্তিপণ না দেয়ায় অপহরণকারীরা চান মিয়াকে হত্যা করেছে।
এভাবে একের পর এক খুন হচ্ছে মানুষ। খুনের কারণও ভিন্ন ভিন্ন। নানা জনে নানা কারণে খুন হচ্ছে। কে কখন কিভাবে খুনের শিকার হবে, তা আগেভাগে জানতেও পারছে না। ফলে খুনের সংখ্যা বাড়ছে। আবার রাজনৈতিক কারণেও খুন হচ্ছে অনেকে। এমনকি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও খুন হচ্ছেন।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে সমাজের প্রতি কমিটমেন্ট ও নৈতিকতার অভাব দেখা দিয়েছে। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই সমাজে অস্থিতিশীলতা বাড়ছে। এ ছাড়া আইনের প্রয়োগ না থাকায় খুনের ঘটনা বাড়ছে। অনেক সময় খুনীরা জামিনে বেরিয়ে এসে খুনের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।
সমাজে বর্তমানে অস্থিরতা বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহবুবা সুলতানা জনকণ্ঠকে বলেন, সমাজের প্রতি সবার কমিটমেন্ট থাকা প্রয়োজন। তবে সেটা নেই বলেই খুন, ধর্ষণ, গুম ইত্যাদি ঘটনা ঘটছে। সমাজের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতাও বাড়ানো প্রয়োজন। তিনি বলেন, এসব নিয়ে আরও ব্যাপক আলোচনা, সেমিনার, ও গ্রুপ ওয়ার্ক হওয়া প্রয়োজন। যেন জনসচেতনতা বৃদ্ধি পায়। জনসচেতনতা বাড়লে সমাজে অস্থিরতা কমে আসবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মল্লিক জনকণ্ঠকে বলেন, সমাজে নৈতিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য রাষ্ট্রকেই ভূমিকা নিতে হবে। আর নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই এখন খুন, গুম ও ধর্ষণের মাত্রা বেড়েছে। যে কোন হত্যা ও গুমের বিপক্ষে আমরা। তিনি বলেন, তবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরও ট্রেন্ড পরিবর্তন হয়েছে। ক্রসফায়ার থেকে গুমে ডাইভার্ট হয়েছে। গুম, হত্যা বন্ধে সরকার থেকে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এসব বেড়ে যাবে। তখন দেশের ও সমাজের পরিণতি হবে ভয়াবহ। তাই গুম ও হত্যা বন্ধে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রতিবছর পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে। আবার বিভিন্ন স্থানে বেআইনী গুম, গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের নামেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ও ঘটছে। বিনা বিচারে আটক, পুলিশের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
গত বছর মাছরাঙ্গা টিভির বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনী খুন হন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ফার্মগেটসংলগ্ন পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় দৃর্বৃত্তদের হাতে তাঁরা নিহত হন। পরদিন সকালে তাদের হাত-পা বাঁধা, রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়।
গত ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধ চলাকালে পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে এলোপাতাড়ি মারধর ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। এই লোমহর্ষক ঘটনার সময় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। ২২ আগস্ট গভীর রাতে নিজ বাসায় খুন হন বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও বিএমএ নেতা ডা. নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাই।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, রাজনৈতিক, সামজিক, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় যতই বাড়বে, ততই খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ বাড়বে। তাই সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অবক্ষয় থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলেই সামাজিক অস্থিতিশীলতা কমে আসবে।

No comments

Powered by Blogger.