বারো খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধ কোষ, ৪২ বছর পর দূর হলো শূন্যতা- অমর একুশে গ্রন্থমেলা by মোরসালিন মিজান

একটি খুব বড় ঘটনা। নীরবে ঘটিয়েছেন মুনতাসীর মামুন। দেশের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ লেখক এবার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের কোষগ্রন্থ। একটি দুটি নয়, ১২ খ-ে এটি প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪২ বছর পর ব্যক্তি উদ্যোগে এমন কর্ম সম্পাদনের ঘটনা সত্যি বিরল। কোষগ্রন্থটি সম্পাদনার মাধ্যমে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দায় মেটানোর পাশাপাশি মুনতাসীর মামুন আবারও নিজের কমিটমেন্ট ও সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। এ গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পাঠককে মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ একটি ধারণা দেবে। সেই সঙ্গে রোধ করবে ইতিহাস বিকৃতি। স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ যখন এগিয়ে চলছে তখন কোষগ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ায় আলাদা সাড়া পড়েছে পাঠকমহলেও। সময় প্রকাশিত কোষ ইতোমধ্যে চলে এসেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। তারও আগে বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন অসংখ্য পাঠক। বাকিরা মেলায় গিয়ে সংগ্রহ করছেন।
এর আগে ২০০৫ সালে মুনতাসীর মামুনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ খ-ের মুক্তিযুদ্ধ কোষ। পরে আরও বৃহৎ আকারে কাজটি করার উদ্যোগ নেন তিনি। সহযোগী হিসেবে সঙ্গে নেন ড. মোহাম্মদ সেলিম, হাসিনা আহমেদ ও রিয়াজ আহমেদকে। সকলের আন্তরিকতায় ৮ বছর পর প্রকাশিত হলো ১২ খ-ের মুক্তিযুদ্ধ কোষ। এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবকটি দিক ওঠে এসেছে। প্রথম খ-ের বিষয়বস্তু ‘ঘটনা ও ব্যক্তি’। এতে ২শ’ ৮৮টি ঘটনা ও ব্যক্তির বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬শ’ ৯৬। দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয় ‘গণহত্যা গণকবর বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্র’। ৬শ’ পৃষ্ঠায় ৮শ’ ৭৬টি ভুক্তির মাধ্যমে এই খণ্ডে তুলে ধরা হয়েছে পাক বাহিনীর নির্মমতার চিত্র। তিনটি খণ্ডে পাওয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের ভূমিকা। এ অংশটি লেখা হয়েছে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ শিরোনামে। ২ হাজার ৩শ ৩৯ পৃষ্ঠায় বিধৃত হয়েছে ৮ হাজার ৭শ’ ৭৪ জন স্বাধীনতা বিরোধীর পরিচয় ও কুকীর্তি। অপর তিন খন্ডে এসেছে রক্তক্ষয়ী বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণনা। ১ হাজার ৭শ‘ ৫২ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে ১ হাজার ৪শ‘ ২৮টি যুদ্ধের ইতিহাস। কোষগ্রন্থের চারটি খ-ে বর্ণিত হয়েছে ৯ হাজার ২৫ জন শহীদের আত্মদানের ইতিহাস। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ২ হাজার ৬শ‘ ৪৮। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের আগে পরের অসামান্য দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে কোষগ্রন্থটিতে।
১২ খ- কোষগ্রন্থের মূল্য ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। একসঙ্গে পুরো ১২ খ- কিনলে ৩০ শতাংশ কমিশন পাবেন। আর আলাদা করে খন্ডগুলো কিনলে ২৫ শতাংশ ছাড়। বইটির ৫শ’ সেট মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। এখন সংগ্রহ করছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন।
ঐতিহাসিক এ কর্ম সম্পাদনের অনুভূতি প্রকাশ করে মুনতাসীর মামুন বলেন, এটি আমার জীবনের অনেক বড় কাজ। বইটির সম্পাদনার সময় মনে হয়েছে, নিজেই যেন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছি। এর পরের কথায় বেদনার সুর। তিনি দুঃখ করেই বলেন, এদেশে সবাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেন বটে। কাজ করে না। এ বইয়ের মাধ্যমে ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি ইতিহাসের অধিকার ফিরে পেতে চেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ কোষ সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এমন কাজ আর হয়নি। এতে একাত্তরের মার্চের আগের ঘটনা থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত নানা তথ্য যুক্ত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কেও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে এ বইটি থেকে। একই ভাবে অনেক গবেষণার ক্ষেত্রে এটি কাজে আসবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহুকাল কাজ করছেন সাংবাদিক সাহিত্যিক শাহরিয়ার কবির। বইটি সম্পর্কে তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে এটি অনেক বড় কাজ। এর জন্য গোটা জাতি কৃতজ্ঞ থাকবে মুনতাসীর মামুনের কাছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মামুনের চেয়ে কেউ বেশি লিখেননি। ইতিহাস নিয়ে তিনি এ পর্যন্ত ২শ’ টি গ্রন্থ লিখেছেন। বিশ্বের ইতিহাস রচনার প্রেক্ষাপটে এটাও একটা ইতিহাস। ইতিহাসহীনতায় বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মকে বইটি সঠিক দিক নির্দেশনা দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে, অমর একুশে গ্রন্থমেলার চতুর্থ দিনে সোমবারও এসেছে নতুন নতুন বই। এদিন শুধু বাংলা একাডেমীতে জমা পড়া নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিল ১শ’১০টি।

No comments

Powered by Blogger.