'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'- আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য কি দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে লাখ লাখ উন্মুক্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে, জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে :
'কখন আসবে কবি'?...শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন.... কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি: 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।"
দেশের স্বনামধন্য কবি নির্মলেন্দু গুণ রক্তৰরা একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বহুল প্রতীৰিত শিহরণ-জাগানো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক সংবলিত ঐতিহাসিক বর্জ্রকঠিন ভাষণের মুহূূর্তটি এভাবেই তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছিলেন। আজ সেই ঐতিহাসিক দিন, ৭ মার্চ। অগি্নঝরা একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নামক মহতী কাব্যের স্রষ্টা কবি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্জগম্ভীর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়াদর্ী উদ্যান) মুক্তিপাগল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণ থেকেই মূলত সোনার স্বাধীনতার অঙ্কুরোদগম ঘটতে থাকে এ বাংলায়। বাঙালীর নিজের দেশের হাজার বছরের স্বপ্ন বাসত্মবে রূপ নেয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে এগুতে থাকে।
দেখতে দেখতে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের বয়স ৩৯-এ ঠেকেছে। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বিকৃতির নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রের আবহে বদলে ফেলার চেষ্টা হয়েছে স্বাধীনতার অনেক ইতিহাস। কিন্তু এই ৩৯ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেলেও বদলানো যায়নি শুধুমাত্র ২০ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি। বিশ্বের অনেক মনীষী বা নেতার অমর কিছু ভাষণ আছে। বিশ্বের মধ্যে এই একটি মাত্র ভাষণ যা বছরের পর বছর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেজে চলেছে_কিন্তু ভাষণটির আবেদন এতটুকুও কমেনি। বরং যখনই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ঐতিহাসিক ভাষণটি শ্রবণ করেন, তখনই তাঁদের মানসপটে ভেসে ওঠে স্বাধীনতার গৌরবগাথা আন্দোলন-সংগ্রামের মুহূর্তগুলো, আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের আদর্শে। ৩৯ বছর ধরে একই আবেদন নিয়ে একটানা কোন ভাষণ এভাবে শ্রবণের নজির বিশ্বের ইতিহাসে নেই। নানা গবেষণার পর মাত্র ২০ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণটি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
কী হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক দিনে? স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ থেকে ছুটে আসা পিপাসার্ত মানুষের ঢলে একাত্তরের এদিন রেসকোর্স ময়দানের চতুর্দিকে রীতিমতো জনবিস্ফোরণ ঘটে। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরম্ন হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ৰমতা হারায় সেদিনের রেসকোর্স। রাজধানী ঢাকার চতুর্দিকে ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মারা রক্তচৰু নিয়ে প্রহরায়। আকাশে উড়ছে হানাদারদের জঙ্গী বিমান। মুক্তিপাগল বাঙালীর সেদিকে নূ্যনতম ভ্রূৰেপ নেই। তাঁদের শুধু অপেৰা তাঁদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু কখন আসবেন।
গণমানুষের সেস্নাগানের মধ্য দিয়ে বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে জনসমুদ্রের মঞ্চে আসেন স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। আকাশ কাঁপিয়ে সেস্নাগান হচ্ছে, 'বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর', 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা', 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।' মঞ্চে দাঁড়িয়েই বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালী জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মাদের জানিয়ে দেন, স্বাধীনতাকামী জনতাকে আর বুলেট-বেয়োনেটে দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে রেসকোর্সের মাঠে তিনি আবৃত্তি করেন বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা, "রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইন্শালস্নাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"
মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে ওঠে মুক্তিপাগল বাঙালীর। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুমর্ুহু সেস্নাগানে কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের ঝা-ায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালি রঙে অাঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন_'আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা করো...।'
সেদিন বেতারে সরাসরি বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঐতিহাসিক এই ভাষণটি প্রচারের কথা থাকলেও তা করেনি পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মারা। কিন্তু মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিবের নির্দেশ, 'আজ থেকে কোর্ট-কাছারি, আদালত, ফৌজদারি আদালত, শিৰা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষের কষ্ট না করে, সে জন্য যে সমসত্ম অন্যান্য জিনিস আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিক্সা, গরম্নর গাড়ি, রেল চলবে। ...সেক্রেটারিয়েট ও সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গবর্নমেন্ট দফতর, ওয়াপদা_কোন কিছুই চলবে না। ...আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব...আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।"
স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ থেকে ছুটে আসা পিপাসার্ত মানুষের তৃষ্ণা মিটল বঙ্গবন্ধুর মাত্র ২০ মিনিটের অমর কবিতায়, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে। এই একটি ভাষণেই নিরস্ত্র বাঙালীকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেন বঙ্গবন্ধু। বিশ্বের ইতিহাসে কোন রাষ্ট্রনায়ক বা নেতা স্বাধীনতার ঘোষণাপূর্ব এই ধরনের ভাষণ দেয়ার নজির নেই। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার দিন থেকেই মূলত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার অঙ্কুরোদগম ঘটতে থাকে এ বাংলায়। বাঙালীর নিজের দেশের স্বপ্ন বাসত্মবে রূপ দেয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। কেননা একাত্তরের ৭ মার্চ জাতির জনকের কণ্ঠে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা শোষিত-নির্যাতিত বাঙালী জাতিকে মুক্তির জন্য অস্থির-পাগল করে তুলেছিল। পাকিসত্মানী ঔপনিবেশিক শাসনের নিগঢ় থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্ৰার উন্মাতাল সেই তরঙ্গ দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে শ্যামল বাংলার আনাচে কানাচে।
বঙ্গবন্ধুর অমোঘ মন্ত্রে দীৰিত-প্রাণিত হয়ে কঠিন সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে দেশ থেকে হানাদারমুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। শুধুমাত্র অদম্য মনোবলকে সম্বল করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিরস্ত্র বাঙালী মুখোমুখি হয়েছিল পাকিসত্মানের আধুনিক সমরসজ্জিত, প্রশিৰিত সেনাবাহিনীর বিরম্নদ্ধে। মৃতু্যপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুঃসাহসে দীপ্ত মুক্তিকামী বাঙালী একাত্তরের মাত্র ন' মাসে প্রবল পরাক্রমশালী পাক হানাদারদের পরাসত্ম-পর্যুদসত্ম করে ছিনিয়ে এনেছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, দুঃসাহসিকতা আর আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালী অর্জন করল নিজস্ব মানচিত্র, লাল-সবুজের পতাকা।
এ কারণেই এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় গৌরবের দিন। প্রতিবছর দিনটিকে বাঙালী জাতি গভীর আবেগ, ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। কৃতজ্ঞ বাঙালী স্মরণ করে স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দিবসটি উপলৰে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলৰে রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, ৭ মার্চ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অনন্য দিন। বিশ্ব রাজনৈতিক বিশেস্নষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। বাঙালীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ঐ ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বর্জকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এ ঐতিহাসিক ভাষণ। যার আবেদন আজও অটুট রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে বলেন, ৭ মার্চ বাঙালীর জাতীয় ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দিন। তৎকালীন পাকিসত্মানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচৰু উপেৰা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলিষ্ঠ কণ্ঠে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা বাঙালী জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঐতিহাসিক সেই ভাষণ এদেশের জনগণকে দারম্নণভাবে আন্দোলিত করে এবং তাঁদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিপুলভাবে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর বর্জকণ্ঠের ঘোষণা_'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম' ছিল মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা।
কর্মসূচী
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলৰে বিভিন্ন সংগঠন বিসত্মারিত কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- সকাল সাড়ে ছ'টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সাড়ে সাতটায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জমায়েত ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং বিকেল তিনটায় বঙ্গবন্ধু আনত্মর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনাসভা। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনায়সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ও ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়াদর্ী উদ্যানের শিখা চিরনত্মনে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করবে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দিবসটি পালন করছে।

No comments

Powered by Blogger.