সম্ভাবনা- উত্তরাঞ্চলে আলুর পরিবর্তে সরিষা চাষ by সরকার মাজহারুল মান্নান

দেশে বর্তমানে ভোজ্যতেলের ঘাটতি ৪ দশমিক ৪৩ মেট্রিক টন। পাশাপাশি রবি মওসুমে চাহিদার তুলনায় অধিক আলু উৎপাদন করে গত চার বছর বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা।
এ অবস্থার উত্তরণে আলুর বিকল্প হিসেবে সরিষা চাষের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের ঘাটতি মোকাবিলা করে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এ কারণে আলুর বিকল্প হিসেবে বিনা উদ্ভাবিত উন্নত জাতসহ দেশীয় জাতের সরিষা আবাদে ঝুঁকছেন রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা। এ বছরই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে সরিষার চাষ করেছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ভোজ্যতেলের চাহিদা ৬ দশমিক ২৮ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তুদেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১ দশমিক ৮৫ লাখ মেট্রিক টন। ঘাটতি থাকে ৪ দশমিক ৪৩ লাখ মেট্রিক টন। ফলে প্রতি বছর সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি করতে হয় বাইরে থেকে। এ অবস্থা উত্তরণে সরিষা চাষের ফর্মুলা দিয়েছেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিনার বিজ্ঞানীরা। বিনার গবেষকেরা দীর্ঘ দিন গবেষণা করে উদ্ভাবন করেছেন উচ্চফলনশীল বিনা সরিষা-৭ ও ৪ সহ ৮টি জাত। নিবিড়ভাবে এই জাতের সরিষা আবাদ করা গেলে দেশের ভোজ্যতেলের ঘাটতি মোকাবিলা এবং আলুর বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন উদ্ভাবক বিজ্ঞানীরা।

উদ্ভাবকেরা জানান, আমন-আলু-বোরোর পরিবর্তে আমন-সরিষা-বোরো এই শস্যবিন্যাসকে জাতীয়ভাবে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। আমন মওসুমে আষাঢ় মাসে আগাম জাত বিনা ধান-৭ এর চাষ করে আশ্বিনের শেষে ধান কেটে বিনা সরিষা-৭ চাষ করা যায়। সরিষা কর্তনের পর বোরো ধানের চাষ করা যায়। এতে আমন এবং বোরো ধানের ফলনও ভালো হয়। সরিষার পাতা পড়ে নাইট্রোজেন তৈরি হয় বলে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া পরিমিত আলু ও পরিমিত সরিষা আবাদ নিশ্চিত করা গেলে আলুর দামের পাশাপাশি সরিষার দামও ঠিকঠাক পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে প্রতি একরে সরিষায় ৫০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। এতে বোরোর আবাদটাও সঠিকভাবে করা যায়।

উদ্ভাবক গবেষক দলের অন্যতম বিনার প্রধান বিজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং প্রশিণ, যোগাযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান ড. এম রইসুল হায়দার নয়া দিগন্তÍকে জানান, দেশে আমন ধান আবাদযোগ্য ৫৫ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে স্বল্প জীবনকালের বিনা ধান-৭ চাষের পর সেসব জমিতে বিনা সরিষা-৭ চাষ করে ৬ লাখ টন তেল উৎপাদন সম্ভব। যার মাধ্যমে এক দিকে দেশে তেল ঘাটতি পূরণ হবে। অন্য দিকে সাশ্রয় হবে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। পাশাপাশি তেল রফতানিকারক দেশের তালিকায় নাম উঠবে বাংলাদেশের।

অপর উদ্ভাবক বিনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান ড. এম এ সামাদ নয়া দিগন্তকে জানান, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে প্রচুর আলুর উৎপাদন হয়। তাই আলু চাষ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। চাষি যদি একাধারে আলু চাষ করে তা হলে আলু ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন না। তাই এ সময়ে সরিষা চাষ খুবই প্রয়োজন। চাষিরা যদি কিছু জমিতে সরিষা এবং কিছু জমিতে আলু চাষ করেন তাতে তেলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আলুর বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রিত হবে। তিনি বলেন, বিশাল এ সম্ভাবনাকে বাস্তÍবায়ন করতে সরকারকে স্ব^ল্পমেয়াদি জাতের সরিষার আবাদ সম্প্রসারণ করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এবং কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে এ বীজের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিন বছর ধরে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে পৌনে তিন লাখ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করেন চাষিরা। ফলনও হয় বাম্পার। কিন্তু দাম না পাওয়ায় আলুচাষিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ অবস্থ’ায় সরিষা আবাদের দিকে ঝুঁকছেন রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক কৃষক। সরিষা চাষ করে কম সময়ে ভালো ফলন পাওয়ায় আশাবাদী তারা। খামারবাড়ি রংপুর ও রাজশাহী সূত্রে প্রকাশ, এ বছর রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে এক লাখ ৩২ হাজার ১৪৮ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে রংপুর বিভাগের আট জেলায় কৃষি বিভাগের টার্গেট ৪০ হাজার ৫৭৮ হেক্টর হলেও আবাদ হয়েছে ৫২ হাজার ৫২২ হেক্টর এবং রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় টার্গেট ৬৪ হাজার ১২০ হেক্টর হলেও আবাদ হয়েছে ৭৯ হাজার ৬৬২ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে প্রায় ২০ ভাগ জমিতে বিনা-৭ উচ্চফলনশীল জাতের সরিষার আবাদ হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে সরিষার আবাদে কৃষি বিভাগের তদারকি না থাকার অভিযোগ করেছেন কৃষকেরা।

রংপুরের পীরগাছা সদর ইউনিয়নের চাষি আবদুল মালেক বলেন, লাভজনক হওয়ায় আমি প্রতি বছর সরিষার আবাদ করি। কিন্তু প্রতি মওসুমেই বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় জমিতে লাগে। কৃষি বিভাগের কোনো কর্মকর্তা আমাদের কাছে আসেন না। তাদেরকে মোবাইল করেও পাওয়া যায় না। নিরুপায় হয়ে নিজের বুদ্ধি এবং কীটনাশকের দোকানদারদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ দেই। এতে শস্য দানা কম হয়। কাক্সিত ফলন পাওয়া যায় না।

কিন্তু কৃষকদের এমন অভিযোগ এড়িয়ে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো: আবদুল জলিল নয়া দিগন্তকে বলেন, কৃষি বিভাগের যে পরিমাণ জনবল আছে, সব সময় তা দিয়ে সব কৃষকের পাশে যাওয়া যায় না। তারপরেও কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা নিরলসভাবে কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। এবার আবহাওয়ার কারণে সরিষার আবাদ খুবই ভালো হয়েছে। টার্গেটের চেয়েও বেশি ফলন হবে। তিনি বলেন, বিনা উদ্ভাবিত সরিষা রংপুর অঞ্চলে গত দুই বছর ধরে আবাদ করা হচ্ছে। কৃষি বিভাগ এর সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা যায়, আগামীতে সরিষা আলুর বিকল্প ফসল হিসেবে এ অঞ্চলে ব্যাপক সাড়া জাগাবে।

বিনার একটি সূত্র জানায়, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর জমি সরিষা আবাদের উপযোগী। পরিকল্পিতভাবে এসব জমিতে সরিষা চাষ করতে পারলে উত্তরাঞ্চল থেকেই দেশের অর্ধেকেরও বেশি তেলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এ জন্য সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.