খাবারের স্বাদ নিয়ে নানা কথা by ডা: মণীষা ফেরদৌস

খাবারের সব স্বাদই জিহ্বায় নয়, টেস্ট বাড (Test bud) নামক স্বাদ সংবেদি অঙ্গ শুধু জিহ্বাতে নয়, মুখগহ্বরের তালুতে, গালের ভেতরে দুই পাশে এমনকি খাদ্যনালীর উপরিভাগে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে রয়েছে।
টেস্ট বাডের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জটিল মিথস্ক্রিয়া ঘটে থাকেÑ স্নায়ুজালিকাসমৃদ্ধ প্রতিটি টেস্ট বাড প্রধান স্বাদ (মিষ্টি, টক, তিতা, লবণাক্ত) এবং যেকোনো সুস্বাদুতা নির্ণয় করতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মুখের এবং নাকের সংবেদনশীলতার মিথস্ক্রিয়া খাবারের স্বাদ বহু গুণে বাড়িয়ে দেয়। আমরা নিশ্চয়ই খেয়াল করব যে, ঠাণ্ডা বা সর্দি লাগলে কোনো খাবারের সঠিক স্বাদ এমনকি কোন খাবার খাচ্ছি তা নির্ণয় করা যায় না। মুখভর্তি খাবার নিয়ে মুখবন্ধ করে নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়লে এই বাষ্প নাসারন্ধ্রের ভেতরের দিকে অবস্থিত অলফ্যাক্টরি নার্ভের সংস্পর্শে এসে খাদ্য স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া খাদ্যদর্শনও খাদ্যের স্বাদ আনে।

ট্রাইজেমিনাল নার্ভ সিস্টেম যার শাখা-প্রশাখা মস্তিষ্ক, নাক এবং মুখের সংযোগ স্থাপন করেছে এবং ঝাল স্বাদ এবং ঠাণ্ডা পানীয়ের ঠাণ্ডা এবং ঝাঁঝালো স্বাদ নির্ণয় করে থাকে।

খাবারের স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন লোকের ক্ষেত্রে ভিন্ন। ফরাসি প্রবাদ আছে ‘চাকুন এ সন গুউট’ (যার স্বাদ তার কাছে) এটা সত্য। খাদ্য স্বাদ আস্বাদন মানুষের জন্মগত ভিন্নতা আনে। এক-চতুর্থাংশ জনগণ যারা সুপার টেস্টার বলে খ্যাত, খাদ্যের অধিক স্বাদ পেয়ে থাকে এবং তাদের টেস্ট বাডের সংখ্যা খুব বেশি। বাকি লোক যারা নন টেস্টার প্রয়োজনের তুলনায় কম টেস্ট বাডের অধিকারী। মহিলাদের মধ্যে সুপার টেস্টার বেশি খুঁজে পাওয়া যায়। ইস্ট্রোজেন স্বাদের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। সুপার টেস্টরা জেনেটিকালি তিতো জিনিসের প্রতি বেশি স্পর্শকাতর হয়ে থাকে, যা খাদ্য পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা দেয়।

গরম খাবারের স্বাদ ঠাণ্ডা খাবারের স্বাদ অপেক্ষা বেশি। গরম খাবারের বাষ্প অলফ্যাক্টরি স্নায়ুকে সংবেদনশীল করে। এ ছাড়া খাদ্যের তাপমাত্রা জিহ্বাকে কিছু কিছু খাবারের প্রতি বেশি স্পর্শকাতর করে তোলে। তাপমাত্রা খাদ্যের মিষ্টতা অথবা তিক্ততা বাড়ায়; অপর দিকে ঠাণ্ডা তা কমায়। টক এবং লবণাক্ত স্বাদের উপরে তাপমাত্রার তেমন প্রভাব নেই।

জিঙ্ক ঘাটতি কখনো কখনো মুখের রুচি কমায়। তবে এর সংখ্যা অনেক কম। অরুচি বা স্বাদ বিকৃতির বিষয়গুলো বয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটে থাকে। কিছু মারাত্মক অসুখ যেমনÑ লিভার এবং কিডনিবিষয়ক অসুখগুলোতে স্বাদ বিকৃতি এবং জিঙ্কের ঘাটতি দুটোই ঘটে। যদি কেউ স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ করে নিয়মিত তার জিঙ্ক ঘাটতির কারণে স্বাদ বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এ কারণে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া জিঙ্ক প্রতিস্থাপনীয় ওষুধ সেবন করা উচিত নয়, নতুবা বহু খারাপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়। তীব্র খাদ্যাকাক্সা সব সময় পুষ্টিতে প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে না। কেউ কেউ মনে করেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খাবার তাদের শারীরিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে এটা সব সময় সত্য নয়। খাদ্যাকাক্সা বিভিন্ন সময় পরিবেশে বৃদ্ধি পায়। যেমন- কোনো বেকারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিস্কুট দেখে জিভে পানি এলো, তার মানে এই নয় যে শরীর এখন শর্করা জাতীয় খাদ্য চায়।

খাবারের সাথে একটু বেশি লবণ খাওয়া অনেকেরই পছন্দ এবং অনেকে বলে থাকে এটা জন্মগত পছন্দ, আসলে তা ঠিক নয়। লবণাক্ত স্বাদ একটি অর্জিত স্বাদ। তরুণ বয়স থেকে লবণাক্ত খাবারের প্রতি আসক্তি জন্মে গেলে এটি একটি অভ্যাসে পরিণত হয়। কিন্তু এটা পরিবর্তনশীল। ছয় থেকে আট সপ্তাহ কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া অভ্যাস করলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।

কারো কারো ধারণা বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মুখের রুচি কমতে শুরু করে। কারণ টেস্ট বাডের সংখ্যা কমে যায়। স্বাদের অনুভূতি এবং সংবেদনশীলতা বয়োবৃদ্ধির সাথে খুব কম পরিমাণই কমে। এটা স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং মস্তিষ্কের স্বাদ গ্রহণের অনুভূতি পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে কিন্তু টেস্ট বাডের পরিবর্তনের সাথে নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, বয়সের পরিবর্তনের সাথে সাথে ঘ্রাণশক্তির অনুভূতি পাল্টায়, যা কিনা খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতার ওপর প্রভাব ফেলে। এদের মধ্যে ৬৫ বছরের উপরের অর্ধেক লোকের এবং ৭৫ শতাংশ লোক যাদের বয়স ৮০ বছরের ওপরে ঘ্রাণশক্তি অনেক কমে যায়।

কিছু কিছু দীর্ঘস্থায়ী অসুখ এবং ওষুধ জিহ্বার স্বাদ কমিয়ে দেয়। তখন অনেক প্রিয় স্বাদের খাবারও বিস্বাদ মনে হয়। কেউ খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দেন কেউবা স্বাদ বৃদ্ধি ও পুষ্টি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে লবণ মসলা, তেল বেশি পরিমাণে ব্যবহার করে থাকেনÑ দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
       

No comments

Powered by Blogger.