হল-মার্ক কেলেঙ্কারি- কে কত ঘুষ নিয়েছেন তার তালিকা হচ্ছে by অনিকা ফারজানা

ব্যাংকিং খাতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার মূল প্রতিষ্ঠান হল-মার্ক গ্রুপের কাছ থেকে কে কত টাকা ঘুষ নিয়েছেন, সেই তালিকা তৈরি হচ্ছে।
হল-মার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ অবৈধ উপায়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে ব্যাংকের পরিচালক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাকে কত পরিমাণ ঘুষ দিয়েছেন, সেই হিসাব বের করছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত দল। এই তালিকায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি), মহাব্যবস্থাপকসহ (জিএম) নানা স্তরের ব্যাংক কর্মকর্তারা রয়েছেন।
ঘুষ নেওয়ার তালিকা করা হলেও দুদকের তদন্ত চলছে ধীরগতিতে। তানভীর মাহমুদ গ্রেপ্তার হয়ে জেলে থাকলেও ওখান থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। সোনালী ব্যাংকের এমডি বা ডিএমডি কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি দুদক। দুদকের বক্তব্য হচ্ছে, তাঁদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় এ পর্যন্ত দুদক ১১টি মামলা করেছে। মামলার আসামিদের মধ্যে হল-মার্কের এমডি তানভীর মাহমুদ, চেয়ারম্যান তানভীরের স্ত্রী জেসমিন ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক তানভীরের ভায়রা তুষার আহমেদ, সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক (সাময়িক বরখাস্ত) এ কে এম আজিজুর রহমান, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মীর মহিদুর রহমান, জিএম শেখ আলতাফ হোসেন ও মো. সফিজউদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বাকি সবাই পলাতক। পলাতকদের মধ্যে রূপসী বাংলা শাখার সাবেক সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান, এমডি হুমায়ুন কবীর, ডিএমডি মাইনুল হক, মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ননী গোপাল নাথ (ওএসডি), এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান ও আশরাফ আলী পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে দুদক। দুদক মনে করে, এই কয়জন কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
দুদকের অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও বলা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, দুদকের কাছ থেকে তারা নির্দেশনা পেয়েছে। তবে এখনো অভিযান চালানো হয়নি।
স্বীকৃত বিলের বিপরীতে পরিশোধিত (ফান্ডেড) অর্থ এক হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ৪ অক্টোবর রমনা থানায় ১১টি মামলা দায়ের করা হয়। আর বাইরে আরও (ননফান্ডেড) এক হাজার কোটি ৭৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধান দল ইতিমধ্যে জনতা ব্যাংকের সাত শাখা, রূপালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখা, শাহজালাল ব্যাংকের সাত শাখা ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নথিপত্র সংগ্রহ করেছে দুদক। এসব ব্যাংক থেকে যথাক্রমে ৩১৪ কোটি ৬৬ লাখ, ৯৭ কোটি ২৮ লাখ, ১০৭ কোটি ৩৯ লাখ ও ৮৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে হল-মার্ক গ্রুপ।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, এসব ব্যাংক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে এসেছে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশে তাঁরা ওই সব নথিপত্র সই এবং ছাড় করেছেন। এ ক্ষেত্রে দুদকের তদন্ত দল খতিয়ে দেখছে, ওই সব ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কার কার সঙ্গে তুষার, তানভীর ও সোনালী ব্যাংকের আজিজের সরাসরি সম্পর্ক ছিল।
নতুন তথ্য: দুদক সূত্র জানায়, তুষার আহমেদ ব্যাংক জালিয়াতির বিষয়ে সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বাইরে থাকা অন্যদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। ওই চক্রের বেশ কিছু নাম তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন তুষার। এঁদের মধ্যে ব্যাংকের এমডি, ডিএমডি, জিএম, শাখা ম্যানেজারসহ অন্তত দুই ডজন কর্মকর্তার নাম রয়েছে তাঁর জবানবন্দিতে। তুষারের তালিকায় সোনালী ব্যাংকের টঙ্গী, আগারগাঁও ও গুলশান শাখার কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে। চক্রটি ঘুষের বিনিময়ে তাঁকে ভুয়া ঋণপত্রের কাজ করে দিত। হল-মার্কের পক্ষে তুষার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও দেনদরবার করতেন। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তানভীরের স্ত্রী জেসমিন ইসলামও কিছু তথ্য দিয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, তানভীর বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীরা তানভীর ও তুষারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, তাঁদের মুঠোফোনের কললিস্ট ও লেনদেন হওয়া খুদে বার্তা (এসএমএস) সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে তানভীর দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে এবং আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ-সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। যেমন তিনি ঋণ পেতে কাকে কত টাকা ঘুষ দিয়েছেন, কোন আমলাকে গাড়ি দিয়েছেন ইত্যাদি। কিন্তু দুদক কর্তৃপক্ষ মনে করছে, তানভীর এখনো পুরো সত্য কথা বলছেন না।
পর্ষদের ওপর নজর: সোনালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের ওপরও নজর রেখেছে দুদকের তদন্ত দল। কোনোভাবেই হল-মার্ক কেলেঙ্কারির দায় তাঁরা এড়াতে পারেন না বলে মনে করছে দুদক। তানভীর মাহমুদ জবানবন্দিতে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সাইমুম সরওয়ারের নাম রয়েছে। তিনিসহ সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন সাবেক পর্ষদ সদস্যের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যের সম্পত্তির বিবরণ জমা দেওয়ার জন্য দ্রুত নোটিশ পাঠানোর কথাও ভাবছে দুদক।
এ ছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, হল-মার্কের সঙ্গে মোদাচ্ছেরের সম্পর্ক, ঘটনাস্থল সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় বারবার তাঁর আসা-যাওয়া, দুদক ও সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া ভিন্ন বক্তব্য এবং হল-মার্কের তুষারের বক্তব্য আমলে নিয়ে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যারা সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা তছরূপ করেছে, তারা দেশের শক্র। ব্যাংক জালিয়াত চক্রটির এমন শাস্তি হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ পথে পা বাড়াতে সাহস না পায়। তিনি আশা করেন, দুদকের তদন্ত শেষে মামলাগুলো বিচারে পাঠানোর পর আদালত দেশের স্বার্থে দুর্নীতিবাজদের আইনানুগ শাস্তি দেবেন।

No comments

Powered by Blogger.