পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকারের সামনে চার বিকল্প-উপকরণ কিনলে সহজ শর্তে মিলবে চীনা ঋণ

পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন দেশবাসী চরম অনিশ্চয়তায়, তখন সরকারও এ প্রকল্প নিয়ে পড়েছে প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জে। বিশ্বব্যাংককে বিদায় করার পর পুরো জাতির প্রত্যাশা আর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সামনে এ মুহূর্তে চারটি বিকল্প খোলা।
সরকার এ চার বিকল্প নিয়েই চিন্তাভাবনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে মালয়েশিয়া, ভারত ও চীনের অর্থায়নের আগ্রহ। এ তিন দেশের প্রস্তাব সরকারের বিবেচনায় আছে। এ ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নেও পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করার প্রস্তুতি আছে সরকারের।
এই বিকল্পগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়ার প্রস্তাব নিয়ে সমালোচনা আছে। চীনের প্রস্তাব এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে জানা গেছে, দেশটি থেকে সরকার সহজ শর্তে ২ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে চীন থেকে সেতুর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার শর্ত থাকবে। তবে চীন থেকে ৫-৬ শতাংশ সুদে বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়ারও সুযোগ আছে। ভারতের আগ্রহের কথা জানালেও তাদের প্রস্তাবে কী আছে, তা প্রকাশ করেনি সরকার। তবে প্রতিবেশী দেশটি বাংলাদেশকে যে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, এর ২০ কোটি ডলার অনুদান হিসেবে মিলবে। ওই অনুদান সরকার তার যেকোনো প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে।
নিজেদের টাকায় সেতু : গত জুনে বিশ্বব্যাংক যখন ঋণ প্রস্তাব স্থগিত করে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজস্ব অর্থে সেতু নির্মাণের পক্ষে অবস্থান নেন। সে সময় এক হিসাবে রেল বাদে শুধু সড়ক সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ১৭০ থেকে ১৮০ কোটি ডলারের মধ্যে। অর্থ সংস্থানের বিষয়ে বলা হয়, ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কোনো সহায়তা না নিয়েই সেতুটি নির্মাণ করা সম্ভব।
সরকারের এক হিসাবে বলা হয়েছে, নির্মাণকাজ শুরু করতে এখন বাংলাদেশকে দিতে হবে ৬০ কোটি ডলার। এর মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের ২৩ কোটিসহ সরকারের হাতে রয়েছে ৮৮ কোটি ডলার। ফলে ১০০ কোটি ডলারের মতো ঘাটতি থাকছে। এ ঘাটতি পূরণেরও পথ দেখানো হয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, সরকার বাজেট থেকে প্রতিবছর পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ রাখবে ১৫ কোটি ডলার। ফলে পাঁচ বছরেই বাজেট থেকে পাওয়া যাবে ৭৫ কোটি ডলার। বাকি ২০ থেকে ২৫ কোটি ডলার সংগ্রহ করা যাবে বন্ড ছেড়ে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার একটি রূপরেখা তৈরি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। গত ৯ জুলাই মন্ত্রিসভা বৈঠকের সিদ্ধান্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে প্রণীত এ পরিকল্পনায় ৪১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মোট বরাদ্দের ৫ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া অনুন্নয়ন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থ কাটছাঁট করে তা পদ্মা সেতুতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত এক রকম চূড়ান্ত হয়েই আছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের সভাকক্ষে গত ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় ৪১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে ৫ শতাংশ অর্থ কেটে নিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে নেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এ ছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা খাত ও অনুমোদনহীন প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থও পদ্মা সেতু প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়। এ দুই খাতে সরকারি কোষাগারের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব মোজাম্মেল হক খান এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের একটি রূপরেখা তৈরি হয়েছে। তবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কোনো বছর শতভাগ এডিপি বাস্তবায়িত হয় না উল্লেখ করে সচিব বলেন, যে টাকা খরচ হয় না, তাও পদ্মা সেতু প্রকল্পে স্থানান্তর করা যেতে পারে।
সূত্র জানায়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) খাতে বরাদ্দ তিন হাজার কোটি টাকাও পদ্মা সেতু প্রকল্পে স্থানান্তরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। আর চলতি অর্থবছরের এডিপিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিপরীতে ৮০৪ কোটি টাকা তো বরাদ্দ আছেই। এর মধ্যে রয়েছে সরকারের নিজস্ব তহবিলের ৫৭২ কোটি এবং বৈদেশিক সহায়তা বাবদ ২৩২ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, নিজস্ব অর্থে এ সেতু নির্মাণ করতে কোন অর্থবছরে কত টাকা প্রয়োজন হবে, তা জানতে গত ২৮ জানুয়ারি সেতু বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে সেতু বিভাগ। সেতু বিভাগ পরিকল্পনা কমিশনকে জানিয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে শুরু করার দরকার হতে পারে। সংশোধিত এডিপিতে এর জন্য বাড়তি বরাদ্দের প্রস্তুতি রাখতে ওই দিনই কমিশনকে আগাম বার্তা দেয় সেতু বিভাগ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তটি গত বছরের ৯ জুলাই মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়।
এ ছাড়া দেশীয় অর্থায়নে সেতু নির্মাণে অন্য বিকল্পও আছে। সে অনুযায়ী, প্রতিবছর ১৪০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রবাসী অর্থ আসছে। এ ছাড়া প্রায় ১৭০০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ ও অনুদান পাইপলাইনে রয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবছর বিদেশি ঋণ ও অনুদানের ১৪০ থেকে ১৬০ কোটি ডলার পর্যন্ত খরচ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি সহায়তা খরচের সামর্থ্য ২০০ কোটি ডলারে নিতে পারলে সাত বছরেই পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থান করা সম্ভব হবে।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে এর জন্য সংশোধিত এডিপিতে বাড়তি অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব এখনো মেলেনি বলে জানান তিনি।
বিদেশি তিন বিকল্প : বাংলাদেশের বৃহত্তম এ সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে গত বছর চীনের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ওই সময় সরকারের পক্ষ থেকে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারণ ওই সময় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চলছিল। এ ছাড়া চীন সরকার অনেক আগেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। চীন সরকারের সে প্রস্তাব নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, চীন সরকার দুই ধরনের শর্ত দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারে। প্রথমত, অপেক্ষাকৃত নমনীয় সুদে ঋণ দেওয়া। এ ঋণের সুদের হার সাধারণত ২ শতাংশ হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হয়। এ ছাড়া এ ঋণ পেতে চীন থেকেই সব যন্ত্রাংশ কেনার বাধ্যবাধকতা থাকবে। দ্বিতীয়ত, চীন সরকার বাণিজ্যিকভাবে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারে। এ ঋণের সুদের হার সাধারণত ৫ থেকে ৬ শতাংশ হয়ে থাকে। এটিকে কঠিন শর্তের ঋণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদিকে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী চলতি মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ সফরে আসছেন বলে জানা গেছে। তিনি সাধারণত বিভিন্ন দেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে কাজ করে থাকেন।
ভারতের ১০০ কোটি ডলার ঋণের আওতায় অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব মুখার্জি ২০ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন গত বছরের এপ্রিলে। সে অর্থ এখনো ছাড় হয়নি। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ। ওই সফরে তিনি ২০ কোটি ডলারের মধ্যে পাঁচ কোটি ডলার আগামী অর্থবছরের (এপ্রিল-মার্চ) শুরুতেই ছাড়ের ঘোষণা দিতে পারেন।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সরকার এরই মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে। অর্থায়নের ব্যাপারে দেশটি যে শর্ত দিয়েছে তাকে কঠিন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মালয়েশিয়া সুদ নেবে ৬ শতাংশ হারে। সেতু নির্মিত হওয়ার পর তারা পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব ৩৫ বছরের জন্য নিজেদের কাছে রাখতে চায়। ৪০ বছর ওই সেতুর আশপাশে কোনো সেতু নির্মাণ করা যাবে না বলেও শর্ত দিয়েছে তারা। এ ছাড়া তাদের প্রস্তাবে দেওয়া টোল আদায়ের হারকে অনেক বেশি বলে মনে করেছেন বিশ্লেষকরা।

No comments

Powered by Blogger.