পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংককে ‘না’- অর্থনীতির ঝুঁকি বিবেচনায় আনা দরকার

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের অর্থ নেবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে ব্যাংকটির এক বিবৃতিতে। এ সেতু নির্মাণে চুক্তির দুই বছর পর গত শুক্রবার অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংককে করা অনুরোধ ফিরিয়ে নিয়েছে সরকার।
বিশ্বব্যাংককে ‘না’ করার পর অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় এডিবিও। জাইকা আর আইডিবিও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে। সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকেও একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। এর আগে পদ্মা সেতু নির্মাণে দেয়া শর্ত পূরণ এবং চলমান তদন্ত পূর্ণাঙ্গ না হলে এ প্রকল্পে কোনো অর্থায়ন করা হবে না বলে জানিয়েছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। এর পাশাপাশি চলমান ফৌজদারি তদন্ত পূর্ণাঙ্গ ও সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা চেয়ে দোষীদের নাম প্রকাশ্যে বলতে কোনো দ্বিধা করা হবে না বলে জানান বিশ্বব্যাংক প্রধান। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রকল্প ব্যয় ২৯০ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার, এডিবি ৬১ দশমিক ৫ কোটি ডলার, জাইকা ৪১ দশমিক ৫ কোটি ডলার এবং ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার কথা।

বস্তুত বাংলাদেশের নাটকীয় পদেেপর কারণে বহুপীয় দাতা সংস্থার ঋণে পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাবনা প্রায় শেষ হয়ে গেল। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের দায়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম থাকার শর্ত পূরণ নিয়ে সমঝোতা না হওয়ার কারণেই মূলত আর এগোল না সহজশর্তের ঋণে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ। তিনভাবে এখন পদ্মা সেতু হতে পারে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ জোগান দেয়া। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ অনুদান নিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নেরও প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছর। অনুদানের অর্থ সংগ্রহের জন্য দু’টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মধ্যে দেশের অনুদান সংগ্রহে স্থাপিত সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা পড়ে ৬৩ হাজার টাকা। আর প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে অনুদানের অর্থ নিতে খোলা হিসাবে ওই সময় পর্যন্ত জমা পড়ে এক হাজার মার্কিন ডলার। এভাবে যে পদ্মা সেতু হবে না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পদ্মা সেতু হলে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাদ দিতে হবে। প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় থেকে যে ডলার আসবে, তা ব্যয় করতে হবে। এতে আর্থিক খাতের ভারসাম্যে চাপ সৃষ্টি হবে। আর মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ আমদানি ব্যয় কমাতে হবে, যা প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য নেতিবাচক হবে। আর অ-রেয়াতি বিদেশী উৎস থেকে অর্থ নিয়ে এটি বাস্তবায়ন করার কথা বলা হচ্ছে। এভাবে বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিলে সুদের হার সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ হবে। এতে প্রতি বছর এ খাতে অতিরিক্ত সুদই দিতে হবে ১ হাজার ২শ’ ২ কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে (পিপিপি) এটি বাস্তবায়ন করার কথা বলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও প্রকল্পের ব্যয় এবং সুদ দু’টিই বেড়ে যাবে। এ ধরনের বিকল্প উৎস থেকে অর্থ নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ অনেক বেশি ব্যয়বহুল হওয়ায় তা অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংক শেষ করে দেয়নি; সরকারই তা করেছে। হঠাৎ করে সরকার এ সিদ্ধান্ত না নিয়ে আরো আলোচনার রাস্তা খোলা রাখা যেত। কম খরচে সরকার নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে চাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এটি হলে পুরনো নকশা অনুযায়ী সেতু আর হবে না। নতুন নকশায় রেলপথ না থাকলে সেতুর অর্ধেক উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।

আমরা মনে করি, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের উন্নয়নের একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সব কিছু ঠিক রেখেই এ সেতু নির্মাণ করতে হবে। দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত কিছু ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য কোনোভাবেই বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতা সংস্থার রেয়াতি সহায়তা বাদ দিয়ে ব্যয়বহুল অস্বচ্ছ সূত্রের টাকা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন উচিত হবে না। দুর্নীতিগ্রস্ততার মূল্য দিতে গিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে যে বিলম্ব হয়েছে তাতে ২৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ইতোমধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে। পদ্মা সেতু নিয়ে একেক মন্ত্রীর একেক কথায় স্পষ্ট হয়, বিকল্প উৎসের অর্থে এ প্রকল্প সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে না। আর এক সরকারের আমলে এ ধরনের বড় সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয়। ব্যয়বহুল অর্থে এটি নির্মাণ না করে প্রয়োজনে প্রকল্পের বাস্তবায়ন স্থগিত করে আলোচনার দরজা আবার খোলা যেতে পারে। তা না হলে বিশ্বব্যাংকের সাথে সৃষ্ট অচলাবস্থার প্রভাব অন্য প্রকল্পগুলোতেও পড়তে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ জন্য যে মূল্য দিতে হবে আজগুবি কল্পনাবিলাসের জন্য এত বেশি মূল্য দেয়ার অবস্থা জাতির নেই।

No comments

Powered by Blogger.