দীর্ঘ পাঁচ বছর পর দেশে ফিরেও বাঁচতে পারল না প্রেম

আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনেই পুরনো ঢাকায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণ রায়কে প্রকাশ্য দিবালোকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য বিশেষ এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে নামা আন্ডার ওয়ার্ল্ড কিলার গ্রম্নপের হত্যার মাধ্যমে জনমনে বিভীষিকা তৈরির উদ্দেশ্যেই ব্যাবসায়ী প্রেমকৃষ্ণকে উপযর্ুপরি গুলি করা হয়।
১০ লাখ টাকা চাঁদার জন্যই তাকে হত্যা করেছে বলে আপাতত পুলিশী তদনত্মে বেরম্নলেও তার দেহ থেকে ৭টি বুলেট উদ্ধারের কারণ হিসেবে ভীতি সঞ্চারই মুখ্য বলে গোয়েন্দা সূত্রে তথ্য মিলেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক গুলি করে ব্যবসায়ী এবং কমিশনার হত্যাকা-ের মতো এ ৰেত্রেও ভারতে অবস্থানকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদের যোগসূত্র মিলেছে। যদিও সিআইডির পৰ থেকে শহীদ কলকাতায় গ্রেফতার হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে । তার পরেও ৭০ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার আহাম্মদ হাজী এবং একই দিনে বাবুবাজারে চাল ব্যাবসায়ী আফিল উদ্দিনকে উপযর্ুপরি গুলি করে হত্যার সঙ্গে সংশিস্নষ্ট বলে অভিযুক্ত ডাকাত শহীদেরই এ হত্যাকা-ের সঙ্গেও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এ হত্যাকা-ে এখন পর্যনত্ম কারাগারে আটক এক সন্ত্রাসীকে শোন এ্যারেস্ট দেখিয়েছে পুলিশ। ২৬ ফেব্রম্নয়ারি থেকে কারাগারে আটক ডাকাত শহীদের সহযোগী নান্টুকে এই হত্যা মামলায় শুক্রবার গ্রেফতার দেখায় সূত্রাপুর থানা পুলিশ।
মামলার তদনত্ম কর্মকর্তা সূত্রাপুর থানার দারোগা জাহাঙ্গীর কবির খান জনকণ্ঠকে বলেন, মাস দেড়েক আগে প্রেমকৃষ্ণ এবং তার ভাইকে ১০ লাখ টাকা চাাঁদা দাবি করার অভিযোগে থানায় যে জিডি করা হয়েছিল, সেই অভিযুক্ত মোবাইল নম্বরের সঙ্গে নান্টুর নম্বর মেলাতেই তাকে এই মামলাতেও গ্রেফতার দেখানো হয়। তিনি বলেন, কেরানীগঞ্জের এক ব্যবসায়ীকে ভারতে অবস্থানকারী বড় ভাইদের নামে হুমকি দেয়ার অভিযোগে তাকে ২৬ ফেব্রম্নয়ারি কেরানীগঞ্জ থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সে বেশির ভাগ সময়ই দেশের বাইরে অর্থাৎ ভারতে অবস্থান করে বলে প্রমাণ রয়েছে পুলিশের কাছে। ডাকাত শহীদের ঘনিষ্ঠ এবং দেশে তার কাজকর্ম সেই দেখভাল করত বলেও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। উলেস্নখ্য, পুরনো ঢাকায় হত্যাকা- বেড়ে যাবার নেপথ্যে কলকাতায় অবস্থানকারী ডাকাত শহীদের সম্পৃক্ততা বেড়ে যাওয়াতে পুলিশ এবং র্যাব একযোগে এই বাহিনীর পিছু নেয়। দ'ুদিন আগেই তাঁতিবাজারের মুখে অবস্থিত চিত্রা সিনেমা হলের সামনেই র্যাবের সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা যায় শহীদের অপর সহযোগী সন্ত্রাসী কালা মামুন।
নিহতের বড় ভাই অমল রায় জানান, দেড় থেকে দুই মাস ধরে ডাকাত শহীদের লোক পরিচয় দিয়ে টেলিফোনে প্রেম ও তাঁর কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিল সন্ত্রাসীরা। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সন্ত্রাসীরা প্রাণনাশের হুমকি দেয়। পরে বাধ্য হয়ে ১৪ ফেব্রম্নয়ারি কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। জিডিতে চাঁদা দাবি ও পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে উলেস্নখ করা হয়। জিডিতে সন্ত্রাসীদের ব্যবহূত মোবাইল নম্বরও দেয়া হয়। তার পরও পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি।এমনকি পুলিশ কোন তদনত্মে আসেনি বলেই তিনি দাবি করেন। এর আগে একবার সন্ত্রাসীরা চাঁদার জন্য প্রেমকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে ৫ লাখ টাকা দিলে প্রেমকে ছেড়ে দেয়া হয় বলে প্রেমের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রে তথ্য মিলেছে। এর পরেই প্রেম বিদেশে চলে গিয়েছিল। বড় ভাই অমল এ বিষয়ে কোন কথা বলেননি। এমনকি ইতোপূর্বে তাঁর ২৯ বছর জুয়েলারির ব্যবসায়িক জীবনে কোন প্রকার হুমকি-ধমকিও ছিল না বলেই দাবি করেছেন।
দীর্ঘ পাঁচ বছর দুবাইতে থেকে অক্টোবরের শেষ দিকে দেশে আসেন প্রেম। দেশে ফেরার ৭ দিনের মাথায় বিয়ে করেন বাবার মৃতু্যর আগে পছন্দ করে যাওয়া তার বন্ধুর মেয়ে স্বপ্না রানীকে। বিয়ে মাত্র তিন মাস আগে হওয়াতে বিয়ের সকল ছবি ওয়াশ পর্যনত্ম করা হয়নি। কেবল বিয়ের ভিডিওটাই রয়েছে। আর রয়েছে স্বপ্নার মধুচন্দ্রিমার কিছু সুখস্মৃতি। মাত্র তিন মাসের মাথায় শাখা-সিঁদুর ভেঙ্গে সাদা থান কাপড় গায়ে জড়ানো স্বপ্না কেবলই মূছর্া যাচ্ছে। নিহতের বৌদি গীতা রায় জানান, বুধবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে সন্ত্রাসীরা তাদের ২০ নম্বর কৈলাশ ঘোষ লেনের বাসায় গিয়ে হুমকি দিয়ে আসে। দুপুরে বাসায় ফিরেই প্রেম শুনতে পান অস্ত্রধারী কিছু যুুবক সকালে তাদের বাসায় ঢুকে তার খোঁজে তিন তলা পর্যনত্ম উঠে চলে যায়। তারা থাকতেন চারতলাতে। স্ত্রীকে সেদিনই এই ঘটনাটি বলেছিলেন প্রেম। কিন্তু তারা নিরাপত্তা পাবার মতো কোন আশ্রয় খুঁজে পাননি বলে নিহতের স্বজনেরা দাবি করেছেন। গত কয়েকদিন থেকেই ল্যান্ডফোনে প্রেম কোন্দিন কোন্ কাপড়ে বাইরে গিয়েছেন তা জানিয়ে বলা হতো "টাকা দিবা, না গুলিই খরচ করাবা।" জিডির পরও নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা না নেয়াতে প্রেমের পরিবার গত শুক্রবার বাড়ির ল্যান্ডফোনে হুমকি পেলেও পুলিশকে কিছু জানায়নি। সেদিন তারা হুমকিতে বলে, প্রথমে প্রেমকে তারপরে ভাই অমলকেও তারা খুন করবে। প্রেমকৃষ্ণ রায় ও তার ভাই অমলকৃষ্ণ রায়ের কৈলাশ ঘোষ লেনে 'জেমস জুয়েলার্স এ্যান্ড ওয়ার্কশপ' নামে একটি স্বর্ণালঙ্কার তৈরির দোকান রয়েছে।
শুক্রবার প্রেমদের বাড়িতে গেলে প্রেমের পরিবারকে চরম আতঙ্কিত দেখা যায়। সাংবাদিক পরিচয় দেবার পরও তারা ঢুকতে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাঁরা বলেন, যে গিয়েছে সে তো গিয়েছেই, অন্যদের বাঁচাবে কে? দুপুরে ২০ নম্বর কৈলাশ ঘোষ লেনের বাসার প্রধান ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কনস্টেবল অহিদ এবং জনৈক আনসার সদস্যকে গভীর ঘুমে অচেতন পাওয়া যায়। তাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে পরিবারটির নিরাপত্তার বিষয়ে তারা সজাগ কিনা জানতে চাইলে উভয়েই সজোরে বলেন, তাঁরা কোন নিরাপত্তহীনতা দেখতে পাচ্ছেন না।
এদিকে, বৃহস্পতিবার এই হত্যাকা-ের খবর ছড়িয়ে পড়লে দোকানপাট বন্ধ করে বিােভ করেন তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। প্রত্যদশর্ী ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণ রায় তার ভাই অমল কৃষ্ণ রায়ের মেয়ে আদৃতা রায় পূজা ও অঙ্কিতাকে লক্ষ্মীবাজারের সেন্ট ফ্রান্সিস হাইস্কুলে পেঁৗছে দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন। বাহাদুরশাহ পার্কের উত্তর পাশের পানির ট্যাঙ্কের কাছে পেঁৗছলে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা ৪/৫ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী প্রেমকৃষ্ণকে আটকে এলোপাতাড়ি গুলি করে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লাগলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এই সময় অদূরে কবি নজরুল ইসলাম কলেজের সামনে পুলিশের একটি টহল ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। প্রেমের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলেও পুলিশ ছিল সাৰী গোপালের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে। পাবলিককে সামনে এগোতে দেখে সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি ফাঁকা গুলি ছুড়ে পুলিশের সামনে দিয়েই পালিয়ে যায়। অস্ত্র লুকিয়ে ফেলে হেঁটে লক্ষ্মীবাজারের দিকে যাবার সময় আগে থেকে অপেৰমাণ দুটি মোটরসাইকেলে করে তারা পালায়। প্রেমকৃষ্ণকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে প্রথমে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে পুলিশ ভ্যানে করে তাকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। ন্যাশনাল মেডিক্যালে থাকা অবস্থায় শরীরে ৭টি গুলি নিয়েও জ্ঞান ছিল প্রেমের। সে বার বার স্ত্রী স্বপ্নাকে দেখতে চাইছিল। ব্াসার ঠিকানা এবং স্ত্রী ও ভাইয়ের মোবাইল নম্বর সে সেখানে উপস্থিত দু'জন গোয়েন্দা সদস্যকে দেন যাদের মাধ্যমে প্রেমের পরিবারকে খবর পেঁৗছানো হয়েছিল। তারাই পুলিশ ভ্যানে করে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরম্নরী বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে সকাল পৌনে ৯টায় তাঁর মৃতু্য হয়। স্বপ্না এসে আর স্বামীকে জীবিত পাননি।
পুলিশের বক্তব্য কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন খান জানান, প্রেমকৃষ্ণ রায়ের দায়ের করা জিডির পর তদনত্ম করা হয়। তদনত্ম হয়নি এই অভিযোগ তিনি মানতে রাজি নন। তবে, আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করেন। প্রেম ও তাঁর ভাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এলাকায় পুলিশ টহলের পাশাপাশি পাঁচটি পয়েন্টে নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছিল বলেও দাবি করেন। সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল হানিফ জানান, ঘটনার সময় কবি নজরম্নল কলেজের সামনে এক এএসআইর নেতৃত্বে পুলিশের একটি টহল টিম ছিল। তবে, গুলির শব্দ শুনে তারা এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসীরা পাশর্্ববর্তী কলতাবাজার এলাকার দিকে পালিয়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.