যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই_ ১০ হাজার কিশোর কিশোরীর শপথ- মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মুক্তির উৎসব

বাঙালীর জীবনের অন্যতম গৌরবদীপ্ত মাস মার্চ, আবার এসে গেছে । ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার এ মাস বাঙালীর কাছে যেমন গৌরবের, তেমনি বেদনারও।
এ মাসটি এলেই বাঙালী স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায় স্বজন হারানোর, আর রাগে-ৰোভে ফুঁসতে থাকে, এখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ায়। তবে স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরম্ন করায়, ত্যাগ স্বীকারকারী এসব পরিবারের ৰোভ প্রশমিত হওয়ার সুযোগ এসেছে। জাতি আজও যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এককাট্টা, তা শুক্রবার আবার বোঝা গেল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত 'মুক্তির উৎসব' অনুষ্ঠানে। ১৪ বছর আগে এ মাসেই সম্পূর্ণ বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। যেখানে রৰিত আছে মুক্তিযুদ্ধের সমসত্ম স্মৃতি। যারা শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরৰণ করেই ৰানত্ম রয়নি, সেই সঙ্গে দেশের নতুন প্রজন্মকে সম্পূর্ণ শানত্মির সপৰে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন করে তুলছে। তাদের ভ্রাম্যমাণ গাড়ি দেশের বিভিন্ন জেলায় একাত্তরের স্মারক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই নিয়ে গিয়ে স্কুলের শিৰার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তুলছে। সেসব শিৰার্থীদের জন্যই শুক্রবার এই মুক্তির উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল জাদুঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে। যেখানে দশ হাজারেরও বেশি শিৰার্থী অংশ নিয়েছিল। তাঁরা নাচ, গান ও আবৃত্তি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে যেমন স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবকে উপভোগ করল, তেমনি মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও গুণীজনদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধে পাকি ও রাজাকারদের খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের ভয়ঙ্কর কাহিনী শুনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো ধর্মান্ধ মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের নিমর্ূল করার অঙ্গীকারে। যাঁদের (শহীদ মুক্তিযোদ্ধা) চরম উৎসর্গে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখ- ও লাল সবুজের পতাকা, তাঁদের প্রতিই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এই শিশু-কিশোররা দেশ গড়ার নতুন স্বপ্ন ও প্রত্যয়ে প্রাণিত হলো। আর এক সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আওয়াজ তুলল 'চাই, চাই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।' এবং 'রক্তের দামে কিনেছি আমার প্রিয় স্বাধীনতা/ রক্তেই আমি রাখব যে তার মান...।'
বসনত্মের সকালে কাঁচা রোদ যখন উষ্ণতার আবেশ ছড়িয়ে যাচ্ছিল, তখনই একে একে আসতে থাকল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিশু-কিশোররা। অধিকাংশেরই পরনে ছিল লাল-সবুজের পোশাক, আর মাথায় ছিল লাল-সবুজ ক্যাপ। মুহূর্তেই সারা মাঠ প্রাণের উচ্ছলতায় মুখরিত হয়ে উঠল। যে দিকে তাকাই, মনে হলো সে দিকেই যেন বসেছিল লাল-সবুজের মেলা। চারদিকে তাকিয়ে মনে হলো এ শুধু এক মিলনমেলাই নয়, কিশোর-কিশোরীদের এক বিশাল জনস্রোতও বটে, যাঁরা শুধু দেশমাতৃকার টানেই এসে মিলিত হয়েছে এই মুক্তির উৎসবে। এমনই সময় মঞ্চ থেকে কানে ভেসে এলো জাতীয় সঙ্গীত_ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...। গানটির সঙ্গে সঙ্গে আয়োজকগণ উত্তোলন করলেন জাতীয় পতাকা। উড়িয়ে দিলেন শানত্মির পায়রা। মাঠের জনস্রোত তখন দাঁড়িয়ে। ইউনিভার্সিটি অব লিবারাল আর্টস স্কুলের শিৰার্থীদের সঙ্গে সবাই গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত। এর পরই স্বাগত ভাষণ দিলেন ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী। তিনি বললেন, এ জাদুঘর শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা গড়ে তুলতে সদা প্রস্তুত। এভাবেই গান ও নাচের ফাঁকে ফাঁকে শপথ বাক্য পাঠ করান মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি, মুক্তিযুদ্ধ প্রতিমন্ত্রী এবিএম তাজুল ইসলাম, শিৰাবিদ অধ্যাপক জাফর ইকবাল, মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এমপি, লে. জে. (অব) হারম্নন অর রশীদ বীরপ্রতীক ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
তারামন বিবির সঙ্গে দশ হাজারেরও অধিক শিৰার্থী শপথ নিয়ে উচ্চারণ করল_ 'বীর শহীদের জীবনদানের কথা আমরা কখনও ভুলব না। একাত্তরের গণহত্যা, মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার ও শাসত্মি আমরা নিশ্চিত করব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহন করে আমরা চলবো আগামীর দিকে।'
কিশোরদের উদ্দেশে আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, এ মেলা আত্মপ্রত্যয়ের মেলা, জয়বাংলার মেলা। আমাদের ইতিহাস রক্তের ইতিহাস, যুদ্ধ করে দেশ জয় করবার ইতিহাস। আজ এই দেশকে গড়তে হবে, আর এর দায়িত্ব নিতে হবে তোমাদেরই। আজ তোমাদের আনন্দের দিন, বাঙালী গান ও নাচের মাধ্যমেই খুঁজে নেয় আনন্দ। তবে বাঙালী এই গান ও নাচের ভেতর দিয়েই প্রতিরোধ গড়ার প্রত্যয়ও খুঁজে পায়।
যাঁরা ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্ব নেবে তাঁরা যদি ইতিহাস না জানে, চেতনা বুকে ধারণ করতে না শেখে, তাহলে কেমন করে হবে_এমন প্রশ্ন তুলে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, জানা ও জানানোর কাজটা প্রতিনিয়ত করে যেতে হবে। এরা যত বেশি জানবে, দেশকে গড়তে তত বেশি আগ্রহী হবে। তাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়েও জানাতে হবে।
মুক্তির উৎসবে আসা কিশোরী দোয়েল জনকণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেক কিছু জেনেছি। আমাদের জন্য যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, মা-বোনদের ধর্ষণে সহায়তা করেছে, দেশের গুণী ব্যক্তিদের হত্যা করেছে, সেই সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই।
অনুষ্ঠানে ইউনিসেফ, টঙ্গুয়া উচ্চ বিদ্যালয় (দিনাজপুর), ওয়াজেদ মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয় (বরিশাল), মিরপুর গার্লস আইডিল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুল, উত্তরা রাজউক মডেল কলেজ, বধ্যভূমি সনত্মান দল, ঘাসফুল, ধ্রম্নপদ কলা কেন্দ্রের শিৰার্থীরা পরিবেশন করে নাচ ও গান। তাদের পরিবেশিত উলেস্নখযোগ্য গান হলো_ আবার জমবে মেলা বটতলা হাটতলা..., আমি তাকধুম তাকধুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল..., তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে...প্রভৃতি এবং স্বাধীন দেশে উড়বে যেন স্বাধীন পতাকা..., ঐ যে দেখা যায় হিজলতলীর গাঁয়রে..., সবুজের বুকে লাল পতাকা... প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিবেশিত হয় নাচ। এ ছাড়া শিল্পী ফেরদৌস আরা এক যে ছিল এক গাঁ, সেখানে ছিল এক পরী... গানটি এবং বাপ্পা মজুমদার তোমার বাড়ির আঙ্গিনায় দেখেছিলাম বায়োস্কপ... ও যত দূরে যাই জানি না তো কবে দেখা হবে... গান দু'টি গেয়ে শোনান গান। পরে র্যাফেল ড্রয়ের মাধ্যমে শেষ হয় এই উৎসব।

No comments

Powered by Blogger.