শতাধিক যাত্রী নিয়ে মেঘনায় লঞ্চডুবি, অর্ধশত নিখোঁজ- এক নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার

গজারিয়া উপজেলার ইসমানির চরের কাছে শুক্রবার সকালে মেঘনায় এমএল সারস শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে। কিছু যাত্রী তীরে উঠতে সক্ষম হলেও নিখোঁজ রয়েছে প্রায় ৫০ যাত্রী।
হতভাগ্য যাত্রী প্রিন্স (১৭ মাস) ও ময়না আক্তারের (২৬) লাশ উদ্ধার হলেও বাকি যাত্রীর ভাগ্যে কি হয়েছে তা জানা যায়নি। পুলিশ সুপার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান জানান, বালুবাহী জাহাজ বাল্কহেডের ধাক্কায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। বাল্কহেডটি আটক করা হলেও চালক পালিয়ে গেছে। জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল জানান, এই ঘটনায় এডিএমকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় উপসচিব হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই দুর্ঘটনায় নিহত প্রতি পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে।
সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখার সময় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম মেঘনার মাঝখান থেকে ডুবন্ত লঞ্চটিকে টেনে তীরে নিয়ে যাচ্ছিল। লঞ্চের ভেতর থেকে ফিরে আসা ফায়ার সার্ভিসের ডুবরিরা জানিয়েছেন লঞ্চের ভেতরে আরও লাশ রয়েছে। তবে ছোট আকারের দেড়তলা ডুবন্ত লঞ্চটির ভেতরে ডুবরিরা ঢুকতে পারছিলেন না। মুন্সীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পারিচালক মোঃ ইয়াহিয়া আলী শিকদার জানান, লঞ্চটি তীরে ভেড়ানোর পর লাশগুলো উদ্ধার করা যাবে। তিনি জানান, দমকল বাহিনীই লঞ্চটি নদী বক্ষে প্রথম শনাক্ত করেন।
বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান ড. খন্দকার শামসুদ্দোহা ঘটনাস্থলে জানান, ১৭.০৮ মিটার দীর্ঘ এবং ৪.৪৮ মিটার লঞ্চটির ধারণ ক্ষমতা ছিল ৭০ জন যাত্রী বহনের। লঞ্চটির ওজন ১২টন। ছোট আকারের হওয়ায় হামজাকে তলব করা হয়নি। দ্রুত লঞ্চ উদ্ধারের সব রকমের প্রচেষ্টা রয়েছে।
তবে দুপুর ২টায় ১২০ ফুট পানির নিচে লঞ্চটি শনাক্ত করা হলেও এটি উদ্ধারে বিলম্ব করার অভিযোগ করেছে নিখোঁজ পরিবারে স্বজনরা। স্বজনার ‘লাশ লাশ চাই’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করে। পরে কর্তৃপক্ষ তাদের আশস্ত করে।
দুর্ঘটনায় কবলিত লঞ্চযাত্রী চাঁদপুরের ব্রাহ্মণচক গ্রামের সুমন (২৮) জানান, যাত্রীবাহী লঞ্চটি সকাল ৭টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে চাঁদপুরের মতলবের মাছুয়া খাল রওনা হয়। পথিমধ্যে সকাল ৮টার দিকে বালুবাহী জাহাজ বাল্কহেডের ধাক্কায় ডুবে যায়। খালি এই বাল্কহেডটি পরপর দু’বার ধাক্কা দিলে কাত হয়ে ডুবে যায়।
সকাল ১০টায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তুম ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এ সময় তার সঙ্গে যোগ দেয় নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং বিআইডব্লিউটিএর ডুবরিরা।
শুক্রবার দুপুর ২টা পর্যন্ত কোন মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারে না। এমনকি ডুবে যাওয়া লঞ্চটির অবস্থান ও শনাক্ত করতে দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা লেগে যায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তুমের।
এমভি রুস্তমের কমান্ডার বজলুল হক জানান, নদীর যে স্থানে লঞ্চটি দুর্ঘটনায় কবলিত হয়েছে সে স্থানে পানির গভীরতা থাকায় লঞ্চটি শনাক্ত করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। এরপর লঞ্চটি শনাক্ত করার পর এটাকে পাড়ের কাছে নিতে হচ্ছে। শুধু পানির গভীরতার কারণেই এ সমস্যা হরচ্ছে। তবে আশা করা যায় খুব শীঘ্রই লঞ্চটিকে পাড়ে নেয়া সম্ভব হবে। তবে কি পরিমাণ লাশ রয়েছে তা বলা মুশকিল বলে তিনি জানান।
চাঁদপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এয়ার ভাইস (অব) রফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
বেঁচে যাওয়া যাত্রী দুলাল (৫২) এক ছেলে ইব্রাহীম (৯) এবং এক মেয়ে নাদিরাকে (১৪) নিয়ে মতলবের দুর্গাপুরের কালির বাজার যাচ্ছি। তিনি এবং তার মেয়ে নাদিরা সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও ছেলে ইব্রাহীম নিখোঁজ রয়েছে।
বেঁচে যাওয়া যাত্রী ফয়সাল (২৫) জানান, সাঁতরে তিনি পাড়ে উঠলেও তাঁরা মা নাজমা বেগমের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা তিনি বলতে পারছেন না।
বেঁচে যাওয়া আরেক শিশু ওমর ফারুক (১০) জানান, সে মায়ের সঙ্গে মতলব যাচ্ছিল। কিভাবে সে বেঁচে এসেছে বলতে পারছে না। শুধুই কাঁদছে।
নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল জানান, শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে লঞ্চটি ওই স্থানে পৌঁছালে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় ডুবে যায়। বাল্কহেডটি আটক করেছে জনতা।
জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল জানান, উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে। সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এই কমিটি দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দিবে । আপাতত ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ৫ লাখ টাকার সরকারী অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
এক পরিবারের ৭ জন নিখোঁজ ॥ এম এল সারস লঞ্চডুবিতে একই পরিবারের ৭ জন নিখোঁজ হওয়ার পর বিকেলে ময়না (২৫) নামের এক জনের লাশ উদ্ধার হলেও বাকি ৬ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছে। মততলবের কালীপুরা গ্রামে তাদের এক আত্মীয়ের লাশ দেখতে যাওয়ার পথে লঞ্চডুরিতে এ ঘটনা ঘটে।
নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল গ্রামের বিল্লাল হোসেনের নানি শাশুড়ির মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে বিল্লাল হোসেন ও তার ভাই তারেক মিয়াসহ আত্মীয়স্বজন মিলে একই পরিবারের ৯ জন মতলবের গোদনাইল কালীপুরার উদ্দেশে সারস লঞ্চে যাওয়ার পথে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনার ইসমানির চর লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় বিল্লাল হোসেন ও তার ভাই তারেক মিয়া সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও বাকি ৭ জনই নিখোঁজ হন। দুপুরে ডুবরিরা ময়না (২৫) নামের বিল্লাল হোসেনের শ্যালিকার লাশ উদ্ধার করলেও বাকি ৬ জনের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছে ময়নার বোন চায়না (২৩) ও চায়নার দুই শিশুসন্তান মীম (৭) ও সানজিদ (৫), চায়নার ভাই মুক্তার (২০), সাহনাজ (২০), তানিয়া ( ১৮)।
বিল্লাল হোসেন ও তারেক মিয়া তাদের স্বজনদের খোঁজে দিনভর নদীর বুকে ট্রলারে করে খুঁজে বেড়িয়েছেন। তাদের সঙ্গে আরও আত্মীয়স্বজন এসে খোঁজাখুজিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এভাবে কখনও ট্রলার দিয়ে নদীতে, কখনও নদীর তীরে আবার উদ্ধারকারী জাহাজ হামজায় এসে হারানো স্বজনদের খোঁজাখুঁজি করেছেন।
নিখোঁজ ৭ জনের মধ্যে দুপুরে ময়নার লাশ উদ্ধার হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনদের আহাজারিতে মেঘনা পারের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।
বিল্লাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি লঞ্চ থেকে কোন মতে বের হতে পারলেও আন্যদের চেষ্টা করেও বের করতে পারিনি। আমি কেন বেঁচে গেলাম। কি হবে আমার বেঁচে থেকে। আমি কার জন্য বাঁচব। সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এসব কথা বলতে বলতে তিনি বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন।
স্বজনদের আহাজারি ॥ লঞ্চডুবির ঘটনায় নিখোঁজ যাত্রীদের আহাজারিতে মেঘনা পারের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। ভাগ্যাক্রমে বেঁচে

No comments

Powered by Blogger.