গ্রন্থাগারে জব্বারের কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই

গফরগাঁওয়ে ভাষা শহীদ জব্বার গ্রন্থাগারে জব্বারের ওপর কোন গ্রন্থ নেই! স্মৃতি জাদুঘরে নেই জব্বারের কোন স্মৃতি চিহ্ন! উদ্বোধনের পর গত চার বছর ধরে ভাষা শহীদ জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর পড়ে আছে অযতœ আর অবহেলায়।
এ সময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণের কারণে প্রতিষ্ঠার চার বছরের মাথায় বিবর্ণ হয়ে পড়েছে ভাষা শহীদ জব্বারের এ স্মৃতি জাদুঘরটি। ভাষা শহীদ জব্বারের জন্মস্থান পাঁচুয়া গ্রামটিকে জব্বার নগর ঘোষণার দাবিটিও এখন পর্যন্ত উপেক্ষিত। এসব নিয়ে এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীরা হতাশ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামে জন্ম নেন ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে শহীদ এই বীর সন্তানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গত ২০০৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পাচুয়া গ্রামে উদ্বোধন করা হয় ভাষা শহীদ জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবালের নেতৃত্বে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন, ডা. হালিমা খাতুন ও বেগম রওশন আরার উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়েছিল এর আনুষ্ঠানিকতা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রায় ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ কাজের বাস্তবায়ন করে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ। ওই সময়ে সাড়ে তিন হাজারের মতো বই দেয়া হয় গ্রন্থাগারের জন্য। কিন্তু গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে জব্বারের ওপর কোন গ্রন্থ কিংবা স্মৃতিচিহ্ন রাখা হয়নি। পরবর্তীতে প্রতিবছর এ পাঠাগারের জন্য আরও বই দেয়া হলেও স্থানাভাবে এসব বই রাখা হয়েছে পাঠাগারের স্টোররুমে। লোকবলের অভাবে এর আগে গত ২০০৮-০৯ সাল পর্যন্ত এক বছর অযতœ আর অবহেলার সঙ্গে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল শহীদ জব্বার গ্রন্থাগারটি। তালাবদ্ধ করে রাখার কারণে ওই সময়ে গ্রন্থাগারের ভেতর বাইরে ময়লা ও নোংরা পরিবেশ এ সৌন্দর্যকে মলিন করে তোলে। ফলে ভবন-সর্বস্ব এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে এসে নতুন প্রজন্ম ভাষা শহীদ জব্বার সম্পর্কে কোন কিছুই জানতে পারেনি। হতাশ হয়ে ফিরে গেছে দর্শনার্থীরাও।
গত ২০০৯ সালে একজন কেয়ারটেকার নিয়োগ দেয়া হলেও এ সময়ে কোন সংস্কার কাজ না করায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এর সৌন্দর্য। আর দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণের কারণে অনেকটা পরিত্যক্ত ও ভুতুড়ে অবস্থা চলছে এর পরিবেশ। ঢাকা কলেজের ছাত্র দর্শনার্থী নূরে আলম ও তারেক মো. জোনায়েদ সিদ্দিকী জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর দেখতে এসে আক্ষেপ করে জানান, এ রকম একটি স্থাপনার এ রকম দুরবস্থা মেনে নেয়া যায় না। এটি একজন ভাষা শহীদের প্রতি অবমাননার শামিল। ভাষা শহীদ জব্বারের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী মাওলানা আব্দুল হাই রণভাওয়ালি (৮৫) জানান, জব্বার গ্রন্থাগারে জব্বারের ওপর কোন গ্রন্থই না থাকে কিংবা সেখানে কোন পাঠের সুবিধা না থাকে তাহলে ভাষা শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এ রকম আয়োজন ও উদ্দেশ্য দুঃখজনক। স্মৃতি জাদুঘরে জব্বার ও তার পরিবারের ছবিসহ নানা কিছু রাখা যেত। কিন্তু সেটিও করা হয়নি বলে হতাশ মাওলানা রণভাওয়ালি। পাঠাগারে জব্বারের জীবন ও কর্মের ওপর এককভাবে কোন বই না থাকায় হতাশ দর্শনার্থী ও স্থানীয় পাঠকেরা। এছাড়া শুক্রবারের ছুটির দিনটিতে পাঠাগার বন্ধ থাকায় এলাকার ছাত্রছাত্রীরা পাঠাগারে বই পড়ার কাক্সিক্ষত সুযোগ পাচ্ছে না বলে অনুযোগ গফরগাঁও চরআলগীর চরমসলন্দ গ্রামের কলেজ ছাত্রী আসমা ও তানিয়ার। কেয়ারটেকার দেলোয়ার হোসেন জানায়, এর আগে পাঠাগারের জন্য চারটি দৈনিক পত্রিকা সরবরাহ করা হলেও গত ২০১২ সালের জুন মাস থেকে পত্রিকা সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে পত্রিকা ও বই পুস্তক পড়ার জন্য আসা পাঠক এখন কমতে শুরু করেছে। পাঠক ও দর্শনার্থী কমতে শুরু করায় এর পরিবেশ দিন দিন ভুতুড়ে হয়ে উঠছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, ভাষা শহীদ জব্বারের জন্মস্থান পাঁচুয়া গ্রামকে জব্বার নগর ঘোষণার দাবিটিও এখন পর্যন্ত উপেক্ষিত। গফরগাঁওবাসীর এই দাবিটিরও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি মেলেনি আজও। পাঁচুয়া গ্রামে ভাষা শহীদ জব্বার স্মৃতি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এএইচএম আসাদ নয়ন জানান, ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের উদ্যোগে জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর সংলগ্ন ভাষা শহীদ স্মৃতি স্কুলটির উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে। এতে শ্রেণী কক্ষ নির্মাণের কাজ শেষ হলেও শিক্ষকদের জন্য কোন অফিস রাখা হয়নি বলে অনুযোগ এই স্কুল শিক্ষকের। তবে এরই মধ্যে স্কুলটিকে সরকারীকরণ করায় দারুণ খুশি স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শহীদ জব্বারসহ সকল শহীদের ওপর পর্যাপ্ত গ্রন্থ সরবরাহ করে অবিলম্বে গ্রন্থাগারটি কার্যকর রাখার দাবি জানিয়েছেন ভাষা শহীদ জব্বার পরিবারের সদস্যরা। শহীদ জব্বারের পুত্র নুরুল ইসলাম বাদল গফরগাঁওয়ে ভাষা শহীদ জব্বারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সরকারের নানা উন্নয়ন কাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে শহীদ পরিবারের এই সদস্যরা আশা প্রকাশ করে জানান, সরকার জব্বার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে হালুয়াঘাট উপজেলার শিমুলকুচি গ্রামেও নতুন করে ভিন্ন একটি উদ্যোগ পরিকল্পনা নেবে। কারণ শহীদ পরিবারের সদস্যরা অনেক আগেই গফরগাঁও থেকে স্থানান্তর হয়ে হালুয়াঘাটের শিমুলকুচি গ্রামে নতুন করে বসবাস করছেন। শিমুলকুচি গ্রামে শহীদ পরিবারের উদ্যোগে গঠন করা হয়েছে জব্বার ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্কুল, শহীদ মিনার ও মসজিদ। পরিবারের দাবি, এসব প্রতিষ্ঠানেও সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। ভাষা শহীদ জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি সত্যিকার অর্থেই বাংলা ভাষা চর্চা ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। শহীদ জব্বার সম্পর্কে জানতে পারবে নতুন প্রজন্মÑএমন আশা করছে ময়মনসিংহবাসী।

জব্বারের গ্রামে কলাগাছের স্থলে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার

গফরগাঁওয়ে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের নিজ গ্রামের বাড়ি পাঁচুয়ায় কলাগাছের তৈরি শহীদ মিনারের স্থলে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার। এটি করা হয়েছে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের স্মৃতিকে ধরে রাখতে। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পাঁচুয়ার আশপাশের সাত গাঁয়ের মানুষ এই বীর শহীদকে মিনারে এসে শ্রদ্ধা জানায় বর্ণিল ফুলেল ভালবাসায়। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’-গানে আর সুরে সারি সারি জনতার প্রভাতফেরি শেষে দিনভর আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জব্বার মেলা আর চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে নানা বয়সী মানুষের গমগম করা ভিড়ে উৎসব মুখর হয় জব্বার নগর গ্রামের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। উপজেলা পরিষদের অর্থ সহায়তা আর স্থানীয় লোকদের শ্রম এই মিলে হয়েছে আজকের এই দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার।
গফরগাঁও উপজেলা সদর থেকে মাত্র পাঁচ কিমি. দূরের গ্রাম পাঁচুয়া। সবুজ ছায়াঘেরা এই গ্রামেই জন্মেছিলেন ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে শহীদ বীর সন্তান আব্দুল জব্বার। ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন শাশুড়ির ওষুধ কেনার জন্য হাসপাতালের বাইরে গিয়ে মিছিল দেখে যোগ দিয়েছিলেন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের এই মিছিলে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিকসহ অনেকের সঙ্গে শহীদ হন পাঁচুয়ার এই বীর সন্তান। এরপর কেটে গেছে বহুদিন। সেদিনের আন্দোলনের ধারাবাহিকতার ফসল দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা। তবে ভাষা শহীদ জব্বারই বা কেন উপেক্ষিত থাকবে। আর তাই গর্বিত এলাকাবাসী উদ্যোগ নিয়ে শহীদ জব্বারের স্মৃতিকে ধরে রাখতে জব্বারের নিজ গ্রাম গফরগাঁওয়ের পাঁচুয়ায় গড়ে তোলে শহীদ মিনার। প্রায় ৩০ বছর আগে পাঁচুয়া গ্রামের নুরুজ্জামান মাস্টার, আশরাফ উদ্দিন, ভাষা শহীদ জব্বারের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী মাওলানা আব্দুল হাই রণভাওয়ালি, পাঁচুয়া গ্রামের ভাষা শহীদ জব্বার স্মৃতি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এএইচএম আসাদ নয়ন ও আবুল হাশেম মাস্টারসহ অনেকে কলাগাছ পুঁতে শহীদ মিনার নির্মাণ ও তাতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন চালুর উদ্যোক্তা। প্রথম দিকে গ্রামবাসী প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে জব্বারের বাড়িতে কলাগাছ পুঁতে বানানো। এ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাত। পরে ভাষা শহীদ জব্বারের স্মৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গফরগাঁওয়ের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গৌতম কুমারের উদ্যোগে পাঁচুয়া গ্রামে গত ২০০৫ সালে স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয় এ শহীদ মিনার।
-বাবুল হোসেন ও আব্দুল আওয়াল, গফরগাঁও ময়মনসিংহ

No comments

Powered by Blogger.