নিজের জমিতেও কবর হয়নি এক খুনীর- পাপের ফল

 জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা মামলায় ফাঁসি হয়েছে লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমেদের। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার সাগরপাড়ের গ্রাম মৌডুবির নিজকাটা গ্রামে পিতার কবরের পাশে বৃহস্পতিবার শেষ বিকেলে তাকে দাফন করা হয়েছে।
কিন্তু যে জমিতে তাকে দাফন করা হয়েছে সে জমির মালিক সে বা তার পিতা নয়। সেটি সরকারী খাসজমি। নিজের কেনা জমিতেও তার কবর হয়নি। অন্যদিকে, মহিউদ্দিনের নিজের বসতভিটায় এখন ঘুঘু চড়ে। বসতভিটায় নেই কারও ঘরবাড়ি। সেটি বহু বছর ধরে পড়ে আছে শূন্য। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরম্ন করে পাড়া-প্রতিবেশী ও গ্রামের মানুষ সকলেই মনে করে এসবই পাপের ফল। তা না হলে পঁচাত্তরের পরে যার দাপটে বাঘে মোষে এক ঘাটে পানি খেত। সেই খুনী মহিউদ্দিন কেন পায়নি নিজের মাটি। এ নিয়ে এলাকাতে যথেষ্ট চাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এ সব তথ্য।
নিজের ইচ্ছানুযায়ী খুনী আর্টিলারি মহিউদ্দিন আহমেদকে তার পিতা আবদুর রহমান হাওলাদারের কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে। কয়েক প্রতিবেশী জানিয়েছেন, আবদুর রহমান হাওলাদার ২০/২২ বছর আগে অত্যনত্ম দরিদ্র ও অসহায় অবস্থায় মারা গেছেন। আবদুর রহমান হাওলাদার তিনটি বিয়ে করেছিলেন। তিন সংসারে সাতটি ছেলেমেয়ে থাকলেও কেউই এ বৃদ্ধের খোঁজ নিত না। মহিউদ্দিন ও তার পিতা আবদুর রহমান হাওলাদার দু'জনকেই দাফন করা হয়েছে সরকারী খাসজমিতে। মহিউদ্দিনের ছোট ভাই নাসির হাওলাদারের বিধবা স্ত্রী বিলকিছ বেগম (৪৭) জানান, যে জমিতে হ্যাগো কবর দেছে হেইডা মোগো দহলে (দখলে) আছে। মোর স্বামী হেইডা পত্তন নেছেলে বইলা হুনছি। তয় মোগো ধারে কোন কাগজ নেই।
কয়েক প্রতিবেশী জানালেন, বিলকিছ বেগমের বাড়িটিও সরকারী খাসজমিতে। যদিও বিলকিছ বেগম তা অস্বীকার করেন। তবে তাঁদের দখলে কিছু খাসজমি আছে বলে স্বীকার করেন। বিলকিছ বেগমের ঘর থেকে সামান্য কিছুটা পশ্চিমে মহিউদ্দিনকে দাফন করা হয়েছে।
এদিকে, মহিউদ্দিনের নিজের মালিকানাধীন বাড়ি না থাকলেও পৈত্রিক সূত্রে একটি বাড়ির ভিটির মালিক হয়। সে ভিটিতে বহু আগে পিতা আবুল হোসেনের ঘর ছিল। কিন্তু এখন কোন ঘর নেই। অনেক বছর ধরেই বাড়ির ভিটি শূন্য পড়ে আছে। মহিউদ্দিনের চাচা আবুল হোসেন হাওলাদার (৬৪) ঘরের শূন্য ভিটি দেখিয়ে জানালেন, মহিউদ্দিনের ভয়ে ভিটিতে কেউ ঘর তুলতে সাহস পায়নি। ভিটার চারদিকে ছয়টি ঘর থাকলেও মহিউদ্দিনের ভিটা অনেক বছর ধরেই খালি পড়ে আছে। সে ভিটাতে দিনে ঘুঘু চড়ে আর রাতে শেয়াল-কুকুর আসত্মানা গাড়ে।
কয়েক আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের মানুষ আরও জানান, আর্টিলারি মহিউদ্দিন পৈত্রিক সূত্রে এক একরের মতো জমি পেয়েছিল। এ ছাড়া বেশ কিছু সরকারী খাসজমি দখলে নিয়েছিল। মহিউদ্দিনের বাড়ির লাগোয়া রেজিস্ট্রি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক মাহবুব বাবু জানান, গ্রেফতার হওয়ার আগে মহিউদ্দিন প্রতি বছর ২/১ বার গ্রামের বাড়ি আসত। গ্রেফতারের পরে তার স্ত্রী ও সসত্মানরা আসত। তারা সব জমি আগাম একসনা বন্ধক দিয়ে নগদ টাকা নিয়ে যেত। এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে মহিউদ্দিনের ভাইয়ের ছেলে হেলাল (১৬) জানায়, বড় চাচা জেলে যাওয়ার পরেও চাচি আসত এবং জমির দরম্নন টাকা নিয়ে যেত। তারা তাদের তেমন কোন খোঁজ নিত না।
নিজের বাড়ির ভিটা ও জমি রয়েছে। কিন্তু সে জমিতে মৃতু্যর পরেও ঠাঁই হয়নি খুনী মহিউদ্দিনের। বিষয়টি ভাল চোখে দেখছে না গ্রামের মানুষ। গ্রামের মানুষের কাছে বিষয়টি বেশ চাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করে এটিও এক ধরনের শাসত্মি। প্রতিবেশী সোবাহান মোলস্না (৫৬) জানান, পঁচাত্তরের পরে যখনই মহিউদ্দিন গ্রামে আসত। মনে হতো দেশের সবচেয়ে মতাধর কোন ব্যক্তি এসেছে। তার দাপটে কাঁপত গোটা তলস্নাট। বহু সরকারী কর্মচারী এসেও তাকে সালাম করে যেত। অথচ সেই লোকটার কবর হয়েছে চরম অবহেলায় সরকারী খাসজমিতে। নিজের জমিতে ঠাঁই হয়নি। এটা নিশ্চয়ই অনেক পাপের ফল। আরেক প্রতিবেশী ও এলাকার প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবদুল মজিদ জানান, মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর মতো মহান ব্যক্তিত্বকে খুন করেছে। সেই কুলাঙ্গার নিজের জমিতে ঠাঁই পাবে না এটি মহান আলস্নাহ্ আগেই ঠিক করে রেখেছে। এটি আলস্নাহ্র দেয়া শাসত্মি। একদিন এই জমিতে কেউ ধান চাষ করবে। তখন মহিউদ্দিনের কবরের চিহ্ন থাকবে না। সালাম গাজীসহ আরও কয়েকজন জানান, এমনিতেই গ্রামের মানুষ চায়নি মহিউদ্দিনের কবর এখানে হোক। এখন গ্রামের মানুষের চাওয়া পূর্ণ হতে চলেছে। একদিন কবরটি ঠিকই অন্যের দখলে চলে যাবে। তখন খুনীর কোন চিহ্ন থাকবে না ঐ গ্রামে।

No comments

Powered by Blogger.