পাবলিক ভার্সিটিতেও বৈষম্যেও চিত্র-মহিলা শিৰকের সংখ্যা মাত্র ১৭ ভাগ- দলবাজি, দলীয়করণ আত্মীয়করণসহ চরম অস্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্যই মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও মেয়েরা চাকরি পাচ্ছেন না জরিপে তথ্য

বিভাষ বাড়ৈ কেবল স্কুল আর কলেজই নয়, মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কাঙ্ৰিত সংখ্যক মহিলা শিৰক নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ হাজার ৫৯৯ স্থায়ী শিৰকের মধ্যে মহিলা শিৰকের সংখ্যা মাত্র ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মোট শিৰকের মধ্যে মহিলা মাত্র ১ হাজার ৩৪৩।
এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে যেখানে কোন মহিলা শিৰকই নেই। প্রায় একই অবস্থা সরকারী মেডিক্যাল কলেজেও। দেশে পরিচালিত চলমান জাতীয় শিা জরিপের প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক-শিকিার এ তারতম্যের চিত্র। আর এ অবস্থার জন্য দলবাজি, দলীয়করণ, আত্মীয়করণসহ চরম অস্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই দায়ী করছেন দেশের বিশিষ্ট শিৰাবিদ ও জরিপের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা। তাঁদের অভিমত, বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর শিৰক নিয়োগে দলীয় ও ব্যক্তিগত পরিচয়সহ ৰমতার দাপট প্রাধান্য পাওয়ায় কেবল নারীরাই নয়, একইভাবে ছিটকে পড়ছে মেধাবী ছেলেরাও। ফলে মেধাবীদের হারাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়।
সমপ্রতি শিৰা জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে দেশের নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিা প্রতিষ্ঠানে শিৰক-শিৰিকা সংখ্যার তারতম্যের চিত্র। ১০ বছর পর বাংলাদেশ শিা তথ্য ও পরিসংখ্যান বু্যরো (ব্যানবেইস) পরিচালিত এবারের জরিপে দেখা যায়, প্রতি প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের জন্য সরকারীভাবে ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করা হলেও তা নিশ্চিত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। এ মুহূর্তে এসব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিা প্রতিষ্ঠানের ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৪৫৫ শিকের মধ্যে মহিলা শিৰকের সংখ্যা মাত্র ১৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। স্কুলে ২৩ দশমিক ৭, কলেজে ২০ দশমিক ৪, কারিগরি ও ভোকেশনালে গড়ে ১৯ দশমিক ৪ এবং মাদ্রাসা শিা প্রতিষ্ঠানে মহিলা শিকের সংখ্যা মাত্র ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানে গড়ে ১৪ শিকের মধ্যে মহিলা শিক আছেন মাত্র ২ জন। এ পরিস্থিতি মোটেই সনত্মোষজনক নয় মনত্মব্য করে ব্যানবেইস পরিচালক আহসান আব্দুলস্নাহ বলেছেন, পরিসংখ্যান প্রমাণ করে আমরা প্রয়োজনীয় সংখ্যক মহিলা শিক এখানও নিশ্চিত করতে পারিনি। জানা গেছে, সরকারের বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী ৩০ শতাংশ মহিলা শিক নিয়োগের কথা। এমনকি মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে সরকারীভাবে তাদের জন্য ৪০ শতাংশ কোটা বরাদ্দের উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যানবেইসের জরিপে এবার বেরিয়ে এসেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারী মেডিক্যাল কলেজের চিত্রও। একইভাবে বেরিয়ে এসেছে বেসরকারী মেডিক্যাল এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যায়ের চিত্র। দেশের বিশিষ্ট শিৰাবিদ, জরিপের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল-কলেজের মতো নারী শিৰকের জন্য কোটা পূরণ করতে হয় না এ কথা সত্য। কিন্তু এখানে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কাঙ্ৰিত সংখ্যক মহিলা শিৰক নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই যদি অস্বচ্ছতার কারণে নারী, এমনকি মেধাবী ছেলেরাও পিছিয়ে পড়ে তাহলে শিৰার নিম্নসত্মরের অবস্থা ভাল হবে এমনটা আশা করা দুরূহ। জানা গেছে, দেশে এ মুহূর্তে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৩১টি। এর মধ্যে ৩টির শিৰা কার্যক্রম এখনও শুরম্ন হয়নি। মোটর্ িশৰক হলো ৭ হাজার ৫৯৯। মহিলা শিৰক ১ হাজার ৩৪৩। অর্থাৎ শতকরা ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এ মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা শিৰক আছেন ২৫ শতাংশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শতাংশ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ শতাংশ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে ১৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ শতাংশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ শতাংশ, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ শতাংশ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ শতাংশ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শতাংশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ শতাংশ, গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ শতাংশ, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ শতাংশ, টাঙ্গাইলে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন মহিলা শিৰক নেই। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ শতাংশ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, চিটাগং ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টেকনোলজিতে ১১ শতাংশ, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টেকনোলজিতে ৪ শতাংশ, খুলনা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জনিয়ারিং এ্যান্ড টেকনোলজিতে ৪ শতাংশ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টেকনোলজিতে ১৯ শতাংশ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ শতাংশ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ শতাংশ, কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ শতাংশ, কবি নজরম্নল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ শতাংশ, চিটাগং ভেটেরিনারি এ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স ইউনিভার্সিটিতে ১৫ শতাংশ মহিলা শিৰক রয়েছেন। যশোর এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰা কার্যক্রম এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে শুরম্ন হয়নি। ফলে শিৰা জরিপে এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোন তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। জরিপে বলা হয়েছে, জগন্মাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা শিৰক কর্মরত আছেন ৪৩ শতাংশ। তবে ব্যানবেইসের সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া এ প্রতিষ্ঠানে সরকারী কলেজের মহিলা শিৰকরা ডেপুটেশনে কাজ করছেন বেশি।
এছাড়া দেশের ১৫টি সরকারী মেডিক্যালে শিৰক আছেন ১ হাজার ২১৮। মহিলা শিৰক ২৪০। মোট শিৰকের মধ্যে মহিলা শিৰক ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ২৭টি বেসরকারী মেডিক্যালে শিৰক আছেন ১ হাজার ৩৭। যার মধ্যে মহিলা শিৰক আছেন ১২৩। মোট শিৰকের মধ্যে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ মহিলা শিৰক। শিৰকের এ তারতম্যের কথা বলতে গিয়ে ব্যানবেইসের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি মেধার দিক থেকে মেয়েরা পিছিয়ে নেই। বরং অনেক ৰেত্রে তাদের ফলাফল খুবই ভাল। কিন্তু শিৰকতায় আসতে নানামুখী সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন তাঁরা। যার মধ্যে অন্যতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিৰক নিয়োগে শিৰার্থীর মেধার চেয়ে কর্তৃপৰের সঙ্গে প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয়ই প্রাধান্য পায়। প্রাধান্য পায় কতর্ৃপৰের সঙ্গে আত্মীয়তা ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং ৰমতার দাপট। আর এসব কারণে স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে পড়েন নারীরা; এমনকি মেধাবী ছেলেরাও। নিয়োগ প্রক্রিয়ার এ সঙ্কটের কারণে দিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাবীদের হারাচ্ছে বলে আৰেপ করেন ব্যানবেইসের ঐ কর্মকর্তা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীসহ মেধাবীদের বঞ্চিত করার এ ঘটনা শিৰার জন্য অশুভ বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট শিৰাবিদরাও। বিশিষ্ট শিৰাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এখানে দু'টি বিষয়ই গুরম্নত্বপূর্ণ। এক মেধাবী হয়েও মেয়েরা শিৰক হিসেবে আশানুরূপ আসতে পারছেন না। অন্যটি হলো, মেধাবী ছেলেরাও পিছিয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, আমার মনে হয় শিৰক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবের যে অভিযোগ আছে এর মাধ্যমে সেই অভিযোগটি আরও সত্য প্রমাণিত হলো। দু'একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ে শিৰকই নেই। এমন তথ্য প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের আসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সকলের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত না হলে তো তাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে না।
অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, আসলে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিৰক হিসেবে নিয়োগে বহু বছর যাবত মেধার চেয়ে প্রার্থীর দলীয় ও ব্যক্তিগত পরিচয়ই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। তিনি বলেন, উচ্চ শিৰাঙ্গনে বছরের পর বছর যাবত শিৰক নিয়োগে দলীয় ও ব্যক্তিগত পরিচয়সহ ৰমতার দাপট প্রাধান্য পাওয়ায় কেবল নারীরাই নয়, একইভাবে ছিটকে পড়ছে মেধাবী ছেলেরাও। ফলে মেধাবীদের হারাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি আরও বলেন, দেশ তথা দেশের শিৰার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে মেধাবীদের জন্য উপযোগী করে তোলা জরম্নরী।

No comments

Powered by Blogger.