বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় বাংলায় রূপান্তর : by এনামুল হক

(পূর্ব প্রকাশের পর) খান সাইফুর রহমান আরও বলেন, ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে তাৎণিক ঘটনাটির উৎপত্তি হয়েছিল। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি ছিল একটা সহজ সরল বিদ্রোহ এবং তদুপরি দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা কিম্বা ১২০ খ ধারার আওতাধীনে এ সংক্রান্ত কোন চুক্তি বা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বা পূর্ব পরিকল্পিত পরিকল্পনা বা পূর্ব আয়োজিত পরিকল্পনার অস্তিত্ব ছিল না।
বিজ্ঞ কেঁৗসুলি আরও যুক্তি দেখান যে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতের ঘটনায় কোন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার কিম্বা সেনা আইনের অধীন নয় এমন অপর কোন ব্যক্তি যোগ দিয়ে থাকলেও সেনা আইনের ৩১ ধারার পরিসীমার মধ্যে সেটাও হবে বিদ্রোহ এবং তদনুযায়ী তাদেরকেও সেনা আইনের অধীনে কোর্ট মার্শালে বিচার করা উচিত ছিল। উপরন্তু বর্তমান আপীলে উলি্লখিত রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। এই দিক দিয়ে যে উভয় মামলায় তাঁরা ছিলেন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। বর্তমান আপীলের েেত্র সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ও ল্যান্সার ইউনিটের অফিসার ও জওয়ানরা ঢাকা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় রাষ্ট্রপতিকে তাঁর সরকারী বাসভবনে হত্যা করেছিল। অন্যদিকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের েেত্র সেনাসদস্যরা ১৯৮১ সালের ২৯ মে দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যেখানে অবস্থান করছিলেন সেই সার্কিট হাউজে তাঁকে হত্যা করে। উভয় হত্যাকাণ্ড যেহেতু একইভাবে সংঘটিত হয়েছিল তাই আপীলকারীদের যদি তারা ১৫ আগস্টের ঘটনায় আদৌ জড়িত থেকে থাকে, কোর্ট মার্শালে বিচার হওয়া উচিত ছিল যেমনটি হয়েছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বেলায়। অধিকন্তু রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচার কোর্ট মার্শালে হওয়া উচিত ছিল। এই বক্তব্যের সমর্থনে বিগত কেঁৗসুলি জামিল হক বনাম বাংলাদেশ, ৩৪ ডিএলআর (এসসি) ১২৫ মামলাটির উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে আনিসুল হক বলেন, ঘটনাটা বিদ্রোহ নয় বরং পূর্ব পরিকল্পিত হত্যা এবং সেই কারণে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানের অধীনে আপীলকারীদের বিচারের আইনগত কোন বাধা নেই, যা সেনা আইনের ৫৯, ৯২, ৯৪, ৯৫ ধারা, নৌবাহিনী অধ্যাদেশে ১৯৬১-এর ৩৫ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৯ ধারার বিধানসমূহে পরিদৃষ্ট হবে। বিজ্ঞ এ্যাটর্নি জেনারেল জনাব হকের বক্তব্য অনুমোদন করে তার সঙ্গে যোগ করেন যে আপিলকারীরা বিচারিক আদালতে এ বিষয়টি তোলেননি এবং আদালতকে বিভ্রান্ত করার অসদুদ্দেশ্য নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে প্রথমবারের মতো প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন। উপরন্তু লিপিবদ্ধ সা্য প্রমাণ থেকে বিদ্রোহের ব্যাপারটা আপীলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যথাযথভাবেই গঠিত হয়েছে। যদি ধরেও নেয়া যায় যে, সেনাবাহিনী আইনের ৫৯ (২) ধারার সঙ্গে পঠিত ৮(২) ধারার অর্থে ঘটনাটা একটা সিভিল অপরাধ তথাপি সেনাবাহিনী আইনের ৯৪ ধারার পরিপ্রেেিত এমন অপরাধের বিচার করার সহবর্তমান প্রক্রিয়ার ফৌজদারি আদালতের রয়েছে।
রাষ্ট্রপরে বিজ্ঞ কেঁৗসুলি তৌফিক নেওয়াজ বলেন, তদানীন্তন রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ডের সময় বলবৎ থাকা সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের কতিপয় বিধানে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ও আইনগত ব্যক্তিত্বের যে চিত্রটি দেয়া ছিল সেটা অতিমাত্রায় সুস্পষ্ট। তদনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবার কারণে তদান্তীন্তন রাষ্ট্রপতিকে সেনাবাহিনীর লোক হিসাবে গণ্য করার জন্য একটি মাত্র আইন অর্থাৎ সেনাবাহিনী আইন ১৯৫২ কিম্বা সে আইনের একটি বিধানের ভিত্তিতেই শুধু তার অবস্থানকে বিবেচনা না করে সংবিধানের অধীনে তিনি যে আইনগত ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা ও দায়মুক্তি ভোগ করতেন এবং তার যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল সেগুলোকে সাংবিধানিক বিধানাবলীর ভিত্তিতেই বিবেচনা করতে হবে এবং সেই কারণে কোর্ট মার্শালের পরিবর্তে আপীলকারীদের ফৌজদারি আদালতে বিচার করা আইনসম্মত। দেখা যায় যে, আসামিপ রাষ্ট্র পরে সাীদের জেরাকালে কিম্বা তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার সময় বিদ্রোহের কোন কৈফিয়ত লাভ করেনি। রাষ্ট্রপরে সাীরা আসামি পরে বিদ্রোহের কৈফিয়তের সমর্থনে কিছু না বলায় আসামি পরে উচিত ছিল রাষ্ট্রপরে সাীদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, বিদ্রোহে জড়িত অফিসার ও জওয়ানরা তাদের দাবিনামা পেশ করেছিল এবং সেই দাবিনামা মেনে না নেয়ায় তারা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে। পান্তরে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের প থেকে রাষ্ট্রপরে ২৪ নং সাীকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে মেজর ডালিম যখন হত্যার খবর বেতারে ঘোষণা করছিলেন সেসময় রাষ্ট্রপরে ২৪ নং সাী দেশে মার্শাল ল জারি এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার কথা জানতেন। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আসামিপ বলতে চেয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার পর সামরিক আইন ঘোষিত হয় এবং খোন্দকার মোশতাক আহমেদ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সাময়িক আইন প্রশাসক হন এবং এই বক্তব্যের দ্বারা আসামিপ এই সমর্থন সূচক কৈফিয়ত দাঁড় করাতে চেয়েছিল যে যেহেতু ঐ হত্যাকাণ্ড ছিল সেনাবাহিনীর সফল বিদ্রোহের পরিণতি তাই এমন হত্যাকাণ্ড হত্যাপরাধ নয়।
অবশ্য সংবিধানের বিধানাবলী অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিহত হবার পর তদানীন্তন উপরাষ্ট্রপতির উচিত ছিল রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করা। কিন্তু এই েেত্র সংবিধানের সেই বিধানগুলোকে উপো করা হয়েছিল। তদুপরি কোন বিদ্রোহ হয়ে থাকলে মতাসীন সরকারের উচিত ছিল ঘটনায় জড়িত অফিসার ও জওয়ানদের বিদ্রোহের জন্য সেনাবাহিনী আইনের অধীনে বিচার করা। অথচ এ ধরনের কোন পদপে নেয়া তো হয়নি বরং ঘাতকরা সরকার কতর্ৃক পুরস্কৃত হয়েছিল। বেতার কেন্দ্রের কর্মচারী মোঃ রিয়াজুল হক (রাষ্ট্রপরে ৩৭ নং সাী) বলেছেন, মেজর ডালিম সকাল ৯টায় তিন বাহিনীর প্রধানদের এবং সেইসঙ্গে বিডিআর প্রধান ও পুলিশের আইজিকে ২ নম্বর স্টুডিওতে নিয়ে আসেন এবং পটপরিবর্তনের প েতাদের আনুগত্যমূলক বিবৃতি সেখানে রেকর্ড করা ও প্রচার করা হয়। লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদের প থেকে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে (রাষ্ট্রপরে ৪৫ নং সাী) স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সকালে এক সফল সামরিক অভু্যত্থান ঘটে এবং সেই অভু্যত্থানে খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির মতা গ্রহণ করেন, প্রতিরা বাহিনীর তিন প্রধানের সবাই তাদের অনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি (শফিউল্লাহ) ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি এবং খন্দকার মোশতাক ঘাতকদের সূর্য সন্তান আখ্যা দিয়েছিলেন। ফারুক রহমানের পরে এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল সাফায়াত জামিল (রাষ্ট্রপরে ৪৪ নং সাী) বলেন, ১৫ আগস্টের ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব ছিল না কারণ, পরবতর্ী সরকারগুলো ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের নিরাপত্তা ও আনুকূল্য দিয়েছিল এবং ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরাও ঘাতকরা বঙ্গভবনে অবস্থান করত এবং তারা একটা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে মোশতাক সরকারকে চালাত।
সাীদেরকে দেয়া উপরোক্ত বক্তব্যগুলোর মাধ্যমে আপীলকারীরা ঘটনাটিকে এক সফল সামরিক অভু্যত্থান হিসাবে আখ্যা দিয়েছিল। সরকারগুলোও তাদের নিরাপত্তা দিয়েছিল ও সূর্য সন্তান হিসাবে ঘোষণা দিয়ে তাদের পুরস্কৃতও করেছিল এবং আপীলকারীরাও বিদ্রোহের প েসমর্থনমূলক সাফাই গায়নি। আরও বলা চলে যে, ৩৪২ ধারার অধীনে প্রদত্ত বিবৃতিতে তারা এই প্রশ্নে অস্বাভাবিক রকম নীরব ছিল। হাইকোর্ট বিভাগে আপিলের পর্যায়ে এসে তারা তাদের অবস্থান বদলে ফেলে যদিও এই কৈফিয়তের সমর্থনে কোন বস্তুগত প্রমাণ নেই।
সেনাবাহিনী আইন ১৯৫২-তে বিদ্রোহের কোন সংজ্ঞা দেয়া না হলেও সেই আইনের ৩১ ধারায় বিদ্রোহের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
নৌবাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর ৩৫ ধারায় বিদ্রোহের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে যা নিম্নরূপ :
৩৫। এই অধ্যাদেশে বিদ্রোহের অর্থ হলো :
ক) বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের অথবা সেই বাহিনীসমূহের সঙ্গে সহযোগিতাকারী যে কোন বাহিনীর কিম্বা উক্ত বাহিনীসমূহের যে কোন একটির যেকোন অংশের আইনসম্মত কতর্ৃপকে উৎখাত করা বা প্রতিহত করা,
খ) অবাধ্যতার দ্বারা যাতে শৃক্মখলা ধ্বংস করা হয় তার জন্য কিম্বা কোন কর্তব্য বা সার্ভিস এড়িয়ে যাওয়ার ল্যে অথবা শত্রুর বিরুদ্ধে কার্যক্রমের ব্যাপারে এ ধরনের কতর্ৃপকে তেমন পরিস্থিতিতে অমান্য করা; কিম্বা
গ) বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে অথবা সেই বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতাকারী যে কোন বাহিনীতে কিম্বা সশস্ত্র বাহিনীসমূহের যে কোন বাহিনীর যে কোন অংশে যে কোন কর্তব্য বা সার্ভিস সম্পাদন ব্যহত করার ল্যে সশস্ত্র বাহিনী আইনের অধীন দুই বা ততোধিক ব্যক্তির একত্রে মিলিত হওয়া কিম্বা তেমন ব্যক্তিদের একত্রে মিলিত হওয়া যাদের মধ্যে অন্তত দু'জন সশস্ত্র বাহিনী আইনের অধীন।
নৌবাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর (৩৪) ধারায় প্রদত্ত সশস্ত্র বাহিনী আইনের সংজ্ঞার আলোকে বিদ্রোহের এই সংজ্ঞাটি যে সেনাবাহিনী আইন ১৯৫২'র েেত্র প্রযোজ্য সে ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই। ওই ধারাটিতে বলা আছে যে, সশস্ত্র বাহিনী আইন বলতে এই অধ্যাদেশ সেনাবাহিনী আইন ১৯৫২, বিমানবাহিনী আইন ১৯৫৩ এবং এগুলোর অধীনে প্রণীত বিধি ও বিধানসমূহকে বোঝায়। (ক্রমশ)

No comments

Powered by Blogger.