আন্দোলনের জন্য সংগঠিত হচ্ছে, নেপথ্যে জামায়াত- ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল by মামুন-অর-রশিদ

 ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য সংগঠিত হচ্ছে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের প্রতিবাদের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর।
এই দু'টি ইসু্যতে নেপথ্যে থেকে ছোট ইসলামী দলগুলোকে সংগঠিত করছে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত। শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে জামায়াত নেতা নিজামীর বক্তব্য 'অর্জনের চেয়ে বিসর্জন বেশি'। কোর্টের রায় অনুযায়ী,পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ৰেত্রে নির্বাচন কমিশনও কোর্টের রায় মেনে নেয়ার কথা বলেছে। আর এই খবরে মারমুখী হয়ে উঠেছে ইসলামী দলগুলো। ইতোমধ্যে তারা ইসলামী রাজনীতি রৰার আন্দোলন জোরদার করতে গঠন করেছে 'ইসলাম ও ধর্মীয় রাজনীতি রৰা জাতীয় কমিটি'। কথিত 'ইসলামী রাজনীতি বন্ধের ষড়যন্ত্রের' প্রতিবাদে তারা গত সপ্তাহে মুক্তাঙ্গনে 'সর্বদলীয় সমাবেশ' করেছে। হাতেগোনা নেতাকর্মী সমর্থক আর নামসর্বস্ব এসব ইসলামী দলকে সংগঠিত করে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করার মূল পরিকল্পনা বাংলাদেশবিরোধী যুদ্ধাপরাধী জামায়াত চক্রের। 'ইসলাম ও ধর্মীয় রাজনীতি রৰা জাতীয় কমিটি' কিংবা 'সর্বদলীয় সমাবেশে' জামায়াত নেতাদের অবস্থান এবং বক্তব্যই প্রমাণ করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে তারাই নেপথ্য নিয়ন্ত্রক।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ঢাকা মহানগরের প্রচার সম্পাদক শহিদুল কবির জনকণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন,পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়ের বিরম্নদ্ধে আগের সরকার আপীল করেছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই আপীল প্রত্যাহার করে নেয়ায় আমরা আন্দোলনে নেমেছি। আইনমন্ত্রী ইসলামী রাজনীতি বন্ধের যে কথা বলেছেন আমরা সেই বক্তব্যের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছি। হাইকোর্টের নির্দেশে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে '৭২-এর সংবিধান বহাল থাকবে এবং সে মোতাবেক ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে_এখানে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে কিছু আসে যায় কিনা_ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে চায় বলেই পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের বিরম্নদ্ধে আগের সরকারের আপীল প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক শক্তি হিসাবে এই সরকারকে জনগণ নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট দিয়েছে। সরকার চাইলে পার্লামেন্টের মাধ্যমেও '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে পারত। কিন্তু সরকার সেদিকে যাচ্ছে না। বরং তারা কোর্টের নির্দেশ মেনে নিচ্ছে_এমন বক্তব্যে শহিদুল কবির বলেন, সরকার জনগণের কাছে ওয়াদাবদ্ধ কোরান-সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন করবে না। '৭২-এর সংবিধান কার্যকরকরণ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরম্নদ্ধে অবস্থান নেয়াই সরকারের ওয়াদার বরখেলাপ। তাই সরকার যাতে জনগণের দেয়া ম্যান্ডেটের অপব্যবহার করতে না পারে সেজন্যই আন্দোলনে নামছি। এসব বলার পর শহিদুল কবির জনকণ্ঠ প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন_আমি কি বোঝাতে পারলাম। এই প্রশ্নের উত্তরে সরকার কোর্টের নির্দেশ বাসত্মবায়ন করলে তারা কি করবে জানতে চাইলে শহিদুল কবির বলেন, যাতে পার্লামেন্টে সরকার কোর্টের নির্দেশ বাসত্মবায়নের ব্যাপারে সিদ্ধানত্ম না নেয় সে জন্যই তো আমাদের আন্দোলন।
উলেস্নখ্য, স্বাধীনতার পর '৭৫-এর আগস্ট ট্র্যাজেডিতে সামরিক অভু্যত্থানের মাধ্যমে ৰমতা দখলের পর সামরিক ফরমানের বলে সংবিধানের ধর্মনিরপেৰ চরিত্র রৰিত ছিল যে অনুচ্ছেদে সেটা বাতিল করা হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান আনীত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ওই ফরমানের সাংবিধানিক বৈধতা হয়। এর ফলে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের শরাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন ও রাজনীতি অনুশীলনের পথ প্রশসত্ম করে দেয়া হয়। বিগত বিএনপি শাসনের শেষ দিকে হাইকোর্টেও এক রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হয়। তৎকালীন জোট সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরম্নদ্ধে আপীল করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকার এই আপীল প্রত্যাহার করে নেয়। আর এতেই '৭২-এর সংবিধানই কার্যকর হওয়ার অবস্থা তৈরি হয়। '৭২-এর সংবিধান কার্যকর হলে দেশে ধর্মেভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এই সরল সত্যটি বুঝেই ইসলামী দলগুলো আন্দোলনে নামার পাঁয়তারা করছে। এদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে নির্বাচন কমিশনও তা মেনে নেয়ার কথা জানায়। তাছাড়া বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনের বিধান মেনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী কোরান-সুন্নাহর আইন কায়েমের লৰ্য ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধান মেনে চলার শর্ত মেনে নিয়েই নিবন্ধন নিয়েছে। তখন ধর্মকে অাঁকড়ে থাকার জায়গার ছাড় দিলেও এখন আওয়ামী লীগ ৰমতায় আসার পর আবার তারা ধর্মকে ইসু্য করে আন্দোলনে নামার হুমকি দিচ্ছে।
গত শুক্রবার বাদ জুমা 'ইসলাম ও ধর্মীয় রাজনীতি রৰা জাতীয় কমিটি' পল্টন মোড়ে সমাবেশ করেছে। এই সমাবেশে বক্তৃতা করেন ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও ঢাকা মহানগর সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান, মহাসচিব এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফরম্নলস্নাহ খান, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির মাওলানা আইনুল হক, মসজিদ মিশনের সেক্রেটারি মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী, বাংলাদেশ আদর্শ শিৰক পরিষদের সেক্রেটারি অধ্যৰ মাওলানা যাইনুল আবেদীন প্রমুখ।
এদিকে গত শুক্রবার বাদ জুমা পৃথক-পৃথক সমাবেশ করেছে ছোট ইসলামী দলগুলো। বিজয় নগর পানির ট্যাঙ্কির মোড়ে সমাবেশ করেছে খেলাফত মজলিশ, পল্টনমোড়ে সমাবেশ করেছে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, গোলাপশাহ মাজার প্রাঙ্গণে খেলাফত আন্দোলন সমাবেশ করেছে। ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভায় দলের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমেদ বলেন, সরকারের দেশ পরিচালনার ধরন, বিচার ব্যবস্থার ধরন ও নির্বাচন কমিশনের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে সরকার, বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশন একই সুতায় গাঁথা। ইসলামী রাজনীতি বন্ধের নূ্যনতম ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না। ইসলামী দলগুলো পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের প্রতিবাদের সঙ্গে ইসলামী দলগুলো এখন শেখ হাসিনার ভারত সফরের বিরম্নদ্ধেও বিষোদগার শুরম্ন করেছে।
গত ১৩ জানুয়ারি ইসলামী দলগুলো মুক্তাঙ্গনে 'সর্বদলীয় সমাবেশ' আয়োজন করে। এতে বক্তৃতা করেন ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করিম, অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন, সৈয়দ বেলায়েত হোসেন প্রমুখ। এই সমাবেশে তারা বলেন, জীবন দিয়ে হলেও ইসলামী রাজনীতি বন্ধের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করা হবে। উলেস্নখ্য, সরকার পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়ের বিরম্নদ্ধে আপীল প্রত্যাহার করে নিলেও বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং জামায়াত সমর্থক তিন আইনজীবী পৃথক দু'টি আপীল (লিভ টু আপীল) করেন। এই আপীলের শুনানি এবং রায়ের পরই '৭২-এর সংবিধান বহাল থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। এছাড়া জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ ও অন্যান্য ইসলামী দলের নেতা মাওলানা ইসহাক, মুফতি ফজলুল হক আমিনী, মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম বিভিন্ন পত্রিকায় পৃথক-পৃথক সাৰাতকারে বলেছেন, 'ঐক্যবদ্ধভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা হবে। ইসলামী রাজনীতি বন্ধ করে দিলে দেশে জঙ্গীবাদের গোপন তৎপরতা বেড়ে যাবে এমন আশঙ্কার কথা বলে জামায়াত পৰানত্মরে সরকারের ওপর পরোৰ চাপ সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন করেছে। সাম্প্রতিক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে জামায়াত নেতা নিজামী বলেছেন,'নিষিদ্ধ কর্মীরাই ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে'। নিজামী প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন 'অর্জনের চেয়ে বিসর্জন বেশি। ভারতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ কাম্য হতে পারে না। জামায়াত চাচ্ছে এখন তালগোল পাকিয়ে পানি ঘোলাটে করতে। এই কারণে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়ের বিরম্নদ্ধে বিগত সরকারের আপীল বর্তমান সরকার প্রত্যাহার করে নেয়ায় বেজায় নাখোশ ইসলামী দলগুলো। গতানুগতিক রীতিতেই এই আন্দোলন জমাতে তারা শেখ হাসিনার ভারত সফরকে আন্দোলন ইসু্যতে সংযুক্ত করার চেষ্টা করছে।

No comments

Powered by Blogger.