অবহেলায় গাজার প্রত্ন-ইতিহাস

অযত্ন-অবহেলার কারণে গাজার হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। যে সামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে, তা-ও এখন হুমকির মুখে।
এসব সম্পদ সংরক্ষণের চেষ্টাও শত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য ফুটে উঠেছে।
ইতিহাসবেত্তা ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, পাঁচ হাজার বছর ধরে সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় স্তরে স্তরে (লেয়ার-আপন-লেয়ার) গড়ে উঠেছে আজকের গাজা উপত্যকা। একেকটি যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই যুগের লোকেরা রেখে গেছে তাদের মসজিদ, গির্জা, মঠ, প্রাসাদসহ মূল্যবান স্থাপত্য। এখনো সেগুলোর যে ধ্বংসাবশেষ আছে, তার সবই বিলীন হওয়ার পথে।
ইসলামপন্থী হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার পর্যটন ও পুরাকীর্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ হায়াম আলবেতার বলেন, ‘গাজার নিচে রয়েছে আরেক গাজানগর। কিন্তু এখানে যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বা স্থানের সন্ধান মেলে, তা কেবলই দুর্ঘটনাবশত।’
হায়াম আলবেতার বলেন, ‘আমরা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সময়কার একটি গির্জা অবিষ্কার করেছি। তবে সালাউদ্দিন সড়ক নির্মাণকালে শ্রমিকেরা যখন খননকাজ করছিলেন, তখন একটি মোজাইক পাথরের ওপর হোঁচট খেয়ে পড়ার পরই এটি পাওয়া যায়।’
গাজার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালানো এবং পুরাকীর্তি সংরক্ষণে সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এই মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি এই মন্ত্রণালয় তার কাজে বিভিন্ন ধরনের বাধার মুখে পড়ছে। গত বছরের নভেম্বরে হামাসের সঙ্গে লড়াইকালে ইসরায়েল বোমা মেরে সরকারি আবু খাদরা কমপ্লেক্স মাটিতে মিশিয়ে দিলে এই মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ও ধ্বংস হয়ে যায়।
মন্ত্রণালয়টির কর্মকর্তারা বলেন, ইসরায়েলি হামলায় অনেক ঐতিহাসিক স্থান গুঁড়িয়ে গেছে। পর্যটন ও পুরাকীর্তিবিষয়ক উপমন্ত্রী আহমেদ আল-বারশ বলেন, ‘গত বছর যুদ্ধে বাইজানটাইন গির্জায় একটি বোমা সরাসরি আঘাত হানে। ধ্বংস হয়ে যায় এর মোজাইকের মেঝে। বোমা বিস্ফোরণে ফাটল ধরেছে মামলুক আল-বাশা প্রাসাদ ও পুরোনো গাজার প্রাচীন দেয়ালগুলোতে।’ তহবিলের ঘাটতির কারণে ওই গির্জার মেরামতকাজ কঠিন হয়ে উঠবে বলেও জানান কর্মকর্তারা।
তহবিলের এ রকম ঘাটতিই শুধু নয়, সমস্যা রয়েছে আরও অনেক। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ইসরায়েল ও এদের মিত্রদের কাছে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে পরিচিত হামাস ওই মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করায় বাইরের সংস্থা কালেভদ্রে ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনার সংস্কারে হাত বাড়ায়। আবার গাজার প্রবেশপথগুলো কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল। তারা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ এখানে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় না।
প্রত্নতত্ত্ববিদ হায়াম আলবেতার বলেন, এই অবস্থার মধ্যেই দুই মাস আগে উত্তর গাজার বেইত লাহিয়া এলাকায় এক অপূর্ব শিল্পকর্মের সন্ধান পাওয়া গেছে। এক ব্যক্তি তাঁর বাড়ির কাছে মাটি খুঁড়তে গিয়ে এর সন্ধান পান। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে কোনো বিশাল স্থাপত্য নিদর্শন লুকিয়ে আছে।
সালিম নামের স্থানীয় একজন ঐতিহাসিক বলেন, গাজার বন্দর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর একটি।
প্রাচ্যে সুগন্ধি, খাদ্যশস্য, কাপড় ও মসলা রপ্তানির দ্বার হিসেবে এটি শত শত বছর ধরে ব্যবহূত হতো। কালের গর্ভে এটি হারিয়ে যায়। তবে রেখে যায় উপকূলীয় প্রত্নতাত্ত্বিক গুপ্তভান্ডার। এক শান্ত দিনে উপকূল থেকে আমরা আবিষ্কার করেছি প্রাচীন মুদ্রা, কাচের জিনিস ও মৃৎপাত্র।
মেইউমাস এ রকমই আরেকটি বন্দর। রোমান আমলের এই বাণিজ্যিক বন্দরে ছিল ১০টি গির্জা। পরে এগুলো বালুতে ঢাকা পড়ে এবং একসময় সাগরে তলিয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব নিদর্শন হারিয়ে যাওয়ার পরও যা রয়ে গেছে, তা সংরক্ষণে নেই যথেষ্ট মনোযোগ। এর পেছনে কারণও আছে। অধিকাংশ গাজাবাসী চরম বেকারত্বে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাদের নেই তেমন থাকার জায়গাও। যা আছে তা হলো—কৃষি, মৎস্য আহরণ ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষার জন্য উপকরণ সংগ্রহের মতো কাজে সীমাহীন বিধিনিষেধ। বিবিসি।

No comments

Powered by Blogger.