তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ও পরিবেশগত প্রবাহ by কাজী গোলাম মোস্তফা

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ১০ জানুয়ারি ভারতে ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে কতিপয় অমীমাংসিত বিষয়ের সন্তোষজনক সমাধানসহ দ্বিপাকি সহযোগিতা বৃদ্ধির ল্যে নবদিগন্ত উন্মোচনে এগিয়ে যেতে এ সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অমীমাংসিত বিষয়ের মধ্যে ছিল দুই দেশের ছিটমহল ও অপদখলকৃত জমি হস্তান্তর, সীমান্তের বিতর্কিত প্রায় ৬ কিলোমিটার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, তিন বিঘা করিডর, টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ও সমুদ্রসীমা নির্ণয়। দ্বিপাকি সহযোগিতার বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ, গ্রিডে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করে ভারত এবং ভুটান থেকে বিদু্যৎ আমদানির ব্যবস্থা করা, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের বিনিময়, ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের রেলওয়ের আধুনিকায়ন, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, সীমান্ত বাণিজ্য চালু করা এবং ভারতের প েথাকা বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। আসলে এক সফরে পুরনো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বা সহযোগিতার জোয়ার সৃষ্টি হবে এমনটি কেউ আশা করে না। গুরুত্বের বিবেচনায় সমস্যা কোনটাই খাটো নয়, তবু এরই মাঝে ক্রমবিন্যাস করলে প্রথমেই আসে বিদু্যত আমদানি, তার পরে স্থান দিতে হয় তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি দীর্ঘদিনের পুরনো সমস্যা, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এক বৃহৎ জনপদের বুকভাঙ্গা আকুতি, আরও মিশে আছে একটি নদীর করুণ আর্তনাদ। বর্ষার খরস্রোতা তিস্তা, শুকনো মৌসুম এলে একেবারে নেতিয়ে পড়ে, তখন দেখলে মনে হয় কেউ যেন এর টুঁটি চেপে ধরেছে। প্রতিবছর জানুয়ারি হতে দীর্ঘ চারটি মাস বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজের ভাঁটিতে নদীতে কোন প্রবাহ থাকে না, তখন নদীর সঙ্গে এর দুই পাড়ের জনপদকেও পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। পানি বণ্টনের আলোচনা তো কম হলো না, পাকিস্তান আমল হতেই চলছে এই আলোচনা, এরপর বাংলাদেশ হলো। ১৯৫৫ হতে ২০০৯ পর্যস্ত ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও কোন সমাধানে পেঁৗছাতে পারেনি দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা। এরই মাঝে গাজলডোবায় নির্মিত হয়েছে ভারতীয় তিস্তা ব্যারাজ আর দোয়ানীতে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ। শুকনো মৌসুমে দুই দেশের প্রকল্প এলাকার চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পানি নেই নদীতে, এটি এখন স্বীকৃত সত্য। তিস্তার পানি বণ্টন আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে কয়েকটি কথা : ক) তিস্তা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে দুই দেশের পানির লব্ধতা খ) প্রকল্প এলাকায় দুই দেশের পানির চাহিদা ৩) এগুলো নির্ধারণ করতে যৌথ বৈজ্ঞানিক সমীা ৪) সমীা দীর্ঘমেয়াদি, তাই এ সময়কালে পানি বণ্টন করতে প্রয়োজন এ্যাডহক বা অন্তর্বতর্ীকালীন চুক্তি এবং ৫) চুক্তি করলে ভাগাভাগি হবে কোন ফর্মুলায়। সমস্ত আলোচনা এই গোলক ধাঁধার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই, কালপেণ করা; আর যদ্দিন পারা যায় সমস্যার সমাধান না করে একে জিইয়ে রাখা।
বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হয়েছে হরেক রকম ভাগাভাগির ফর্মুলা নিয়ে। একবার উভয় প সম্মত হয়েছিল একটি এ্যাডহক বণ্টন ফর্মুলায়, কিন্তু ওটাও হারিয়ে গেছে ওই চক্রাবর্তের ঘূর্ণিপাকে। বণ্টনের সম্মত ফর্মুলায় ছিল বাংলাদেশ পাবে ৩৬ শতাংশ, ভারত ৩৯ শতাংশ এবং অনির্ধারিত থোক হিসেবে থাকবে ২৫ শতাংশ। শর্ত ছিল অনির্ধারিত থোক ২৫ শতাংশ বৈজ্ঞানিক সমীার পর পুনর্নির্ধারণ করা হবে। তবে ধন্যবাদ দিতে হয় উভয় পকে একটি কারণে, তিস্তা নদীর বণ্টন আলোচনাতে স্বীকৃতি পেয়েছে নদীর হিস্যার বিষয়টি। নদীকে বহমান বা বাঁচিয়ে রাখতে একে দিতে হয় এন্ভায়রনমেন্টাল ফো বা পরিবেশগত প্রবাহের হিস্যা। পরিবেশগত প্রবাহের ধারণা মেনে নিলেও পর্যাপ্ত পানি না থাকায় বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় নদীর জন্য উল্লেখযোগ্য হিস্যার অনুপাত উচ্চারিত হয়নি কখনও। নদীর হিস্যা ১০ বা ১৫ শতাংশ, কখনও ২০ শতাংশ রাখার কথা হয়েছে। তিস্তা নদীকে অবলম্বন করে উত্তরবঙ্গে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জনপদ, হাট, বন্দর, কৃষ্টি ও সভ্যতা। নদীরও আছে জীবন, নদী বহমান থাকলে এর উপকারের ভাগ মানুষেই বেশি পায়। নদীখাত ঠিক রাখতে, নৌচলাচলে, মাছের বৃদ্ধিতে, গৃহস্থালি কাজে, শিল্পে এবং সবের্াপরি পরিবেশের ভারসাম্য রায় এন্ভায়রন্মেন্টাল ফো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। অথচ নদীর প্রবাহের বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে উভয় দেশের কাছে নিজস্ব প্রকল্প এলাকায় সেচ দেয়াটা হয়ে উঠে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। নদীর শেষ ফোঁটা পানিটুকু শুষে নিয়ে জমিতে সেচ দিতেই দু' দেশের মানুষের প্রাণান্তকর প্রতিদ্বন্দি্বতা।
বিভিন্ন সময়ে আলোচনার ধারাবাহিকতা দেখে চোখ বুজে বলা যায়, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলোচনায় কখনও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ফর্মুলার চূড়ান্ত নি্#৬৩৭৪৩;ত্তি হবে না। কারিগরি পর্যায়ে আলোচনার কথা উঠলেই কেমন সঙ্কিত হয়ে পড়ি, আবার না কালপেণের ফাঁদে সব কিছু আটকে যায়। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে গত আট বছরের মধ্যে এখনই সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক বিরাজমান। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি যেমনিভাবে শীর্ষ পর্যায়ে স্বল্পতম সময়ে চূড়ান্ত হয়েছিল তিস্তা নদীর বণ্টন চুক্তিও অনুরূপভাবে সম্পাদন করা উচিত। কোন এ্যাড্হক বা অন্তর্বতীকালর্ীন চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের কাম্য নয়, মানুষ চায় দীর্ঘমেয়াদি পানি বণ্টন চুক্তি। প্রকল্প এলাকায় কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য কোন্ দেশ কত হারে পানি পেল তার গুরুত্ব থাকলেও নদীর এন্ভায়রন্মেন্টাল ফো বা পরিবেশগত প্রবাহের হিস্যা আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ফর্মুলা অনুসরণে ব্যবহারের উদ্দেশ্যভেদে নদীর পরিবেশগত প্রবাহের পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে এর পরিমাণ যত বেশি থাকবে তা মানুষের জন্য হবে অধিক কল্যাণকর। একসময়ে তিস্তার পানি বণ্টনের সম্মত ফর্মুলায় অনির্ধারিত থোক ২৫ শতাংশ রাখার কথা হয়েছিল, নদীর এন্ভায়রনমেন্টাল ফো বা পরিবেশগত প্রবাহের হিস্যা হিসেবে তা বহাল রাখলেই নদীর প্রতি যথার্থ সুবিচার করা হবে। এই পানি সেচের নিমিত্ত যাতে কোন দেশ প্রত্যাহার করতে না পারে চুক্তিতে এই মর্মে সুনির্দিষ্ট ধারা সনি্নবেশিত করা প্রয়োজন। আশার কথা প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে ভারত বাংলাদেশ যৌথ ঘোষণায় অনেক অমীমাংসিত সমস্যা নি্#৬৩৭৪৩;ত্তির পর্যায়ে পেঁৗছেছে। যে কয়েকটি চুক্তি হয়েছে তাও দুই দেশের জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এই সফরে তিস্তা ব্যারেজের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। এই কাক্মিখত চুক্তি ত্বরান্বিত করতে দু'দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজ নিজ পানিসম্পদ মন্ত্রীদের কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে পেঁৗছার ব্যাপারে দু'দেশ ঐকমত্যে পেঁৗছাবে বলেও জানা গেছে। আমাদের প্রত্যাশা যত দ্রুত সম্ভব তিস্তা পানি বন্টন চুক্তির পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হোক।
লেখক : পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) সাবেক মহাপরিচালক ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক।
পথবলর্্রমতটআথবটধফ.ডমব

No comments

Powered by Blogger.