মহুয়াকে ধর্ষণের পেছনেও একটি মোবাইল ফোন! by জেসমিন পাঁপড়ি ও সুলতানা ইয়াসমিন মিলি

‘শবে কদরের রাত। বাড়ির পুরুষরা সবাই মসজিদে। আমিও নামাজের জন্য ওজু করতে যাই। যাওয়ার আগে দেখি খাটে শুয়ে কাকার মোবাইলে সাপের খেলা খেলছে মহুয়া। সাপ আসে আর পুট করে শব্দ হয়। ওর পাশেই বসা ছিল শাহেদুল।
বাড়ির সবাই নামাজে গেছে বলেই তাকে ডেকে আনা হয়। ছোট্ট মহুয়ার পাশে ওকে রেখে আমি ওজু করতে যাই। তখনও বুঝতে পারিনি ওর মনের শয়তানি।’
এভাবেই ২০০৮ সালের রমজান মাসের কদর রাতের বর্ণনা দিচ্ছিলেন মহুয়ার দাদী আমিনা বেগম। মহুয়া(৮) তার আদুরে নাতনি। চার ছেলের ঘরের একমাত্র নাতনি সে। তৃতীয় শ্রেনীতে পড়া মহুয়া ছিল সকলের চোখের মনি। যার চোখে ছিল নতুন জীবনের স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্ন গড়তে দেয়নি এক নরপশু ধর্ষক। তাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে সে।

২০০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের এ ঘটনার পরদিন সিরাজগঞ্জ সদর থানায় মহুয়ার মা জেবুন্নেছা বেগম ধর্ষণ ও খুনের মামলা দায়ের করেন। প্রায় চার বছর ধরে চলা বিচারে এই আসামিকে এ বছরের ২ জানুয়ারি ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন সিরাজগঞ্জ জেলা জজ আদালতের বিচারক।

ঘটনার দিনের কথা স্মরণ করে আমিনা বেগম বলেন, ‘বৃষ্টির রাত ছিল। ওজু করতে গিয়ে কাপড় ভিজে যায় আমার। শাড়ি পাল্টে ঘরে এসে দেখি মহুয়া নেই। শাহেদুলও নেই। বুকটা কেঁপে ওঠে আমার। কুপি নিয়ে আশে পাশের সব বাড়িতে খোঁজ করি। কেউ বলতে পারে না কোথায় গেছে মহুয়া।

এর মাঝে মহুয়ার এক চাচি জানায় মহুয়া শাহেদুলের সঙ্গে গেছে। শাহেদুলের বাড়িতে খুঁজে আসা হয়। কিন্তু কোথাও তাদের খোঁজ মেলে না। ততক্ষণে নামাজের মানুষ ফিরে আসে। তারাও মহুয়াকে খোঁজা শুরু করেছে।

অবশেষে ঘরের পিছে মহুয়ার পায়ের স্যান্ডেল পাওয়া যায়। আরো সামনে এগিয়ে ধানক্ষেতের মধ্যে পানিতে পাওয়া যায় মহুয়াকে। মাথাটা আইলের ওপর। বাকি শরীর পানিতে। বিবস্ত্র অবস্থায় ছোট্ট মহুয়াকে কোলে তুলে নেয় তার চাচা মাসুদ খান। বিকলাঙ্গ মাসুদ খানের বুক থেকে মহুয়াকে তুলে নেয় আরেক চাচা অপু খান।

এর পরের ঘটনা জানান অপু নিজেই। ‘তাকে ধরেই ভাবি একি! এ মহুয়ার দেহ যে নিথর!
কোলে নিয়ে দৌড়ে উঠানে আসি। বিভিন্ন চেষ্টা করে বুঝতে পারি আমাদের ছোট্ট পরীটা আর নেই। ওর শরীরের নিম্নাংশ দিয়ে তখনও রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।’

এরপরই গ্রামবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছুটে যায় শাহেদুলের বাড়ি। শহিদুল তখন কাদা পায়েই বিছানায় শুয়ে ছিল। সেখান থেকে মোবাইলসহ তাকে ধরে এনে আটকে রেখে পরে পুলিশের কাছে তুলে দেয়া হয়।

মোবইল ফোনই কাল হল:
মহুয়ার হাতে থাকা মোবাইল সেটটি ছিল তার চাচা মাসুদ খানের। নামাজে যাওয়ার আগে মহুয়া খেলার জন্য সেটি তার থেকে চেয়ে নেয়। আর এ মোবাইল ফোনটার লোভেই শাহেদুল নিষ্পাপ এ শিশুটির প্রতি এমন অন্যায় করে বলে জানান এলাকাবাসী।

মহুয়ার পরিবারের সদস্যরাও জানান একই কথা। মাসুদ খান বলেন, মহুয়ার হাতে থাকা মোবাইলের লোভে হয়ত শাহেদুল ওর সঙ্গে এমন আচরণ করেছে। এর আগেও সে গ্রামের অন্যদের মোবাইল চুরি করে ধরা পড়ে। সেটি নিয়ে সালিশও হয়। মহুয়ার পরিবারই তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে।

নতুন জামা পরা হয়নি মহুয়ার:
ক’দিন পরই ঈদ। তাই মায়ের কাছে মহুয়ার বায়না ছিল এবার ঈদে নতুন স্কুল ড্রেস দিতে হবে।যাতে ছুটির পর স্কুল খুললেই নতুন স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে যাওয়া যায়।মসলার কারখানায় কাজ করা মা তার মেয়ের সে আব্দার পূরণ করে কাপড়ও কিনে দিয়েছিলেন। হয়ত পরদিনই দাদির হাত ধরে দর্জিবাড়ি যেত মহুয়া।
কিন্তু সে কাপড় এখন শুধুই মহুয়ার স্মৃতি। তারই স্কুল ব্যাগে রাখা বইগুলোর সঙ্গে অতি যতনে আগলে রেখেছেন মা জেবুন্নেছা।


রায়ে খুশি মহুয়া পরিবার, চায় কার্যকর হোক:
মহুয়ার মা জেবুন্নেসা বাংলানিউজকে বলেন ‘মহুয়াকে হারিয়ে তার বাবা পাগলপ্রায়। আমাদের পরিবারটা তছনছ হয়ে গেছে। আসামির বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়েছে শুনেছি। এতে আমার মেয়ে ফিরে আসবে না সত্যি, তবে আমার মেয়ের জীবন শেষ করেছে যে শয়তান, তারও এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। এজন্য রায় শুনে আমি, আমরা সবাই খুশি। যা আশা করেছিলাম তা-ই হইছে। এখন শুধু চাই রায়টা কার্যকর হোক। তাহলে এই গ্রাম শুধু নয়, সারা বাংলাদেশে কোনো পিশাচ কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পাবে না।’

মহুয়ার চাচা মাসুদ খান বলেন,  ‘আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দীর্ঘ বিচারের পর একটা রায় হয়েছে। আমরা মনে করি যোগ্য রায় হয়েছে। আমরা আশা করব আপিল বিভাগেও এই রায় বহাল থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকতাম তাহলে ঘটনার দিনই উত্তেজিত গ্রামবাসীর হাতে শাহেদুলকে তুলে দিতাম। তখন সে আর হয়ত প্রাণে বাঁচত না। কিন্তু আমরা তা না করে তাকে আটকে রেখে পরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।’

এখনো পুরো গ্রাম মহুয়ার শোকে কাতর:
ছোট্ট মহুয়ার হাতে থাকা মোবাইল নিতে তাকে ধানক্ষেতে নিয়ে প্রথমে ধর্ষণ, পরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে একই গ্রামের শাহেদুল। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই মোবাইলসহ নিজ ঘর থেকেই আটক হয় সে। এর পরেই উত্তাল হয় পুরো গ্রাম। শাহিদুলের ওপর চলে গণপিটুনি। কিন্তু এলাকার অনেকের সাহায্যে তাকে কোনো রকমে মুক্ত করে আটক রাখা হয় আলম নামে অন্য এক প্রতিবেশীর ঘরে। সেখানে বসেই শাহিদুল মহুয়াকে হত্যার কথা স্বীকার করে বলে জানান একাধিক গ্রামবাসী। তবে শাহিদুলের পরিবারের অভিযোগ তাকে মেরে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। এরপর প্রায় আধমরা অবস্থায় তাকে পুলিশের কাছে দেয়া হয়।

গ্রামবাসীর তোপের মুখে এক পর্যায়ে শাহিদুলের পরিবার বেশ কিছুদিন নিজেদের বাড়িতে উঠতে পারে নি। ফলে বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়াতে হয় পুরো পরিবারকে।

মহুয়ার শেষ দেখা হযনি মা-বাবার সঙ্গে:
মহুয়ার বাবা মানসিকভাবে কিছুটা অসংলগ্ন। তাই সংসারের চাপ সামলাতে হত মা জেবুন্নেছাকে। মসলার কারখানায় কাজ করেই চলত সংসার। কাজের সুবিধার জন্য কারখানার পাশেই একটা বাসা ভাড়া করে থাকত মহুয়ার বাবা-মা।

সেখানে মায়ের কাছে থাকলেও ঈদ উপলক্ষে নতুন জামা বানানোর জন্য আগেই দাদির কাছে চলে আসে মহুয়া। বাবা-মাকে আসতে বলে তাড়াতাড়ি। মায়ের আশা ছিল ঈদের বাকি কেনাকাটা করেই ফিরবে তারা। কিন্তু সে সুযোগ দেয়নি মহুয়ার ঘাতক।

শাহেদুল বৃত্তান্ত:
মহুয়া হত্যাকারী এই শাহেদুল একই গ্রামের কৃষক মঙ্গলার ছেলে। ছোটবেলা থেকে স্কুলের পথে হাঁটে নি কখনো। তাঁত বোনা আর অন্যের বাড়িতে ফুট-ফরমায়েস খাটাই ছিল তার পেশা। সে-সূত্রে মহুয়াদের বাড়িসহ আশপাশের প্রায় সব বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল তার। মহুয়ার চাচা অপু খানের সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল।

পড়ালেখা না শিখলেও মোবাইল ফোনের জন্য মরিয়া ছিল শাহেদুল। পাশের গ্রামের একজনের মোবাইল চুরি করে ধরাও পড়ে সে। তবে স্বভাবে বখাটে শাহেদুলের বন্ধু ছিল কম। গ্রামে কাজ না পেলে সিরাজগঞ্জ শহরে গিয়ে সারা দিন সে অন্যের তাঁতে কাজ করত। বিকেল হলে ফিরে আসত গ্রামে। অনেক গ্রামবাসী জানান মাদকেও আসক্তি ছিলো শাহেদুলের। তবে তার পরিবার সেকথা অস্বীকার করে। তদের দাবি, এ হত্যাকাণ্ডসহ সবই শাহেদুলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।

তবে এ গ্রামের ডুমুর-গোলামী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবু ছিদ্দিক খান(এই বিদ্যালয়ে ৪০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন) বলেন, ‘এই ছেলেটার স্বভাবচরিত্র আগে থেকেই ভালো ছিল না। অশিক্ষিত বখে যাওয়া ছেলে সে।’

পাশ্ববর্তী ডুমুর-মুছা গ্রামের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, মহুয়াদের পাশের বাড়ির একটি কাজের মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল শাহেদুল। কিন্তু সেই মেয়ের বাবা রাজি না হওয়ায় ক্ষেপে যায় সে। এর পেছনে মহুয়ার চাচাদের হাত আছে বলে সে মনে করত। সাথীর অন্য খানে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় খানিকটা প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই হয়ত সে এ কাজ করে থাকতে পারে।

এছাড়া অন্য এক নারী সম্পর্কিত ঘটনায় শাহিদুল একবার তার ফুফুর বাড়িতে বিষ খেয়েছিল বলেও জানা যায়।

No comments

Powered by Blogger.