অগ্নিকা-ে গার্মেন্টস শিল্পের উন্নয়ন হুমকির মুখে- সিপিডির সংলাপে অভিমত

 ২০০৭ সাল থেকে দেশের ১৩শ’ গার্মেন্টস্ কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৩শ’র বেশি শ্রমিক মারা গেছেন। এই সময়ে আহত হয়েছেন প্রায় ১২শ’ শ্রমিক। শুক্রবারও রাজধানীর একটি গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৬ নারী শ্রমিক মারা গেছেন।
এসব অগ্নিকা-ের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও চূড়ান্ত রিপোর্ট আসে না কখনও। শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বার বার জোরালোভাবে দাবি করা হলেও তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে পারছে না গার্মেন্টস মালিকপক্ষ। কোন দুর্ঘটনার দায়ভার গার্মেন্টস মালিক নেন না। শর্ট সার্কিটে অগিকা- ঘটে, শ্রমিক মারা গেলেও কখনও মালিক পক্ষের কেউ হত হন না। ধারাবাহিক এসব অগ্নিকা-ের ফলে দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। এসব কারণে জিএসপি সুবিধা বাতিলসহ নানাবিধ সঙ্কটের কারণে ৪০ লাখ শ্রমিককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়ন এখন হুমকির মুখে।
শুক্রবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিকের নিরাপত্তা : তাৎপর্য ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইসরাফিল আলম এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার, সংসদ সদস্য শহিদুল্লাহ সরকার, বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান, বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী, শ্রমিক নেতা সাইফুল হক প্রমুখ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম।
মূল প্রবন্ধে ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০১২ সালে দেশের ২২৮টি ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ১২২ জন পোশাক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এর আগের বছর ২৩৪টি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৮৭ জন শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন। তথ্য মতে, ২০০৭ সাল থেকে ১৩শ’ গার্মেন্টনস কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৩শ’র বেশি শ্রমিক মারা গেছেন। এই সময়ে আহত হয়েছেন প্রায় ১২শ’ শ্রমিক। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত তাজরিন গার্মেন্টসে অগ্নিকা-ের ঘটনার পর সিপিডি একটি পরিদর্শক দল কারখানা পরিদর্শন করেছে। তারা দেখেছে, ওই ফ্যাক্টরিতে বহিগর্মন সিঁড়ি ছিল না। তিনটি সিঁড়ি থাকলেও দুটি ছিল তালাবদ্ধ অবস্থায়। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থাও ছিল অপ্রতুল। কলাপসবিল গেট ছিল তালাবদ্ধ। এছাড়া অগ্নিকা-ে এ্যালার্ম বাজার পরও শ্রমিকদের বের হতে দেয়া হয়নি। এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে ওই গার্মেন্টসের মালিকের দায়িত্বহীনতার কারণে এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। তিনি তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, তাজরিন ফ্যাশনস্ কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় বিজিএমইএ একটি তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে। তদন্ত কমিটির ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই ঘটনার পেছনে ‘নাশকতা’ ও ব্যবস্থাপকের দুর্বলতা ছিল। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ঘটনার পর বলেছে, তাজরিন ফ্যাশনসের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। আবার কমপ্লায়েন্স টিম বলেছে, তাজরিন ফ্যাশনসের কমপ্লায়েন্স মনিটরিংয়ের দায়িত্বে আমরা ছিলাম না।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত ৫ বছরে উন্নয়ন বাজেটে গার্মেন্টস শ্রমিক/শ্রমিকদের জন্য সরাসরি কোন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কমপ্লায়েন্স প্রসঙ্গে প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, পোশাক শিল্পের উন্নয়নের এই সময়ে কমপ্লায়েন্স বৃদ্ধি পেলেও তার সরকার নির্ধারিত আইনী বাধ্যবাধকতা মানার জন্য যথেষ্ট নয়। তাজরিন গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ক্রেতা ও তৃতীয় পক্ষীয় কমপ্লায়েন্স টিম দায়ভার নিতে চাচ্ছে না। মূল প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন, বর্তমান অপ্রশস্ত জায়গার কারণে কারখানাগুলো উল্লম্বভাবে বাড়ছে। ৭-১০ তলা পর্যন্ত কারখানা তৈরি করা হচ্ছে। ফলে অগ্নিকা-জনিত ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ছে। তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান কারখানাগুলোতে তুলা জাতীয় পণ্য ও কেমিক্যালের ব্যবহার বিষয়টি মাথায় রেখে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। পাশাপাশি শ্রমিকদের সামাজিক কমপ্লায়েন্সের জন্য তেমন বিনিয়োগ হয়নি। এছাড়া কারখানা পরিদর্শনের পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ ও কর্তৃপক্ষ আইনগতভাবে দুর্বল থাকায় নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানা বছরের পর বছর কাজ চালিয়ে যাবার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে বলে তিনি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন।
বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, শ্রমিক নেতারা প্রতিপক্ষ নন, তবে এ ক্ষেত্রে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তিনি বলেন, যারা দোষী তাদের লাইসেন্স বাতিল করবে বিজিএমইএ। তাজরিন ফ্যাশনসের ঘটনায় নিহত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যাঁরা আর্থিক সুবিধা পাননি তাদের আগামী ফেব্রুয়ারিতে আর্থিক সুবিধা দেয়া হবে। কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা বলতে পারব না গার্মেন্টস কারখানার অগ্নিকা-ের ঘটনায় কোনভাবে ুদায় এড়ানো যাবে। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য কিছুটা সীমবাদ্ধতা রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, বিজিএমইএ সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এসব অগ্নিকা-ের ঘটনা যাতে পুনরায় না ঘটে।
বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান তাঁর বক্তব্যে বলেন, তাজরিন গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় এবারই প্রথম বিজিএমই নেতারা প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি এ খাতের জন্য ইতিবাচক। তবে তিনি এ ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্টের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, তদন্তের আগেই সরকার বলছে, এ ঘটনায় নাশকতা রয়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকার কিভাবে বুঝল এ ঘটনা নাশকতা না ষড়যন্ত্র? তাজরিন গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকা-ের বিষয়ে তিনি বলেন, ৫৭ জন শ্রমিকের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। তাহলে কি এই গার্মেন্টসে বহিরাগত লোক কাজ করেছেÑ এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। জিএসপি সুবিধা বাতিল প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পে এ সুবিধা বন্ধ হলে শত শত গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের ৩৩ জন সংসদ সদস্য তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এ শিল্পের উন্নয়নে তাঁদের ভূমিকা নেই। তার বিপরীতে ৪ জন সাংসদ শ্রমিক নেতা হলেও তাঁরাও কথা বলতে পারেন না শ্রমিকদের স্বার্থে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইসরাফিল আলম এমপি বলেন, তাজরিন গার্মেন্টস কারখানার দুর্ঘটনা জাতির জন্য ব্যর্থতা। যখন গার্মেন্টস কারখানায় কমপ্লায়েন্সের কথা বলা হচ্ছে সেই সময়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেরিবাঁধ এলাকায় একটি গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৬ নারী শ্রমিক মারা গেছেন। যা খুবই দুঃজনক ও কষ্টদায়ক।

No comments

Powered by Blogger.