‘তিনটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে দক্ষ ও পেশাদার লোকের হাতে’- মুন্সীগঞ্জে তিন লাশ

 ঢাকায় নিখোঁজ হওয়া তিন ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরসহ পৃথক হত্যা মামলা হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার উদ্ধার হওয়া এই লাশের কোন কূলকিনারা তিন দিনেও করতে পারেনি পুলিশ।
হত্যার ক্লু বের করতে তদন্ত চলছে উল্লেখ করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হেসেন মজুমদার জানান, তিনটি হত্যার যোগসূত্র থাকলেও আসামি অজ্ঞাত, তাই পুলিশ নানাভাবে হত্যার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ঘন ঘন লাশ উদ্ধার হচ্ছে, মামলাও হচ্ছে। কিন্তু হত্যার কোন ক্লু বের করতে পারছে না পুলিশ। তাই অপরাধীরা ডাম্পিং গ্রাউ- হিসাবে বেছে নিয়েছে মুন্সীগঞ্জকে। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ৩৪ লাশ উদ্ধার হয়েছে। তবে এই সংখ্যা বেসরকারীভাবে আরও বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সব নিারাপত্তা ভেদ করেই অনবরত এভাবে লাশ ফেলে যাচ্ছে অপরাধীরা। এ বিষয়টি সর্বশেষ গত ২১ জানুয়ারি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে নবনিযুক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল হাসান বাদল জানান, নৌপথ ও মহাসড়কে টহলরত পুলিশকে আরও সতর্ক থাকাসহ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়গুলো অতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এর কারণ খতিয়ে বের করার জন্যও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সিরাজদিখানের রশুনিয়ার রাস্তার পশ্চিম ঢাল থেকে প্রথম উদ্ধার হওয়া নিহত ইব্রাহিমের পিতা খোরশেদ আলম বাদী হয়ে সিরাজদিখান থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১৫। এর কিছু পরে এর উত্তরে রাস্তার পূর্বপাশের ঢাল বাসাইল থেকে উদ্ধার হওয়া আব্দুল কুদ্দসের হত্যার ঘটনায় বাদী হয়েছেন থানাটির এসআই আব্দুস সালাম। মামলা নং ১৬। এদিকে একইভাবে চোখ এবং পেছন থেকে গামছা দিয়ে হাত বাঁধা মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শ্রীনগরের শ্রীধামপুর রাস্তার ঢাল থেকে উদ্ধার হওয়া রাঢ়ী মাসুদ হত্যার ঘটনায় বাদী হয়েছেন থানাটির এসআই আবু হানিফ। মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার দুপুর আড়াইটায় আবুল কালাম রাঢ়ী মাসুদের লাশ গ্রহণ করেন। লাশটির ময়নাতদন্তকারী ডা. শেখ কামরুল করিম জানান, তার মাথার পেছনে নিচে দুটি এবং বাঁ পাঁজরের পেছনের দিকে একটি মোট ৩টি বুলেট বিদ্ধ হয়। কিন্তু দেহের ভেতরে কোন বুলেট পাওয়া যায়নি, এক্স-রে করেও বুলেট দেখা যায়নি। আরেকদিক দিয়ে বুলেট বের হয়ে গেছে। তিনি বলেন, দেখেই বোঝ যায়, পেশাদার লোক হত্যার জন্যই গুলিগুলো কাছ থেকে ছুড়েছে। এর আগে ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার রাতে ইব্রাহিম ও আব্দুল কুদ্দুসের লাশ গ্রহণ করেছেন স্বজনরা। এই দু’টি লাশের ময়নাতদন্তকারী ডা. এহসানুল করিমও একই মন্তব্য করেছেন- পেশদার লোকই গুলি ছুড়েছে। যেখানে গুলি লাগলে মারা যাবে সেখানেই গুলি করা হয়েছে। এই দু’জনেরও গুলিবিদ্ধ হয়েছে মাথার পেছেনে ও কপালের মধ্যে বাঁ চোখের ভ্রূর ওপর দিয়ে। প্রতেকের মাথায় ৩টি করে গুলিবিদ্ধ হলেও শুধু আব্দুল কুদ্দুসের বুকের বাম দিকে একটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর দেহে গুলিবিদ্ধ হয় চারটি। এসব তথ্য দিয়ে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. এহসানুল করিম বলেন, ৩টি হত্যাকা- একই রকম বলে মনে হয়েছে। দক্ষ লোক দ্বারাই হত্যাকা- ৩টি সংঘটিত হয়েছে। এদিকে নিহতদের পরিবারগুলোর মধ্যে চলছে শোকের মাতম। শোকাহত স্বজনদের সন্দেহের তীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে।
নিহত ইব্রাহিমের (২০) মামা নাসির মিয়া জানান, আমার ভাগ্নেকে এখন বলা হচ্ছে হত্যা মামলার আসামি এটা আমরা বিশ্বাস করি না। মামলা তো দূরের কথা কখনও ওর বিরুদ্ধে থানায় একটি জিডি পর্যন্ত নেই। আমরা এই হত্যার বিচার চাই। ইব্রাহিমের মা নাজমা আক্তার পুত্র শোকে এখন পাথর।
এদিকে কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা গ্রামের রাঢ়ী মাসুদের (৩২) বিরুদ্ধে নানা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগ থাকলেও একই এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সূত্রটির দাবি রাঢ়ী মাসুদ নানা কারণেই এক চলাচল করতো না। হয়ত রাস্তায় দেখা হয়ে যাওয়ার কারণে একই এলাকার পরিচিত হওয়ার সুযোগে রাঢ়ী মাসুদ কুদ্দুসকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কারণেই কুদ্দুসও গুপ্ত হত্যার শিকার হয়। তাই কেরানীগঞ্জের আমবাগিচার পানাকা মার্কেটের মিনি গার্মেন্টসের মালিক আব্দুল কুদ্দুস (৪২) তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার স্ত্রী সোহাদা বেগম এখন বুকফাটা আর্তনাদ করছেন আর বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন।
রশুনিয়া ও বাসাইল এই দুটি এলাকায়ই নির্জন প্রায় আধা থেকে পৌনে এক কিলোমিটারের মধ্যে কোন বসতি নেই। আশপাশের এলাকা চরবিশ্বনাথের মোক্তার হোসেন, ব্রজেরহাটি গ্রামের এইচএম তাজুল ইসলাম, পূর্ব রশুনিয়া আব্দুল মতিন ও রশুনিয়া গ্রামের মোঃ রুবেলের সঙ্গে কথা হয়। প্রত্যেকেই জানান, এলাকাটি নির্জন বলেই সুযোগ নিয়েছে অপরাধীরা। এখানে নিয়মিত পুলিশ টহলও নেই। এই এলাকাটি ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের নিমতলী থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে। এই মহাসড়কের শ্রীনগর উপজেলার হাসড়া থেকে একই দূরত্বে হাসাড়া-বাড়ৈখালী সড়কের শ্রীধামপুর। এখানেও নেই জনবসতি। শ্রীধামপুর গ্রামের ইলিয়াস মেম্বার জানান, নির্জনতার সুযোগ নিয়েছে অপরাধীরা। তিনটি স্থানেই সামান্য রক্তের দাগ রয়েছে। তা দেখে মনে হয় অল্প সময় আগে অন্যত্র হত্যা করে লাশ এখানে ফেলে যায়। ঘটনাস্থলে হত্যা করা হলে গুলি শব্দ ও প্রচুর রক্ত দেখা যেত।
পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দু’টি হাইওয়ে ও নদীপথবেষ্টিত বলেই লাশ ডাম্পিংয়ে সুবিধা পাচ্ছে। এছাড়া গভীর রাতে নয়, লাশগুলো ফেলা হচ্ছে ভোরে। আজানের আগে। সোয়া ৪টা থেকে পৌনে ৫টার মধ্যে। কারণ মফস্বলের পুলিশ নাইট ডিউটি শেষে ক্লোজ হতে থাকে সোয়া ৪টা থেকে।

No comments

Powered by Blogger.