পার্বত্য অঞ্চলে মাশরুম চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা- শ্রাবণী দে এবং ড. রবীন্দ্রনাথ শীল

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা তিনটি নিয়ে পার্বত্য অঞ্চল গঠিত। এই অঞ্চলের আয়তন দেশের প্রায় এক-দশমাংশ।
ছোট-বড় পাহাড় ও টিলা সংবলিত ভৌগোলিক অবস্থান, ভূমির প্রকৃতি, লোকসংখ্যা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কৃষিসহ সব কিছুই বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে ভিন্নতর। বহুদিন আগ থেকে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, পাংখোয়া, তঞ্চঙ্গ্যাসহ ১১টি ছোট-বড় নৃগোষ্ঠী। এসব আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন ধারণের প্রধান অবলম্বন হচ্ছে জুম চাষ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত বণাঞ্চল ঘোষণা, দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে অভিবাসী স্থানান্তরের ফলে ক্রমেই জুম চাষের এলাকা সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। এছাড়া জমির উর্বরতা হ্রাস, ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি তথা ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ার কারণে এ অঞ্চলের জনগণ চরম দারিদ্র্যতা, খাদ্যাভাব, অপুষ্টিজনিত রোগ, বেকারত্ব, কর্মহীনতার শিকার; এক কথায় এ অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো চরম আর্থ-সামাজিক দুরবস্থায় ভুগছে। এ কারণে ‘মাশরুম চাষ’ এই জেলায় বিশেষ করে আদিবাসী জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নযন, পুষ্টি সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সম্ভাবনাময় দিক।
মাশরুম একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ওষুধিগুণসম্পন্ন সবজি; যার মধ্যে ২৫-৩০% আমিষ, ৫৭-৬০% ভিটামিন ও মিনারেল, ৫-৬% চর্বি, ৪-৬% শর্করা বিদ্যমান। মাশরুমে অবস্থিত আমিষ, ভিটামিন ও মিনারেলস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, মাশরুমে শর্করা ও চর্বি কম থাকায় এবং ভক্ষণযোগ্য আঁশ বেশি থাকায় বয়স্ক লোকসহ সব শ্রেণীর মানুষের এমনকি ডায়াবেটিক রোগীদেরও আদর্শ খাবার হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। মাশরুমে রয়েছে ইরিটাডেনিন, লোভাস্টটিন ও এন্টাডেনিন; যা মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল কমানোর অন্যতম উপকরণ। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন-ডি; যা শিুশুদের শরীর তথা অস্থি ও দাঁত গঠনে ভূমিকা রাখে। এটা লৌহ, ফলিক এসিড রক্তশূন্যতার মহৌষধ।
মাশরুম সাধারণত ভেজা ও স্যাঁতসেতে জায়গায় জন্মে। প্রত্যেকটি মাশরুমের ফ্রুটিংবডি গজানোর জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় আপেক্ষিক আর্দ্রতার অধিক প্রয়োজন হয়। পার্বত্য অঞ্চলে গাছপালা, বাঁশ, ছন প্রভৃতির আধিক্য থাকায় এই অঞ্চলের মাটি বেশি পরিমাণ আর্দ্র থাকা স্বাভাবিক যা মাশরুম চাষের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। সে সঙ্গে চাষের উপযোগী উপকরণও (যেমন খড়, কাঠের গুঁড়া, আখের ছোবড়াসহ বিভিন্ন কৃষিজ ও শিল্পজ বর্জ্য) অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য। মাশরুম চাষের সবচেয়ে বেশি সুবিধা এই, এর জন্য আবাদী জামির দরকার হয় না, ঘরের মধ্যে চাষ করা যায় এবং তাকে তাকে সাজিয়ে একটি ঘরকে কয়েকটি ঘরের সমান ব্যবহার করা যায়। এছাড়া অতি অল্প সময়ে অর্থাৎ মাত্র ৭-১০ দিনের মধ্যে মাশরুম পাওয়া যায় যা বিশ্বের অন্য কোন ফসলের বেলায় প্রযোজ্য নয়। সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে এটি খুবই লাভজনক একটি ব্যবসা। কিন্তু ওই এলাকার মাশরুম চাষীদের এটি চাষে অনীহার গুরুত্বপূর্ণ কারণ স্পন সরবরাহের অপর্যাপ্ততা। সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বীজের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে মাশরুম চাষীদের কাছে স্পন সহজলভ্য করে তুললে অনেক বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে বলে আশা করা যায়। অধিক উৎপাদন সম্ভব হলে বিদেশে মাশরুম রফতানির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রায় জাতীয় অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। মাশরুম চাষে, সংরক্ষণে, প্রক্রিয়াজাতকরণে ও বাজারজাতকরণে কর্মহীন লোকদের নিয়োজিত করে জনগণকে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
জরিপ থেকে জানা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ মাশরুম চাষী যাদের বয়স ২৫-৩০-এর মধ্যে তারা সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছে এবং প্রায় ৬৭ শতাংশ চাষী যাদের বয়স ৫৫-এর ওপর তারাও এসব প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সরকারী মাশরুম সাবসেন্টারটি বিনা অর্থে মাঝে মাঝে তিনদিনব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদান করছে এবং এ প্রশিক্ষণে বিনামূল্যে স্পন প্রদান করে চাষীদের আগ্রহ বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়া এই প্রশিক্ষণে মাশরুমের চাষাবাদ পদ্ধতি, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ এবং খাদ্য হিসেবে রকমারি ব্যবহার সম্পর্কে চাষীদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধিপূর্বক এটিকে সবজি হিসেবে দেশে জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়াস চলছে। মাশরুম চাষে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুবক-যুবতীকে মাশরুম চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। তাই এটি বেকার সমস্যা সমাধানেরও একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় দিক।
জরিপটি থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায় যে প্রায় ৬০ শতাংশ আদিবাসী মহিলা মাশরুম চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন এবং তাদের মধ্যে ৭২ শতাংশ মহিলা সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা এটি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এসব প্রতিষ্ঠান সেসব উপার্জনবিমুখ মহিলার জন্য কাজ করছে যারা আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে পিছিয়ে আছে। কর্মক্ষম মহিলাদের জনশক্তি উন্নয়নের কাজে সম্পৃক্ত না করা হলে দেশের উন্নয়ন কখনই সম্ভব হবে না। যেহেতু মাশরুম চাষ করে মহিলারা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, ঘরে থেকে সাংসারিক কাজকর্ম করেও অর্থ উপার্জন করতে পারে তাই বলা যায়Ñমাশরুম চাষ মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য একটি সম্ভাবনাময় দিক। মাশরুম চাষ স্বাস্থ্য ও পরিবেশবান্ধব। মাশরুম রোদে, ডিহাইড্রেশন পদ্ধতিতে অথবা ইলেকট্রিক ডায়ারে শুকিয়ে এয়ারটাইট প্যাকেটে ৫-৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। শুখনো মাশরুম ব্লেন্ডার মেশিনে পাউডার করে এয়ারটাইট প্যাকেটে রেখে একইভাবে ৫-৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়। মাশরুম দিয়ে জ্যাম, আচার, সস, বিস্কুট, কেক, কাবার প্রস্তুত করে দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাসহ তিন পার্বত্য জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে ইদানীং এই এলাকা পর্যটন এলাকা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এখানে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে অনেক নামী-দামী হোটেল, রেস্তরাঁ। এখানে উৎপাদিত মাশরুমের বাজারজাতকরণ সহজতর হবে এবং মাশরুম চাষীরা নিশ্চিতভাবে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে। মাশরুম অতি প্রাচীনকাল থেকে ব্যাঙের ছাতা নামে পরিচিত। সমতল অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কাছে মাশরুম খাদ্য হিসেবে ততটা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আদিবাসীদের কাছে এটি অনেক সুস্বাদু খাবার হিসেবে পরিচিত। তাই এই অঞ্চলের বাজারে এর চাহিদা ব্যাপক। মাশরুম এবং ব্যাঙের ছাতা এক জিনিস নয়। ব্যাঙের ছাতা হলো অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ছত্রাক; যা খাওয়ার উপযোগী নয় বরং বিষাক্ত। মাশরুম হলো অসংখ্য ছত্রাকগোষ্ঠী থেকে দীর্ঘ যাচাই-বাছাইকৃত টিস্যুকালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন বীজ দ্বারা সম্প’র্ণ পরিচ্ছন্ন পরিবেশে, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষ করা মৃতজীবী ছত্রাকের ফলন্ত অঙ্গ। যেহেতু মাশরুমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এই অঞ্চলে সেহেতু মাশরুম উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সফলভাবে আরো অধিক বাজারজাতকরণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া উচিত।
মাশরুম চাষের মাধ্যমে এদেশের পুষ্টি উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি (বিশেষ করে মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি), আমদানি ব্যয় হ্রাস এবং রফতানি আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। ১১টি আদিবাসী অধ্যুষিত রাঙ্গামাটি জেলাসহ পার্বত্য অঞ্চলগুলো মাশরুম চাষের জন্য একটি সম্ভাবনাময় এলাকা। যার ফলে এ অঞ্চলের জনগণের কর্মসংস্থান, আয়বৃদ্ধি, উৎপাদিত মাশরুমের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তাসহ তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের অসীম সুযোগ সৃষ্টি করবে। জরিপকৃত ফলাফলের আলোকে সর্বশেষে বলা যেতে পারে যে, যদিও পার্বত্য অঞ্চলে মাশরুম চাষের জন্য অনুকূল পরিবেশ রয়েছে কিন্তু অপর্যাপ্ত পরিমাণ মাশরুম বীজ সরবরাহ এবং জনসচেতনতার অভাব থাকার কারণে এই প্রকল্পে এখনও সফলতার ছোঁয়া লাগেনি। তাই দরকার মাশরুমের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা যেখানে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোও প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। তাহলে হয়ত এটি তৈরি পোশাক রফতানি, ওষুধ রফতানি, বিদেশী রেমিটেন্সের মতো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.